Skip to main content

প্রতিবাদী কবিতার সুবিন্যস্ত সংকলন ‘নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে’


... পথও কখনো কখনো পথ বদলায়
এর পথ হঠাৎ বেঁকে তার পথে মেশে
চড়াই উতরাই পেরিয়ে ওর পথের
পেটে ঢুকে যায় তার পথ
 
এভাবে দরজা জানালা বেডরুম
কলিংবেল ছিটকিনি ভাতঘুম
অদলবদল হয়।
 
শেষে একই শব্দে জ্বলে আমকাঠ
কিংবা সাড়ে তিন হাত মাটির চাদরে
শরীর ঢেকে - নৈঃশব্দ্যের ভেতর
শব্দরা ঘুমিয়ে পড়ে।
গ্রন্থের প্রথম কবিতা - ‘শব্দের ভেতর’-এ কবির এভাবেই যে ঢুকে পড়া সগর্বে, সপাটে, কাব্যিকতাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ধারা আদ্যোপান্ত বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন একইভাবে। কবি তারাপ্রসাদ বণিক শুধু ত্রিপুরার কবি নন। বস্তুত কবি লেখকরা আঞ্চলিক হতে পারেন না। তাঁরা বিশ্বনাগরিক। তাই তো তারাপ্রসাদের কবিতায় গঙ্গা যমুনা গোমতীর সাথে মিশে থাকে ব্রহ্মপুত্র ডিহিং-এরও প্রবহমানতা। শব্দের মতো, কবিতার ফল্গুধারার মতো।
৭২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে আছে মোট ৫৬ টি কবিতা। ব্যতিক্রমী তার ভূমিকা। ‘স্বীকারোক্তি’ শিরোনামে ভূমিকায় কবিতার শরীরে ব্যক্ত করেছেন আত্মকথা -
‘আজন্ম আপাদমস্তকে মেখেছি
মর্মে মথিত এ মাটির স্নেহ-স্পর্শে
জন্ম জন্মান্তরের গূঢ় লেনদেন। ... ’
কবির সপাট উচ্চারণ -
‘কবিতার বুকে আশ্রিত হই নিরন্তর ...
নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে কবিতা নয় শুধু
এ ক্রম-ক্ষীয়মান আত্ম-জিজ্ঞাসার
তীক্ষ্ণতর নৈবেদ্য।’
‘নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে’ গ্রন্থটিতে একের পর এক কবিতা জুড়ে ভেসে উঠেছে সেই আত্ম-জিজ্ঞাসা, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে ক্ষয়িষ্ণু মানবতার বিরুদ্ধে সোচ্চার শব্দশর। গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতাই পূর্ণপৃষ্ঠার। রয়েছে একাধিক পৃষ্ঠাজোড়া কিছু কবিতাও। অর্থাৎ শব্দেরা স্বতঃস্ফুর্ত প্রয়োজনে চলে আসে কবির অধিকারে আর কবি নিমগ্নতায় ধরে রাখেন তাদের একান্ত আপন করে। মূলত অব্যবস্থা, ক্ষয়িষ্ণু সমাজের বিরুদ্ধেই সোচ্চার কবি যদিও এসেছে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গও। দেশভাগ ও তার যন্ত্রণাও এসেছে একাধিক কবিতায় যদিও এখানে সার্বিক প্রতিবাদ যেন ফুটে ওঠেনি কবিতায়। কবির নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতায় ধর্মোন্মাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারিত হলেও দেশভাগের কবিতায় তা দেখা যায় না।
ছন্দহীন কবিতার মধ্যেও কবির কলমে ফুটে ওঠে এক চোরা ছন্দ যা কবিতা পাঠে এনে দেয় সাবলীল ঔৎসুক্য। কিছু কবিতা তাই বিশেষোল্লেখের দাবি রাখে নিশ্চিত। যেমন - যোদ্ধা, ভারতবর্ষ তবুও, আলোয় এসে দাঁড়ায়, উদবাস্তু এবং অতি অবশ্যই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ কবিতা - দীর্ঘ কবিতা - নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে। ছয় পৃষ্ঠা জোড়া কবিতা ‘যোদ্ধা’য় কবি বলেছেন অনেক কথা -
‘সব কথা জমিয়ে রেখেছি
একদিন তোকেই বলব অবিনাশ।
একেকটি মানুষের মধ্যে
কত লোকের বসবাস...
সূর্য পুবে থাকতে দেওয়া কথা
পশ্চিমে ঢলতেই
অজ্ঞাত অতীত করে গ্রাস...
চল অবিনাশ অন্য কিছু করি
চাঁদ ফুল পাহাড় নদী
সমুদ্র আকাশ সব পালটে ফেলি......।’
এভাবেই কবিমন হয়ে ওঠে উতলা, প্রতিবাদী। ‘নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে’ একটি স্বতন্ত্র ধারার কাব্যগ্রন্থ। এ ধারায় নেই কোনো জটিলতা কিংবা অবোধ্য শব্দসন্ধান। তবে রয়ে গেছে কিছু তৎসম শব্দের বাড়বাড়ন্ত - যদিও অপ্রাসঙ্গিক কিংবা বেমানান নয় আদৌ। সার্বিকতায় কবিতার মায়াবী শরীরে কবি এঁকে দিয়েছেন সহজ সপাট মুক্ত-শব্দের চিরস্থায়ী চিত্রপট।
অমর মিত্র-র প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক হলেও যথেষ্ট স্বচ্ছ, স্পষ্ট হয়নি। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘পিতা ব্রজলাল বণিক-এর স্মৃতিতে’। আগরতলার সৈকত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের অক্ষর বিন্যাস তথা ছাপাই ও বাঁধাই যথাযথ হলেও রয়ে গেছে কিছু বানান ভুল - যদিও বাহুল্য নেই। সব মিলিয়ে ‘নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে’ এক সুখপাঠ্য প্রতিবাদী কবিতার সুবিন্যস্ত সংকলন।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘নির্বাসিত ঈশ্বরের দেশে’

তারাপ্রসাদ বণিক
মূল্য - ১২০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮৩৭৩৯৯২৮৯

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়