Skip to main content

উত্তর পূর্বের বাংলা সাহিত্য বিষয়ক গবেষণাধর্মী সংগ্রহযোগ্য পত্রিকা ‘প্রবাহ’


ধারাবাহিকতার ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে দক্ষিণ অসমের লালা থেকে উৎকৃষ্টতায় ভরপুর হয়ে আবারও আত্মপ্রকাশ করল সাহিত্যিক আশিসরঞ্জন নাথ সম্পাদিত গবেষণাধর্মী ছোট পত্রিকা প্রবাহ’। প্রকাশিত হল বর্ষ ৩৫, সংখ্যা ২। এবারের বিষয় উত্তর পূর্বের বাংলা সাহিত্য (পর্ব-২, আসাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের বাংলা সাহিত্য)। উত্তর পূর্বের বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্ভারকে একটিমাত্র পর্বে গ্রন্থিত করা প্রকৃতার্থে অসম্ভব। তাই এই বিভাজন বিন্যাস।
বাংলা আহিত্য বিষয়ক এই গবেষণামূলক পর্বে মোট ১৪টি রচনার মধ্যে ১২টিই অসমের সাহিত্য বিষয়ক। একটি করে রচনা রয়েছে মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের বাংলা সাহিত্য নিয়ে। অসমের সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলোর মধ্যেও আছে তিনটি ভাগ। ৮টি রচনা বরাক উপত্যকার বাংলা সাহিত্যের উপর, তিনটি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উপর এবং একটি রচনা সার্বিকভাবে আসাম রাজ্যের লেখালেখি বিষয়ক। এছাড়াও পাঠকের রসাস্বাদনের নিমিত্তে রয়েছে তিনটি ছোটগল্প। পেপারব্যাকে এভাবেই সেজে উঠেছে বিশাল ২৩৩ পৃষ্ঠার সাড়া জাগানো পত্রিকার এই সংখ্যাটি।
সম্পাদকীয় থেকেই স্পষ্ট যে এবারের সংখ্যায় আসামের সাহিত্য চর্চাই প্রাধান্য পেয়েছে কারণ অন্য দুই রাজ্যের বাংলা পঠনপাঠন এবং চর্চার পরিসর সীমিত হতে হতে আজ প্রায় নিঃশেষিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই আক্ষেপ লুকিয়ে রয়েছে সম্পাদকের অন্তরে। পাশাপাশি লেখকদের থেকে সময়মতো লেখা না পাওয়ার ব্যথাও স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়েছে। সম্পাদকীয়তে বেশ কিছু জায়গায় যতি চিহ্নের ক্ষেত্রে ‘?’ এর জায়গায় (!} এর প্রয়োগ দেখা যায়।
এক একটি বিষয়ের উপর অঞ্চলভিত্তিক প্রতিবেদনমূলক অধিকাংশ রচনাই পরিসরের অভাবে সীমিত আকারে লিখা হয়েছে বলে লেখকদের বয়ানে স্পষ্ট। তবে সব ক’টি প্রবন্ধেই যথাসম্ভব তথ্যাদি সন্নিবিষ্ট করে পাঠকের দরবারে পেশ করার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সব রচনাকার। বরাক উপত্যকার কবি ও কবিতার কথা পর্বে কলম ধরেছেন লেখক কবি রূপরাজ ভট্টাচার্য। এখানে লেখক স্পষ্টতই জানিয়েছেন যে এ রচনা সার্বিক নয়, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই সীমিত। বরাক উপত্যকার প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে ছোটগল্প চর্চা নিয়ে এবং বরাক উপত্যকার সূচনা পর্বের উপন্যাস সাহিত্য নিয়ে দু’টি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং লোক-গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য। বরাক উপত্যকার বাংলা ছোটগল্প ও গল্পকার - একটি সংক্ষিপ্ত চালচিত্র লিখেছেন সুমিতা ঘোষ। বিশ পৃষ্ঠার এই প্রথম পর্বে বেশ ক’জন গল্পকারের গল্প নিয়ে রয়েছে চুলচেরা আলোচনা। গবেষক, সাহিত্যিক ইমাদউদ্দিন বুলবুল সংক্ষিপ্ত রূপরেখায় তুলে ধরেছেন বরাকের উপন্যাসের কথা। তথ্যাবলি যথেষ্ট সমকালিক। উপত্যকার লোককথার রূপ ও বৈচিত্র্যের উপর আছে সূর্যসেন দেব-এর একটি নিবন্ধ। সুতপা চক্রবর্তী লিখছেন বরাক উপত্যকার এই সময়ের বাংলা কবিতার প্রবণতা নিয়ে। বরাক উপত্যকার প্রথম উপন্যাস ‘নারীশক্তি বা অশ্রুমালিনী’র উপর লেখক গবেষকদের দৃষ্টিকোণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন সম্পাদক আশিসরঞ্জন নাথ।
পরবর্তী পর্বে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কবি ও কবিতার উপর কলম ধরেছেন ড. সুদীপা ভট্টাচার্য। এ রচনাও একটি নির্দিষ্ট সময়ের অধীন। ‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা গল্প চর্চার আখ্যান’ শিরোনামে বিস্তৃত প্রতিবেদনমূলক যে রচনাটি লিখেছেন লেখক সঞ্জয় দে তাতে সাময়িক কাল অবধি বিস্তৃত সূচি অনুযায়ী তথ্যাদি সন্নিবিষ্ট করতে যথেষ্ট যত্নের পরিচয় পাওয়া যায়। আসামের বাংলা উপন্যাস নিয়ে সৌম্যদীপ দেব-এর রচনায় পূর্ণাঙ্গ তালিকা তুলে ধরেছেন যা নিশ্চিতই এক দলিলসম। হাল আমলের প্রকাশিত উপন্যাসসমূহকে তালিকাবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন এই প্রাবন্ধিক। কিন্তু এ সৃষ্টিযাত্রা তো অবিরত। তাই লেখা পাঠানো থেকে পত্রিকা প্রকাশের সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত হতে থাকে নতুন সৃষ্টি। সুতরাং তালিকা কখনও পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে লেখকের করার কিছুই থেকে থাকে না। জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত লিখেছেন ‘আখ্যানের সন্ধানে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা উপন্যাস’। একটি আলোচনামূলক নিবন্ধ।
মণিপুরের বাংলা সাহিত্যের উপর ব্রজকুমার সরকারের লিখিত রচনায় ধর্মকথা বেশি এসেছে, সাহিত্যের হালহকিকত কম। বাংলা লিপির কথা উল্লেখিত হয়েছে সবিশেষ কিন্তু বাংলা লেখালেখির কোনও আশাব্যঞ্জক খবর এখানে নেই। যা নেই তা থাকার কথাও নয়। নাগাল্যান্ডের বাংলা সাহিত্য নিয়ে প্রয়াত দেবাশিস দত্তের রচনাটি পূর্বপ্রকাশিত যদিও এর সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। বস্তুত লেখকের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে নাগাল্যান্ডের বাংলা সাহিত্য চর্চার শেষ প্রদীপটিও হয়ত নির্বাপিত হয়েছে। সংযোজনে এমন আশঙ্কার কথাই তুলে ধরেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
গল্প বিভাগে তিনটি গল্প লিখেছেন সমরজিৎ সিংহ, সংযুক্তা দাশ পুরকায়স্থ এবং মিতা রায়। সব ভালো যার শেষ ভালো। মিতা রায়ের গল্পে এক ভালো লাগার অনুভব ছড়িয়ে পড়ে পাঠক মনে।
তথ্যমূলক নিবন্ধাদিতে লেখকরা যতই সচেষ্ট হন না কেন কিছু তথ্য প্রায়শ অনুল্লেখিত থেকে যায়। কারণ তথ্যের প্রচার যথাযথ ভাবে হয় না এবং তা জনসমক্ষে আসে না যথা সময়ে। উপরোক্ত গবেষণামূলক রচনার বহু ক্ষেত্রেই সেটা হয়েছে।
গল্প বিভাগে শুরু হয়েছে কিছু ছাপার ভুল। অন্যথা প্রবন্ধ বিভাগ যথার্থই নির্ভুল। সব মিলিয়ে গবেষণামূলক রচনার মাধ্যমে এ সংখ্যা ‘প্রবাহ’ও আগেরই মতো চিরন্তন উৎকৃষ্টতার ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছে তা অনস্বীকার্য। মুদ্রণ যথাযথ। অজিত দাশ এর প্রচ্ছদ বরাবরের মতোই স্বচ্ছ, সার্থক।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

মূল্য - ২৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮১১০১০৫৪০

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...