Skip to main content

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সফরনামা # ধুবড়ি-গৌরীপুর


(১)

মেরিন ড্রাইভ ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি এক পাশে সাগর, উপসাগর - চোখ ফেরানো দায় এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে বহুবার পুরী - কোনার্ক কিংবা মুম্বই, চেন্নাই, পুডুচেরি কিন্তু সবেতেই নিছক সওয়ারি হয়ে ড্রাইভ ধরে গেছি কিন্তু ড্রাইভ করিনি এবং তখন থেকেই এমন একটা সুপ্ত ইচ্ছে যে মনের মধ্যে দানা বেঁধে রয়েছিল সে কথাটি থেকেই গেছে গোপনে

আচ্ছা সাগরের তীর ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তাটি যদি মেরিন ড্রাইভ হয় তাহলে নদীর পারে পারে চলে যাওয়া রাস্তাটি ধরে ছুটে চলাকে নিশ্চিত রিভার ড্রাইভই বলতে হবে চমক, জমক কিংবা রোমাঞ্চ কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেইসেম টু সেম এবার স্টিয়ারিং হাতে ড্রাইভ ধরে এগিয়ে যাওয়ার লুকিয়ে থাকা সেই সুপ্ত ইচ্ছেটি যে এভাবে এতগুলো বছর পর কার্যক্ষেত্রে ঘটে যাবে তা কিন্তু ঘটনাটির দিন তিনেক আগেও কল্পনায় আসেনি

আসছে পুজোতে একটি জমজমাট দূরভ্রমণের ব্যাপারে যখনবু বু - বা বাচলছিল ঠিক তখনই মেয়ে একদিন কলেজ থেকে এসে জানাল যে কলেজে এক সপ্তাহ গরমের বন্ধ থাকছে সুতরাং কোথাও একটু ঘুরে আসা যায় দিন দুই-তিনের জন্য একঘেয়ে জীবনযাত্রায় হাঁফিয়ে ওঠা আমরা দুজনও তাই এক কথায় রাজি কাছাকাছি এমন কোথাও যাওয়া হোক যেখানে আগে যাওয়া হয়নি অথচ গেলে ভালো লাগবে এবার চিন্তাচর্চা শুরু হলো সম্ভাব্য স্থান নির্ণয়ের জন্য কোথায় আছে সেই আরশিনগর ? অন্য আরোও দুএকটি জায়গার পাশাপাশি আমিই প্রস্তাবটি রাখলাম চলো যাই ধুবড়ি ধুবড়ি কেন ? উজানে তো অনেক গেছি এবার তাই ভাটির টানে ঘুরে আসা যাক এবং আমার জানা মতো বেশ কিছু ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানও আছে সেখানে শেষ পর্যন্ত সেটাই স্থির হলো মাঝে একটি মাত্র দিন তিন জন মিলে তৈরি হয়ে নিলাম ঝটিতি

তিনজন মিলে একটিমাত্র ব্যাগে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু প্যাক করে বেরিয়ে পড়লাম দুদিন পরেই ধুবড়ির উদ্দেশে বাস কিংবা ট্রেনে সফর তেমন সুবিধেজনক হবে না। ট্রেনের সময়সূচি উপযুক্ত নয়। বাসেও দীর্ঘ যাত্রার অস্বস্তি। তাই গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ঠিক। এবার তাই ড্রাইভিং সিটে আমি আর সামনে পিছনে মা মেয়ে পালা করে গুগলে দেখে নিলাম ছয় থেকে সাত ঘন্টার ড্রাইভ ফোন করে হোটেল বুক করে নিলাম আগের দিনই সকাল সাড়ে আটটায় দুর্গা দুর্গা

গুয়াহাটি থেকে ধুবড়ি দুটি সড়ক রাস্তা আছে নলবাড়ি, উত্তর শালমারা, গৌরীপুর হয়ে ৩১ নং রাষ্ট্রীয় পথ ধরে কিংবা গোয়ালপাড়া (বাইপাস), জোগিঘোপা হয়ে ৩৭ নং রাষ্ট্রীয় রাজপথ ধরে আবার সেই উত্তর শালমারাতে মিলে গৌরীপুর হয়ে যেহেতু প্রথম বারের যাত্রা তাই দুটি পথকেই চেনার নিমিত্তে প্রথম যাত্রায় ধুবড়ি অভিমুখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ৩১ নং সড়ক ধরে ঘন্টাদুয়েকের সফর শেষে নলবাড়িতে পেটপুরে সকালের আহার সেরে আবার ছুটে চলল গাড়ি যে হোটেলে খাওয়া হলো সেখানে দেখলাম পরম্পরাগত অসমিয়া পোশাক পরে সব মহিলা কর্মচারীরা সব দিক সামলাচ্ছেন। বলা যায় এক বিরল অভিজ্ঞতা। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সুস্বাদু খাবার। যাত্রাশুরুটা ভালোই হলো - বলল সবাই। 

আমার ভ্রমণ বরাবরই নদীকেন্দ্রিক মানসে কিংবা বনানীকেন্দ্রিক আমাদের এই দেশ কিংবা রাজ্য প্রকৃতার্থেই সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা জল, ফসল এবং শ্যামলী বনানীর অফুরান ভাণ্ডার এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এই যাত্রাপথে চোখ জুড়ানো সব সম্ভারের হদিশ পেয়ে মন প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে নিরন্তর আই, বেকি, মানস-এর টইটম্বুর মোহনীয় রূপ পেরিয়ে উত্তর শালমারা পেরোতেই দীর্ঘ অরণ্যের বুক চিরে সদ্য নির্মিত মসৃণ পথ ধরে যেতে যেতে আর সামলে রাখা গেল না নিজেকে এই বনানীপথের মাঝামাঝি এক জায়গায় গাড়ি থেকে নেমে পড়ি সবাই পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে চলছে রেলপথ সড়ক থেকে পঞ্চাশ মিটার মতো দূরত্বে যেখানে গাড়ি থামিয়ে নেমেছি সেখান থেকে একটি রাস্তা নেমে গেছে রেল লাইনের দিকে এবং সামনেই তাকিয়ে দেখি খানিকটা সামনে গিয়েই রেল লাইন ঢুকে গেছে সুড়ঙ্গে মুহূর্তে মন ছুটে যায় পাহাড় লাইনের রেল-পাহাড়ের নৈসর্গিক অবস্থানে বাঁদিক ধরে বর্ষায় জলে ভিজে বনের গাছলতারা খুশির আমেজে যেন মেলে ধরেছে নিজেদের কচি, নধর পাতায় ফুলে সুসজ্জিত বনানীর এমন মোহনীয় রূপ আমাকে আকর্ষণ করে নিয়ত। ডানে ছোট্ট একটি জলধারা বয়ে চলেছে সড়ক ও রেল লাইনের মাঝখান দিয়ে সমান্তরাল ভাবে বাস রাস্তা দিয়ে ঘন ঘন ছুটে আসছে নানা ধরণের যানবাহন এরই মাঝে চুটিয়ে হলো ফটোশ্যুট

ফের চলতে শুরু করে বনানী পেরোতেই এবার সত্যিকার অর্থে নিম্ন আসাম পথের দুধারে অসংখ্য জলাশয় ও ডোবা এবার নব রূপে ধরা দিল রূপবতী চম্পাবতী, টিপটপ টিপকাই ও গুরুগম্ভীর গদাধর এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় একের পর এক আধাশহর - চাপর, বিলাসীপাড়া (বাইপাস্‌) পেরিয়েই গৌরীপুর প্রতিমা পান্ডে বরুয়া ও প্রমথেশ বড়ুয়া খ্যাত গৌরীপুর গৌরীপুর এবং ধুবড়িকে অনায়াসে ট্যুইন টাউন বলা চলে গৌরীপুর থেকে রাষ্ট্রীয় সড়ক ডানে বাঁক নিয়ে চলে গেছে বক্সিরহাট সীমান্তের দিকে আর সোজা রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে ব্রহ্মপুত্রে - ধুবড়ি শহরে দূরত্ব আট কিলোমিটার গৌরীপুর শহরের পাশ দিয়ে চলেছে রাস্তা রাস্তার পাশেই সমান্তরাল বয়ে চলেছে গদাধর নদী মাঝে কংক্রিটের ভিউ পয়েন্ট দেখে মন আনচান কিন্তু না প্রায় বিকেল হতে চলেছে সকালের জলখাবারের পর আর পেটে পড়েনি কিছু তাই আমরা যেতে থাকি সামনের দিকে এই গোটা আট কিলোমিটার পথ মানেই যেন সেই মেরিন ড্রাইভ বাঁ পাশে গদাধর আর তারই গা ঘেঁষে সোজা রাস্তা ডান দিকে রেল লাইন - সড়কের পাশেই সমান্তরাল অসাধারাণ এক দৃশ্যপট আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে পরদিন এখানেই এসে ব্রেকফাস্ট কিংবা লাঞ্চ সারব বিকেল সাড়ে তিনটেয় সাত ঘণ্টা যাত্রাশেষে ধুবড়ি শহরে পৌঁছে গেলাম হোটেলে বলাই ছিল সজ্জন হোটেল ম্যানেজার সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করে কাঁচুমাচু মুখ করে জানালেন দুপুরের খাবার শেষ আমাদের আগে বলা থাকলে ভালো ছিল কী আর করা ? তাঁরই নির্দেশ মতো পাশেই অন্য একটি খাবার হোটেলে শেষ বিকেলে দুপুরের আহার সেরে আমাদের হোটেলে এসে খানিক বিশ্রাম

ঠিক সন্ধের আগে আগে আমরা বেরিয়ে পড়ি ধুবড়ি শহরের বিখ্যাত গুরুদ্বারা দেখার উদ্দেশে প্রায় ব্রহ্মপুত্রের গা ঘেঁষে দণ্ডায়মান বিশালাকায় সুরম্য প্রাসাদোপম এই গুরুদ্বারার এক সুমহান ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে এই স্থানে সংঘটিত হয়েছিল এক মহামিলন শিখ গুরু নানকদেব জী এবং শ্রীমন্ত শঙ্করদেব এখানে মিলিত হয়েছিলেন যখন গুরু নানকদেব ঢাকা থেকে আসামে এসেছিলেন এর পর ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে নবম শিখ গুরু টেগবাহাদুরও এখানে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে তাঁরই নামানুসারে গুরুদ্বারার সামনের দীর্ঘ রাস্তাটির নামকরণ করা হয় বিকেলের শেষ রবিকিরণকে গায়ে মেখে আমরা প্রবেশ করি গুরুদ্বারায় পরম্পরা অনুসারে আমাদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয় গৈরিক বস্ত্রখণ্ড দোতলায় প্রশস্ত হলের মধ্যিখানে শিখ ধর্মীয় প্রতীকের সামনে দাঁড়াতেই কেমন এক প্রশান্তি যেন ছেয়ে ফেলে মনপ্রাণ ধর্মকর্ম বিষয়ক বাহ্যিক আড়ম্বরে আমার মতিগতি বরাবরই কম পত্নী ও কন্যা দস্তুর মতো ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ধ্যানে বসেছেন যেখানে আমি প্রতীকের সারমর্ম কিছু বুঝতে না পেরে এক পাশে সরে গিয়ে দানপাত্রে কিছু দক্ষিণা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এক পাশে ভাবছি সেই মহামিলনের ক্ষণটির কথা একজন শিখ ভদ্রলোক এসে বললেন - এখানে এভাবে দায়সারাভাবে না দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে দাঁড়াতে হয় আমার চিরদিনই একটু রগচটা মুড তাঁকে বুঝালাম যে আমার ভক্তি যা আছে তা হৃদয়েই আছে চিন্তা করবেন না বুঝলেন কিনা জানি না আমরা বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে আসা অবধি আমাকে টানছে মহাবাহু এত কাছে এসে তাঁকে না দেখে কী করে ফিরে যাই ? কয়েক পা হেঁটে গিয়ে সোজা ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে তখন সন্ধ্যা প্রায় নেমেছে শহর জুড়ে ঘাটে লাগানো আছে ইঞ্জিনবিহীন স্টিমার ফেরি চলাচল ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে স্টিমারঘাটের হিসাবরক্ষক সারা দিনের আয়ের হিসেব করছেন তাঁর অনুমতি নিয়ে উঠে গেলাম থেমে থাকা স্টিমারে ভদ্রলোকের কাছ থেকে জানলাম - এখান থেকে ওপারের জলেশ্বর এবং অন্যান্য জায়গায় রোজ ফেরির ব্যবস্থা আছে মহাবাহুর বুকের উপর স্টিমারে দাঁড়িয়ে আরেক দফা শেষ বিকেলের ফটো সেশন শেষে বেরিয়ে এলাম ঘাট থেকে। ততক্ষণে ঘাট সংলগ্ন শিশু উদ্যান মুখরিত হয়ে উঠেছে কচিকাঁচাদের কলতানে। আমরা সেখান থেকে ই-রিকশা নিয়ে সোজা চলে গেলাম ধুবড়ি কালীবাড়ি সংলগ্ন বাজারে টুকটাক কেনাকাটা না করলে মহিলাহৃদয় তৃপ্ত হয় না। অগত্যা......। হোটেলে ফিরে রাতের খাবার শেষে ক্লান্তিজনিত নিদ্রার কোলে চলে যেতে সময় লাগল না একটুও।

 

(২)

পরদিন সকাল দশটা নাগাদ চা-টা খেয়ে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ি গৌরীপুরের উদ্দেশে। গদাধর যেন ডাকছেন হাতছানি দিয়ে। ‘মেরিন ড্রাইভ’ থুড়ি ‘রিভার ড্রাইভ’ ধরে ধুবড়ি-গৌরীপুর যদিও মিনিট দশেকের রাস্তা কিন্ত গদাধরের বুকে ভাসমান ধরণের একেবারেই গা-ঘেঁষা রেস্তোরাঁয় আগে থেকেই ভাবা ছিল প্রাতঃরাশের কথা। সে অনুযায়ীই কাজ। রুটি, বিরিয়ানি সহযোগে পেটপুরে তাই হলো। রেস্তোরাঁটির অবস্থান এবং ফুলসজ্জা আকর্ষণীয় ছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক অনায়াসে কাটিয়ে দিলাম সেখানে। তিন তিনটি মোবাইল ক্যামেরা ছবি উঠিয়ে চলছে একাধারে। পিছনেই ধীর গম্ভীর গদাধর আপন মনে কুলুকুলু বয়ে চলেছেন মোহনার দিকে - মহাবাহুতে বিলীন হতে। সামনে সড়কের গা ঘেঁষে রেলের ইস্পাতের সমান্তরাল পাত। চোখ জুড়ানো দৃশ্যাবলি। প্রাতঃরাশ শেষে এবার গন্তব্য গৌরীপুর শহর।

নিমেষেই পৌঁছে গেলাম গৌরীপুর শহরের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটির পাশে গদাধরের উপর নির্মিত ভিউ পয়েন্ট- হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই নেমে এলাম গাড়ি থেকে তিনজন মিলে ডানদিকে ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেলাম অবর্ণনীয় সেই দৃশ্য গদাধরের শুভ্র জল সরিয়ে নদীবক্ষে ছুটে যাচ্ছে যাত্রীনৌকো এদিকে ভিউ পয়েন্টের পাশে বৃহৎ দু’টি বৃক্ষ। মধ্যবর্ষার শ্রাবণ দিনে কদম আর কৃষ্ণচূড়া যেন আদরে সোহাগে জড়িয়ে ধরেছে একে অন্যকে। অসাধারণ এক দৃশ্যপট। মিনিট পনেরোর মতো সময় ধরে চোখ দু’’টিকে সার্থক করে ফিরে এসে বসলাম গাড়িতে। পরবর্তী গন্তব্য গৌরীপুরের ঐতিহাসিক রাজবাড়ি।

গৌরীপুর শহরের মতো এমন পরিচ্ছন্ন এবং পরিকল্পিত শহর এ রাজ্যে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ (যদিও আজকাল অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে গদাধরের তীরে একটি জায়গায় শহরের বর্জ্য পদার্থের ঢিবি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি)। শহরে লোকসংখ্যাও অপেক্ষাকৃত কম। সোজা, সরল এবং ফাঁকা রাস্তা ধরে তাই কম সময়েই পৌঁছে গেলাম জৌলুস হারানো মাটিয়াবাগ রাজবাড়ি বা হাওয়াখানা। বাইরে থেকেই দেখে এলাম, অনুভব করে এলাম রাজা ও জমিদারের ইতিহাস সম্বলিত ইমারত। সে ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে নবনির্মিত গণেশ মন্দির। নিখাদ শ্বেতশুভ্র মন্দিরে শ্রীগণেশের সৌম্য উজ্জ্বল মূর্তি দর্শকমনে সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা জাগায়। সঙ্গেই গণেশ আখড়া। গোটা চত্বরটিই দেখার মতো এবং অনায়াসে কিছু সময় কাটানো যায় সেখানে। কিন্তু আমাদের হাতে আর তত সময় নেই। তবু আরোও খানিকটা এগোতেই যখন চোখে পড়ল রাস্তার বাঁ পাশে বিশাল আরেকটি জলাশয় তখন গাড়ি থামিয়ে চলে গেলাম সেই জলাশয়ের ধারে এবং অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সেদিকেও গদাধর। অর্থাৎ গদাধর বলতে গেলে গোটা গৌরীপুর শহরকেই বেষ্টিত করে রেখেছে। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গতিপথ পরিবর্তন করে বাঁদিক থেকে ডানদিকে ঘুরে এসেছে। অপরূপ সেই দৃশ্য। বাঁদিকের গদাধরের পারেই একটি ভিউ পয়েন্ট এবং প্রয়াত প্রতিমা পান্ডে বরুয়ার নামাঙ্কিত একটি তোরণ। মনের মধ্যে কোথা থেকে যেন ভেসে এল সেই অনবদ্য সুর - ‘গেইলে কি আসিবেন, মোর মাহুত বন্ধু রে...।’ চির অম্লান সেই সুরের মাদকতা। গুনগুন করতেই গলা মেলাল আমার কন্যা।

গৌরীপুর থেকে এবার ফেরার পালা। সোজা চলে এলাম আবার ধুবড়ি শহরে। সরাসরি এবার গদাধরের মোহনায় ব্রহ্মপুত্রের তীরে ‘নেতাই ধোবানি ঘাট’। প্রশস্ত গদাধর এখানে শান্ত, সৌম্য, গম্ভীর। মহাবাহুতে বিলীন হওয়ার পূর্বমুহূর্তে যেন আপন খেয়ালে ধ্যানমগ্ন। কয়েকটি নৌকো বেঁধে রাখা আছে পরপর।

মনসা মঙ্গলের তথা হিন্দু লোককথা অনুযায়ী লখিন্দরের মরদেহ নিয়ে বেহুলার ভেলা নাকি এখানে এসেছিল এবং এই ঘাটে কাপড় কাঁচতে থাকা নেতা ধোপানির সান্নিধ্যে এসে বেহুলা মা মনসার দ্বারস্থ হতে পেরেছিলেন। সযত্নে রক্ষিত আছে এই স্থানটি। প্রতিমূর্তি স্থাপন করে তুলে ধরা হয়েছে দৃশ্যপট। এই ধোপানি বা ধোবানি থেকেই জায়গাটির নাম ধুবড়ি বলে জানা যায়। ঠিক এই ঘাটের বিপরীতেই ঐতিহাসিক পাঁচ পীরের দরগা। ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মীয় সহাবস্থানের এক জ্বলন্ত নিদর্শন। পাশেই একদিকে আছে ‘চান্দের ডিঙা প্রস্তর’ এবং অন্যদিকে একটি নবনির্মিত পার্ক যেখানে আছে প্রয়াত সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক রাহুল দেব বর্মণের প্রতিমূর্তি। একটু অবাক হওয়ার মতোই ব্যতিক্রমী এই প্রতিমূর্তি। সচরাচর কোনও গায়কের প্রতিমূর্তি কোথাও দেখা যায় না - অন্তত এদিককার শহরগুলোতে। প্রতিমূর্তিটি উন্মোচন করেছিলেন আসামের স্বনামধন্য গায়ক ও সুরকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ দুই দিক দুই নদ নদীতে বেষ্টিত ধুবড়ি শহরে এক সময় পদার্পণ ঘটেছিল স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসেরও। তাই এদিকে ওদিকে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নেতাজীর প্রতিমূর্তি। আছে একাধিক মসজিদও। ইতিহাস আর ঐতিহ্য যেন ঘিরে রেখেছে শহরটিকে।  

ঐতিহাসিক এই শহরে আপাতত আমাদের দেখাদেখির পালা শেষ করে ফিরে এলাম হোটেলে। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হওয়ার উপক্রম। ধুবড়ি আসব অথচ ইলিশ মাছ খাব না তা কি হয় ? যদিও এটা ইলিশের মরশুম নয় তবু আমাদের দাবি মেনে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য বিশেষ করে ইলিশ মাছ আনিয়ে ফ্রাই করে রেখেছেন। সুতরাং পেট পুরেই হলো মধ্যাহ্নভোজন। আমরা রুমে চলে গেলাম বিশ্রাম নিতে।

আমি যেখানেই যাই সেখানেই শেষ সন্ধ্যায় একটু একাকী ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস আমার চিরদিনের। বেরোলাম তাই। শুনেছি ধুবড়ির মিষ্টিও নাকি প্রসিদ্ধ। সহধর্মিণীর মিষ্টি খাওয়া মানা। মেয়ে ছুঁয়েও দেখে না মিষ্টি। তাই একাই গিয়ে ঢুকলাম মিষ্টির দোকানে এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এখনও সেখানে ৮ থেকে ১০ টাকায় প্রমাণ সাইজের সুস্বাদু মিষ্টি বিক্রি হয়। আনমনে ঘুরছি এদিক ওদিক। লক্ষ্য করলাম একের পর এক হিন্দু বাঙালি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। চতুষ্পাঠী, হরিসভা, কালীবাড়ি ইত্যাদি। এবং একটু অবাকই হলাম আজকের ভাষিক উগ্রতার দিনেও জ্বলজ্বল করছে একাধিক বাংলা সাইনবোর্ড। আর তখনই মনে হলো যে আজ দু’দিন ধরে তো এখানে বাংলার বাইরে অন্য ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি কোথাও। সবাই - হাটে বাজারে, দর্শনীয় স্থানে সবাই বাংলাতেই কথা বলছে। কিমাশ্চর্যম !! আর ধুবড়ির সেই উইমকো ম্যাচ্‌ ফেক্টরীর কথা মনে আছে তো ? সেখানকার একমাত্র শিল্পোদ্যোগটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আফশোশ কিন্তু শুনতে পেয়েছি অনেকের মুখে। পাশাপাশি ইতিমধ্যে শুরু হওয়া মেডিকেল কলেজ, রেল যোগাযোগ এবং আগত ধুবড়ি-ফুলবাড়ি সেতুর কথায় আশার ঝিলিক। তবু কেন জানি মনে হলো পর্যটনকে ভিত্তি করে আরোও অনেক কিছুই করার আছে সেখানে। আশা করা যায় সরকার বাহাদুর সেদিকটায় গুরুত্ব দেবেন।

 

(৩)

পরদিন ফেরার পালা। সকাল সকাল স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনও শেষ হয়ে যায়নি আমাদের দেখাদেখির পালা। ধুবড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্বে বগরিবাড়ি (আসল নাম বক্রিবাড়ি। কারণ ব্রহ্মপুত্র এখানে বড় বাঁক নিয়েছিল) অঞ্চলে মূল রাস্তা থেকে দেড় কিলোমিটার ভিতরে প্রসিদ্ধ মহামায়া মন্দির। ইতিমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মহামায়ার অপরূপ মুখমণ্ডলের ছবি সম্বলিত এই মহামায়া মন্দিরটি অনেক বড়। দেখার মতোই। গৌরীপুরের রাজা নাকি এক সময় এখানে শিকারে এসে একটি সাপকে একটি ব্যাঙ গিলে খাওয়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং সেই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্ত নেন যে এখানে দেবীর একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই থেকে এই মন্দিরের পত্তন। বিশাল এক সাপের আকৃতির একটি ইমারতও তাই আছে এখানে। যথারীতি বাঁদরের উৎপাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে পুজো সেরে সকালের জলখাবার সেরে আমরা চলে এলাম মহামায়া মন্দির থেকে এক কিলোমিটার দূরের দীর্ঘেশ্বরী মন্দিরে। প্রাকৃতিক নির্জনতায় অবস্থিত বিশাল এই মন্দিরে কংক্রিটের বটবৃক্ষ এবং বৃহদাকায় সাপ ও শিবের প্রতিমূর্তি দেখে সত্যিই অভিভূত হতে হয়। মন্দিরের ঠিক নিচেই বয়ে চলেছে ভরা বর্ষার টালমাটাল টিপকাই নদী। বাঁধানো স্নানঘাটের সিঁড়িতে খানিক দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধতায় ভরে উঠল মন প্রাণ।

এবার সত্যিকার অর্থেই ফিরে আসার চিন্তা, ইতিমধ্যে প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। ফেরার পথে রাস্তা বদল করে ৩৭ নম্বর রাষ্ট্রীয় পথ ধরে উত্তর শালমারা থেকে ডানে বাঁক নিয়ে চলন্তপাড়া, যোগিঘোপা, গোয়ালপাড়া, কৃষ্ণাই, দুধনৈ হয়ে বিকেল সাড়ে ছ’টায় গুয়াহাটি। পথে যোগিঘোপায় ব্রহ্মপুত্রের উপর নরনারায়ণ সেতু দেখা এবং দুধনৈতে দুপুরের আহার সেরে নেওয়া হলো। দু’দিনের সফরে এমন কিছু স্নিগ্ধ স্মৃতি নিয়ে ফিরে এসেছি যা অনেক ক্ষেত্রে হিল্লিদিল্লি ঘুরে এসেও হয়তো সেভাবে অনুভব করা যায় না। ইতিহাসকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে নতুন করে যেন উদজীবিত হয়ে এলাম সবাই।

 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়