Skip to main content

আত্মপ্রকাশেই পাঠক হৃদয়ে উদ্ভাসিত ‘লোকসংস্কৃতি’


লোকসংস্কৃতি হল সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত তাদের চিন্তায় ও কর্মের ঐতিহ্যানুসারে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্টীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও অনুষ্ঠান, জীবন-যাপন প্রণালি, শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সংস্কৃতিঅধ্যাপক ড. তুষার চট্টোপাধ্যায় তাঁর লোক সংস্কৃতির তত্ত্বরূপ ও স্বরূপ সন্ধানগ্রন্থে লোকসংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন - ‘লোকসংস্কৃতি লোকায়ত সংহত সমাজের সমষ্টিগত প্রয়াসের জীবনচর্যা ও মানসচর্চার সামগ্রিক কৃতি’
সম্প্রতি নবগঠিত ‘জাতীয় লোকসংস্কৃতি পরিষদ, কলকাতা’ থেকে আত্মপ্রকাশ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন - ‘লোকসংস্কৃতি’। সম্পাদনায় আছেন অমিত চট্টোপাধ্যায় (কলকাতা), অহীন্দ্র দাস (আসাম) ও মন্টু দাস (ত্রিপুরা)। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই একটি জাতীয় পরিচিতির আভাসচমৎকার একটি প্রচ্ছদ প্রথমেই দৃষ্টি কেড়ে নেয় পাঠকের যদিও এ নিয়ে কিংবা প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম উল্লেখ করা হয়নি কোথাও। তবে গ্রামীণ উৎসবাদিতে এ ধরনের শৈল্পিক চিত্রের দেখা পাওয়া যায় আলপনা হিসেবে। সেদিক দিয়ে বলতে হয় এক প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ। লোকসংস্কৃতির উদ্ভাবন হয় না, আবিষ্কার হয়। নিত্য নতুন এই আবিষ্কার ও তার প্রচার, প্রসারের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ মানুষের গভীর আস্থা ও প্রত্যয়ের বার্তা সম্বলিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে - ‘...... দীর্ঘ আলাপ আলোচনা ও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর, জনসমক্ষে ‘লোকসংস্কৃতি’কে বিশেষ রূপে তুলে ধরে আমরা প্রমাণ করতে চাইছি, এর যাত্রাপথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে...। মানুষের আঞ্চলিক কথা, মানুষের পুরোনো দিনের হারিয়ে যাওয়া কথা তো বটেই, বর্তমান সময়ে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ‘লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য’ যেখানে চর্চার বিষয়বস্তু, তা তো অন্ধকারে হারিয়ে যেতে পারে না, তাকেই বরং গভীর যত্নে লালিত পালিত করবে এ সংস্থা ... এ বিশ্বাস, ভরসা আমরা রাখি।’
২৩৭ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক মোট ৩০টি মূল্যবান নিবন্ধ যার শ্রীগণেশ হয়েছে বিশিষ্ট সাহিত্যিক পবিত্র সরকারের নিবন্ধ ‘নাগরিক লোকসংস্কৃতি’র মাধ্যমে। বলা যায় এক অতি অসাধারণ এবং ব্যতিক্রমী নিবন্ধ। ১৮ পৃষ্ঠার এই নিবন্ধে নিবন্ধকার যেন লোকসংস্কৃতিকে প্রথাগত গ্রামীণ আওতার গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক নতুনতর কনসেপ্টে উপস্থাপন করেছেন। নাগরিক জীবনেও যে লুকিয়ে রয়েছে কত লোকসংস্কৃতি তার ধারাবাহিক হদিশ দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মন। বহু অজানা তথ্যে ভরপুর এই নিবন্ধ যেন লোকসংস্কৃতির উপর এক ব্যতিক্রমী ধারার দলিল।
লালন সাঁইয়ের গানের উপর বিস্তৃত নিবন্ধ লিখেছেন প্রাবন্ধিক বরুণ কুমার চক্রবর্তী। শিরোনাম ‘পতিত পাবনের উদ্দেশে লালন’। আজকের গ্রাম্য জীবনযাত্রায় লোকসংস্কৃতির অপসৃয়মান অবস্থার প্রেক্ষিতে লক্ষণ কর্মকার লিখেছেন - ‘লোকসংস্কৃতি; এই সময়ের গ্রামজীবন’। ত্রিপুরায় তথা সার্বিক ক্ষেত্রে চড়ক বা গাজনের বিষয়ে সবিশেষ তথ্য সহকারে জহর দেবনাথের নিবন্ধ ‘গাজন উৎসবের ইতিকথা’ এবং শ্রীহট্ট ও বরাক-ত্রিপুরার ভট্ট সংগীত নিয়ে মন্টু দাসের ইতিহাসাশ্রিত তথ্যাদি সম্বলিত নিবন্ধ এই সংকলনের অন্যতম সম্পদ। গোপাল চন্দ্র দাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে এনেছেন ‘শ্রীহট্ট জেলার মৌলভীবাজার অঞ্চলের প্রাচীন লোক-চিকিৎসা ও তন্ত্রমন্ত্র সাহিত্য’কে। অন্যতম সম্পাদক অমিত চট্টোপাধ্যায় ‘ঝাড়খণ্ডের লোকসংগীত’ নিবন্ধে লিপিবদ্ধ করেছেন বহু তথ্য, বহু প্রাসঙ্গিক কথা। তবু যেন মনে হয় অধিক বিস্তৃতির অবকাশ ছিল। ‘লোককথায় দ্বন্দ্ব ও দণ্ড - একটি রম্য পাঠ’ নিবন্ধে ডঃ নির্মল দাস তুলে ধরেছেন লোকসংস্কৃতি গবেষণার ধারাকে। টাইপ মোটিফ ইনডেক্স, ট্যাবু আদি অপেক্ষাকৃত স্বল্পশ্রুত, স্বল্পপঠিত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ পাঠক, গবেষকদের জন্য এক মূল্যবান সংযোজন।
গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি নিবন্ধই বিস্তৃত ভাবে আলোচনায় উঠে আসা উচিত ছিল যদিও পরিসর সেই সুযোগ না দেওয়ায় নামোল্লেখেই সারতে হবে দায়। উপর্যুক্ত নিবন্ধ সমূহের বাইরেও রয়েছে বহু সুচিন্তিত, সুলিখিত নিবন্ধ। লিখেছেন নির্মল দেবনাথ - ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঁশভিত্তিক লোকসংস্কৃতি’, অরুণ কুমার সেন - ‘ধামাইলের জনক রাধারমণ’, বৈশাখী কুন্ডু - ‘বাংলার শাস্ত্রীয় নৃত্য শৈলী - গৌড়ীয় নৃত্য’, সুপ্তা দাস - ‘বাংলার লোকসংস্কৃতিতে সূর্যব্রত’, হৃষিকেশ নাথ - ‘তিননাথ’, তাপসী ভট্টাচার্য - ‘কিছু জানা অজানা লোকসংস্কৃতি’, এইচ এস সরোয়ারদী - ‘বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য’, চৈতন্য ফকির - ‘গাজন উৎসব’, সুনীল কুমার সাহা - ‘হিন্দু বাঙালিদের বারো মাসের তেরো পার্বণ’, ক্রাইরী মগ চৌধুরী - ‘মগ লোকসংস্কৃতি - কিছু তথ্য’।
‘বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত কথকতা’ - আব্দুর রফিক খান, ‘ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতি - উন্নয়নের পথ’ - অমরেন্দ্র শর্মা, ‘বিপদনাশিনী ব্রত’ - নিভা চৌধুরী, ‘হারিয়ে যাওয়া বাংলার লোকসংস্কৃতি’ - রূপ কুমার পাল, ‘লোকসংস্কৃতিতে বাঁশ’ - অশোকানন্দ রায়বর্ধন, ‘লোকসংগীতে ঝুমুর’ - কল্যাণী সান্যাল, ‘লোকসংস্কৃতি ও নগরায়নের প্রভাব’ - শৈলেন সাহা, ‘ব্রতে কর্মাদি ঠাকুর ব্রতকথা’ - অহীন্দ্র দাস।
এরপর রয়েছে বিশিষ্ট লোকগবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্যের ‘উত্তরপূর্ব ভারতের তিনটি লোককথায় মানবী-সর্প বিবাহ - কল্পনা না মৌখিক ইতিহাস ?’, অরূপ কুমার ভূঁঞার ‘গ্রাম্য জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতি’, সোমা চট্টোপাধ্যায়ের ‘গ্রাম্যজীবন ও লোকসংস্কৃতি’ এবং ডঃ রঞ্জিত দে’র ‘দক্ষিণ ত্রিপুরার লোক উৎসব ও পরব পার্বণ’।
একাধিক নিবন্ধ তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর এক একটি সুখপাঠ্য এবং অবশ্যপাঠ্য রচনা। গ্রন্থের প্রকাশক ও মুদ্রক - কালজয়ী, হাওড়া। কাগজ, ছাপা ও পেপারব্যাক বাঁধাইয়ের মান উন্নত। শব্দ, অক্ষরবিন্যাস যথাযথ। কিছু নিবন্ধ অধিক বিস্তৃতির দাবি রাখে। পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে বানানের শুদ্ধতার উপর অধিক মনোযোগের প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে পাঠকের মনোজানালায় লোকসংস্কৃতির অন্দরে লুকিয়ে থাকা চমৎকারিত্বের এক অচেনা অজানা জগতকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে ‘লোকসংস্কৃতি’ - এ কথা বলা যায় হলফ করেই।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

 

মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - অনুল্লেখিত 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়