সংস্কৃত ‘মিল’ শব্দ থেকেই মেলা শব্দের উৎপত্তি। যার অভিধানগত অর্থ হচ্ছে উৎসব, পার্বণ ইত্যাদি উপলক্ষে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থাযুক্ত অস্থায়ী হাট। অর্থাৎ
মূলত আমোদ প্রমোদের জন্য আয়োজিত মিলন উৎসবই হচ্ছে মেলা যেখানে থাকছে বিকিকিনিরও
ব্যবস্থা। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র অনুযায়ী মেলার বিন্যাস, নামকরণ।
যেমন সময় অনুযায়ী - চৈত্র মেলা, বৈশাখি মেলা, পৌষ মেলা ইত্যাদি। আবার স্থান অনুযায়ী - যেমন সোনাঝুরির মেলা। বিশেষ
দ্রব্যাদির প্রদর্শনী ও বিক্রি উপলক্ষে - পিঠেপুলির মেলা, বইমেলা,
বাণিজ্য মেলা ইত্যাদি। উৎসবাদির নামে মেলা - যেমন
গাজনের মেলা, চড়ক মেলা, শিবরাত্রি মেলা
ইত্যাদি। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম
অনুসারে চিহ্নিত মেলা - যেমন গান্ধিমেলা, নেতাজি মেলা, রবীন্দ্র
মেলা, বিবেকানন্দ মেলা ইত্যাদি।
সরকারি তরফেও নিয়মিত আয়োজিত হয়ে
থাকে বিভিন্ন মেলা। সেখানে বাণিজ্যই প্রধান, মিলন নয়। এখানেই একটা বিরোধ ছিল
রবীন্দ্রনাথের। তিনি চেয়েছিলেন শহর থেকে গ্রামে, পল্লীতে
আয়োজিত হোক সমাগম, নিখাদ মিলন মেলা। ‘স্বদেশী
সমাজ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘যেমন
আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের
ভাবে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর— মেলা৷’
মেলায় সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন তিনি। হাল আমলে শীত পড়লেই
মিষ্টি থেকে মাছ, বই থেকে গান, যে কোনও
ভোগ্যপণ্যকে ঘিরেই এখন সরকারি মেলা বসে যায়৷ কিন্তু মিলন ভাবের কথা সেখানে ওঠে না৷
ক্রেতা আর বিক্রেতা, এই দুটো খোপের কিছু মানুষ পণ্য কেনাবেচা
করেন, এটাই সে মেলার তাৎপর্য৷ নিছক বিকিকিনি। মানুষে মানুষে
সংযোগের কোনো স্থান নেই। অথচ রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন, ওই
সংযোগেই সমাজ তৈরি হয়, যে সমাজ ‘বাইরের
সাহায্য’-এর অপেক্ষা রাখে না, ‘বাইরের
উপদ্রবে শ্রীভ্রষ্ট’ হয় না৷ ‘বাইরের
সাহায্য’ আর ‘বাইরের উপদ্রব’ দুটো কথাতেই সরকারকে নির্দেশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে যুদ্ধবিগ্রহ রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্য রাজা করিয়াছেন,
কিন্তু বিদ্যাদান হইতে জলদান পর্যন্ত সমস্তই সমাজ এমন সহজভাবে
সম্পন্ন করিয়াছে যে, এত নব নব শতাব্দীতে এত নব নব রাজার
রাজত্ব আমাদের দেশের উপর দিয়া বন্যার মতো বহিয়া গেল, তবু
আমাদের ধর্ম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে পশুর মতো করিতে পারে নাই, সমাজ
নষ্ট করিয়া আমাদিগকে একেবারে লক্ষ্মীছাড়া করিয়া দেয় নাই৷ রাজায় রাজায় লড়াইয়ের
অন্ত নাই, কিন্তু আমাদের মর্মরায়মাণ বেণুকুঞ্জে— আমাদের আমকাঁঠালের বনচ্ছায়ায় দেবায়তন উঠিতেছে, অতিথিশালা
স্থাপিত হইতেছে, পুষ্করিণীখনন চলিতেছে...৷’
ভারতবর্ষের মেলার যে আদি চরিত্র, যেখানে দেশের লোক
সহজেই মন খুলে যোগ দিতে পারে, তারই ধারাবাহিকতায় পৌষমেলার
পরিকল্পনা ছিল তাঁর৷ ‘স্বদেশী সমাজ’-এ
দেশের মন্ত্রণার কাজে সেই মেলাকেই তিনি সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করেছিলেন, ‘মনে করো প্রোভিনশ্যাল কনফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার
কার্যে নিযুক্ত করিতাম, তবে আমরা কী করিতাম ? তাহা হইলে আমরা বিলাতি ধাঁচের একটা সভা না বানাইয়া দেশী ধরণের একটা বৃহৎ
মেলা করিতাম৷ সেখানে যাত্রাগান আমোদ-আহ্লাদে দেশের লোক দূর দূরান্তর হইতে একত্র
হইত৷ সেখানে দেশী পণ্য ও কৃষিদ্রব্যের প্রদর্শনী হইত৷ সেখানে ভালো কথক কীর্তনগায়ক
ও যাত্রার দলকে পুরস্কার দেওয়া হইত৷ সেখানে ম্যাজিক-লণ্ঠন প্রভৃতির সাহায্যে
সাধারণ লোকদিগকে স্বাস্থ্যতত্ত্বের উপদেশ সুস্পষ্ট করিয়া বুঝাইয়া দেওয়া হইত এবং
আমাদের যাহা-কিছু বলিবার কথা আছে, যাহা-কিছু সুখদুঃখের
পরামর্শ আছে, তাহা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলিয়া সহজ বাংলা ভাষায়
আলোচনা করা যাইত৷’
আজকের মেলাসমূহ সত্যিই সেই দেশি
ধরনের বৃহৎ মেলা কি না সে ভিন্ন তর্ক৷ কিন্তু মেলার এই আদিম তাৎপর্যটাকে শিশুপাঠ্য
রচনায় ঢেকে না রেখে তার একটা অনুশীলন করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা মনে রাখা
জরুরি৷ বিশেষ করে বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা আর সমাজের সর্বক্ষেত্রে বাইরের
উপদ্রবে ‘অসহিষ্ণু’ এই সময়ে৷
১৮৬৭ সালে যখন ‘হিন্দু মেলা’
শুরু হয় তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ছয় বছরের বালকমাত্র। কিন্তু
কয়েক বছর পরেই তিনি এই মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ‘হিন্দু
মেলা’র এক বিশেষ তাৎপর্য ছিল তখনকার ভারতবর্ষে। এটি ছিল
ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে স্বাদেশিকতার ভাব জাগরণ তথা জাতীয় চেতনার
প্রসারের উদ্দেশ্যে আয়োজিত একটি মেলা। এই প্রতিঠান জাতীয় মেলা ও স্বদেশী মেলা
নামেও পরিচিতি লাভ করে। ১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুর পরিবারের সহযোগিতায়
কলকাতায় প্রথম হিন্দু মেলা আয়োজিত হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নবগোপাল মিত্রের যৌথ উদ্যোগে প্রথম হিন্দু মেলার
আয়োজন করা হয়। এই মেলার অপর বৈশিষ্ট্য ছিল দেশীয় শিল্পোৎপাদনে উৎসাহ দান,
দেশীয় প্রতীকসমূহের প্রতি আনুগত্য । এই জন্য এই মেলাকে বিংশ
শতাব্দীর প্রথমার্ধের স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়। হিন্দু মেলা
কলকাতার বাঙালি সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটি নির্দেশ করে। প্রথম দিকের
হিন্দু মেলা উদ্বোধিত হত চৈত্র সংক্রান্তির দিন। বস্তুত ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল
নবগোপাল মিত্র চৈত্রমেলা নামে একটি জাতীয় মেলার সূচনা করেন। পরে এই নাম হয়
হিন্দুমেলা। এই উপলক্ষে দেশাত্মবোধক কবিতা ও গান লেখা হত। বাঙালি ও পাঞ্জাবি
ছাত্রদের মধ্যে আয়োজিত হত কুস্তি প্রতিযোগিতাও। থাকত হিন্দুদের কর্মদক্ষতা
সংক্রান্ত নানা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও। মেলার প্রধান উদ্যোক্তা নবগোপাল মিত্র
চাইতেন সরকারের উপর দেশের জনসাধারণের নির্ভরতা কমিয়ে তাদের স্বনির্ভর ও
স্বাবলম্বী করে তুলতে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই মেলায় যোগ দিতেন।
ছাপার অক্ষরে রবীন্দ্রনাথের
নামযুক্ত প্রথম কবিতা 'হিন্দু মেলায় উপহার' হিন্দুমেলায় পঠিত হয়। ১৮৭৫
সালে রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে আয়োজিত হিন্দু মেলায় তিনি একটি স্বরচিত কবিতা
পাঠ করেন। ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজ পত্রিকায় ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫
তারিখে প্রকাশিত সংবাদে লেখা হয়েছিল, “Baboo Rabindranath Tagore, the youngest
son of Baboo Debendranath Tagore, a handsome lad of some 15 had composed a
Bengali poem on Bharat (India) which he delivered from memory; the suavity of
his tone much pleased the audience.” (বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরে
পঞ্চদশবর্ষীয় কনিষ্ঠ পুত্র বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বরচিত কবিতা মুখস্থ
আবৃত্তি করে শ্রোতাদের বিমোহিত করেন।) ১৮৭৭ সালে তিনি “দিল্লি
দরবার” কবিতাটি হিন্দু মেলায় আবৃত্তি করেছিলেন।
আজকের দিনে বিভিন্ন মেলায় রকমারি আয়োজনের
মধ্যে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসার একটি উল্লেখযোগ্য দিক যা রবীন্দ্র ভাবনারই
অনুসারী। বেসরকারি বা বিভিন্ন সংস্থা
দ্বারা আয়োজিত মেলাসমূহ তাই হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থেই মিলনের তীর্থক্ষেত্র। সরকারি স্তরে আয়োজিত মেলারও রয়েছে
ভিন্ন তাৎপর্য। সব মেলাই থাকুক আপন আপন বৈশিষ্ট্য
নিয়ে মহামিলনের আনন্দে মহীয়ান হয়ে।
- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
তথ্যঋণ - আন্তর্জাল।
Comments
Post a Comment