Skip to main content

কথার শতেক বাণীতে সমৃদ্ধ - ‘এলোমেলো ২’


“কথার আছে শতেক বাণী, যদি কথা কইতে জানি।"
এমনিতে হোজাই অবশ্য ঠিক বেড়াবার জায়গা বলে প্রসিদ্ধ নয়। কিন্তু ফারুক বলেছিল, সেখানে বাজারের একটা দোকানে অসমের বেস্ট রসগোল্লা খেয়েছে সে, বিকেলবেলা একটা পার্ক আছে, শান্তিবন বলে, সেখানে বসা যায়। ‘হোজাই কলেজ’ বলে একটা নামকরা কো-এড কলেজ আছে। তবে তার সামনে ছুটির সময় দাঁড়িয়ে থাকার বয়সটা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি। তাছাড়া রেল স্টেশনে, উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওভারব্রিজ দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে শহরে নামার যে ব্যবস্থা ‘কইরা দিছে’, সেখানে মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ালে মনটা উদাস হয়ে যায়।’
এই একটি অনুচ্ছেদে কীভাবে কথার মারপ্যাঁচে একটি অতি সাধারণ জায়গার অসাধারণ ব্যাপ্তি ফুটে উঠেছে লেখকের মুনশিয়ানায় তা লক্ষণীয়। কৃতি গদ্যকার সঞ্জয় গুপ্ত-এর সেই ‘এলোমেলো ১’-এর ক্ষেত্রে যে কথাটি বলা হয়েছিল - ‘তিলকে তাল’ তারই দ্বিতীয় সংস্করণ যেন আলোচ্য গ্রন্থ - ‘এলোমেলো ২’। এই একটি অনুচ্ছেদে যেন গোটা বইটির বাখানের সারমর্ম উঠে এসেছে। একটি অখ্যাত শহর, যেখানে দর্শনীয় কিছুই বলতে গেলে নেই, তারই ছোট ছোট কিছু ছবিকে কথানৈপুণ্যে এমন ভাবে পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের দরবারে যে মন চায় সেই অনামী স্থানটিতে অন্তত একবার ঢুঁ মারা যেতেই পারে। এই একটি অনুচ্ছেদে আছে যতি চিহ্নসমূহের চমৎকার ব্যবহার, আছে মুচকি হাসির চুটকি, স্থানীয় ভাষার উল্লেখ, উদাসী মনের অনুভূতি এবং হয়তো আরো অনেক কিছুই। কথাশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন এই আলোচ্য গ্রন্থটি।
গ্রন্থের শুরুতে আছে একটি দীর্ঘ গোয়েন্দা কাহিনি - ‘ফেক ইনভয়েস’ যা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত একশো ভাগ। অথচ নিটোল গল্পময়তায় টানটান উত্তেজনাময় গোয়ান্দা কাহিনির যাবতীয় উপাদান এতে উপস্থিত। কাহিনির শেষটা আরোও চমৎকার। এর চাইতে ভালো সমাপ্তি আর হতে পারে না। গ্রন্থের শেষে আছে এক অতি মনোরম ভ্রমণ কাহিনি, ‘ভৈরবকুণ্ড ভ্রমণ’। পরতে পরতে ভাষা, বর্ণনা ও বুনোটের কারিকুরি। কাহিনির সাথে সাথে পাঠকের সহভ্রমণ একশো ভাগ নিশ্চিত। এই দু’টো কাহিনিই স্থানীয় পরিমণ্ডলের অন্তর্গত। এখানেই লেখকের স্বকীয়তা। এত সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে পারেন যে লেখক তাঁর অন্তত গোটা কয়েক গল্পের বই ইতিমধ্যেই বেরিয়ে যাওয়ার কথা। অথচ গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে আছে - ‘লেখক অবশ্য নামজাদা কেউ নন ......।’ খানিক বিসদৃশ মনে হলো।
এই দু’টির বাইরে লেখকের এক বা দুই পৃষ্ঠার ফেসবুক কালেকশান। ফেসবুকে সঞ্জয় গুপ্ত তার চটুল অথচ ভাবগম্ভীর বিষয় সম্বলিত তথ্যভিত্তিক পোস্টের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেখান থেকেই তুলে আনা কিছু মণিমুক্তো। উল্লেখযোগ্য - ‘আপনার আর আমার বাংলা ভাষাটা’, ‘কাজিরাঙ্গা’, দুই পর্বে তথ্যসমৃদ্ধ কমিকের সাতকাহন - ‘বেতাল’, ‘হোজাই সফরনামা’, ‘রেল কাহিনি’, ‘ছাব্বিশে জুন, ১৯৮৩’, ‘অথ জিলিপি কাহিনী’, ‘নালিশ’ আদি সাতাশটি গদ্য। তবে ‘হরিদ্বারে’ শীর্ষক গদ্যটির নাম বোধ করি ‘তর্পণ’ হলেই বেশি মানাতো। অনবদ্য এক মানবিক আবেদন ফুটে উঠেছে শেষটায়। লেখকের সাথে সাথে হয়তো দু’চোখ সিক্ত হয়ে ওঠে পাঠকেরও।
‘মুনাফখড়ি’, ‘মদ বিক্রি’ আদি গদ্যকথায় লেখকের সামাজিক সচেতনতার আভাস পাওয়া যায়। আছে একাধিক স্মৃতিচারণমূলক লেখা। লিখনশৈলির চমৎকারিত্বে তরতর করে এগিয়ে যায় পঠন। লেখকের সহজ সরল গদ্যের বুনোট মনমাতানো। মাঝে মাঝেই কিছু প্রশ্ন, কিছু ধাঁধা ছুড়ে দিচ্ছেন পাঠকের উদ্দেশে। ক’মা ( , ) এবং ডট্‌ ডট্‌ ( ...... ) এর অসামান্য ব্যবহার। এই শৈলীটি সঞ্জয়ের লেখালেখির এক সম্পদ বলা যায়। কিছু শ্লেষ, নিখাদ হাস্যরস, সামাজিক গরজ এবং উপযুক্ত স্থানে সাধু বাক্যের ব্যবহারও তাঁর রচনাসমূহের এক উল্লেখযোগ্য দিক।
সূচিপত্র নেই। বোধ করি তার প্রয়োজনও নেই। পাঠক একবার পাঠ শুরু করে দিলে এগোতেই থাকবেন আপন ঔৎসুক্যে। পেছন ফেরার জো নেই। বানান/ছাপার ভুল প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে লেখকের পাশাপাশি প্রকাশক ভিকি পাবলিশার্সেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। শুধু কয়েকটি জায়গায় ‘আমরা’ ও ‘আমার’ এর মধ্যে গন্ডগোল বেঁধেছে এবং ‘র’ ও ‘ড়’-এর স্থানচ্যুতি ঘটেছে যা ১২৮ পৃষ্ঠার বইটির বিশালসিন্ধুতে নিতান্তই বিন্দুমাত্র।
পারফেক্ট বাইন্ডিং গ্রন্থটির মানানসই প্রচ্ছদের সৌজন্যে নয়নজ্যোতি শর্মা। ভেতরের প্রাসঙ্গিক রেখাচিত্র ফারুক শাহিদ এবং রাজর্ষি সাহার। গ্রন্থের প্রারম্ভে লেখক দু’দফায় কৃতজ্ঞতা ও ঋণ স্বীকার করেছেন প্রিয় পাঠকদের, প্রতিক্রিয়া লিখিয়েদের, ভারতীয় ডাক বিভাগের এবং কয়েকজন সাহিত্য সম্পর্কিত গুণীজনদের। লিপিবদ্ধ হয়েছে লেখকের পূর্ববর্তী গ্রন্থ ‘এলোমেলো ১’-এর উপর দু’টি পাঠ প্রতিক্রিয়াও। পুরো গ্রন্থটি পড়ার পর কারো যদি লেখক সঞ্জয় গুপ্তকে সাহিত্যিক বলতে দ্বিধা হয় তাহলে অনায়াসে বলা যায় তিনি এ অঞ্চলের এই মুহূর্তে সেরা ‘কথাকার’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘এলোমেলো ২’
সঞ্জয় গুপ্ত
মূল্য - অনুল্লেখিত
যোগাযোগ - ৯১০১৩৩২৯৩৬

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...