Skip to main content

স্বচ্ছ অনুবাদের কাব্যগ্রন্থ 'হৃদয়ের বালুচর'


হৃদয়ের বালুচর বইটি একটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ অসমের দ্বিভাষিক কবি, আবৃত্তিকার, অনুবাদক জয়িতা চক্রবর্তীর দ্বারা অনূদিত এই বইটি অসমের প্রখ্যাত কবি যোগেশ বিকাশ গগৈ মহাশয়ের প্রায় পঁয়তাল্লিশটি অনন্য কবিতার সংকলন - ‘সোনোয়ালি মাছ, রূপোয়ালি ঢেউ’-এর নতুন সাজ এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রতিটি কবিতায় রয়েছে নিজস্ব বিচক্ষণতা, মানবতা ও ভালোবাসার অনন্য পৃথিবী কবিতাগুলোতে যে পৃথিবীর সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে রয়েছে নির্জনতা, শান্তি, পবিত্রতা, প্রেমের পূর্ণতা কবি দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ জিনিসগুলোর বিষয়কে বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যেমন - বৃষ্টি, শ্রাবণের প্রেম, নতুন পৃথিবী, জীবন, স্বাদ, শ্রমিক ইত্যাদি এই বইটিতে একজন ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনের ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোতে জীবন শক্তি খুঁজে পেতে পারেন প্রত্যেকটি সারিতে রয়েছে অনন্য নিষ্পাপ মানব সভ্যতাকে খোঁজার তাড়না যেখানে বড় কিংবা ছোট, প্রতিটি জীবন কারো অপকার না করে একসাথে বাস করতে পারবে খুব সাবধানতার সঙ্গে অসমের জীবন্ত শহরের ছবি চিত্রিত করা হয়েছে যেখানে প্রতিটি নাগরিক বাঁচে, ভালোবাসে ও জীবনের সুগন্ধ উপভোগ করে বইটি মানব সভ্যতার একটি নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি করেছে এবং পাঠকেরা বইটি পড়ে এক অনন্য কাব্যিক, কিটসের সৌন্দর্যের শব্দে ভরা পৃথিবীতে যাত্রা করবে
না, এটি আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা নয় এটি একটি শুভেচ্ছা বার্তা লিখেছেন সাহিত্যিক, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ রতন ঘোষ পুরো বার্তাটিই এখানে তুলে ধরা হল এজন্য যে এই বার্তাটি বলতে গেলে ভূমিকা হিসেবে পুরো গ্রন্থের নির্যাসটাই যেন ধরে রেখেছে অনুবাদক জয়িতা চক্রবর্তী, যিনি একাধারে অসমিয়া ও বাংলা উভয় ভাষাতেই রচনা করেন সাবলীল কবিতা, তিনিও নিয়ম করে লিখেছেন ভূমিকা। তাঁর ভাষায় - ‘কবিতা হল নান্দনিক অনুভব, শ্রেষ্ঠতম উপলব্ধি।’ আলোচ্য অনুবাদ গ্রন্থটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। অনুবাদ কেন ? এ প্রশ্নের উত্তরও আছে ভূমিকায় - ‘হৃদয় হতে হৃদয়ে মিলনের বার্তা দেয় কবিতা। ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে সমন্বয়ের সেতুবন্ধন হয় কবিতার মাধ্যমে।
আধুনিক অসমিয়া কবিতার গঠন সাধারণত কিছুটা ভিন্নধর্মী হয়, যেখানে শব্দসংখ্যা কম এবং পঙক্তিসংখ্যা বেশি। আলোচ্য গ্রন্থটিও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বল্পসংখ্যক শব্দের সমাহারে রয়েছে চার পঙক্তি থেকে শুরু করে দুই পৃষ্ঠাজোড়া কিছু কবিতা যেখানে কবির অসাধারণ শব্দচাতুর্যে ধরা রয়েছে অসমিয়া জনজীবন ও সমাজচিত্রের এক গুচ্ছ কোলাজচিত্র। অসমিয়া এবং বাংলা উভয় গ্রন্থনামের শিরোনামসমৃদ্ধ রয়েছে দুটি কবিতাও যেখানে কবি তাঁর ইচ্ছেগুলোকে মেলে ধরেছেন অন্য সব কবিতার মতোই। সোনালি মাছ রূপালি ঢেউ কবিতায় কবি লিখছেন -
মানব সাগরে হৃদয়ের বাঁধনে
কবিতার নৌকো গড়েছি,
রূপালি ঢেউয়ে খেলা করে
সোনালি মাছ ধরেছি......।
কবিতার শুরুতে কবি লিখছেন - সাঁতরে বেড়াচ্ছি আমি/ মানবতার নদীতে/ দাঁড়ও টামছি নিজেই/ কাণ্ডারি হয়ে।/ কবিতা গাইছি/ মানুষের মুক্তির জন্য/ নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে/ ব্রহ্মাণ্ডের অলিতে গলিতে। বাস্তবেই কবি তাঁর অধিকাংশ কবিতায় মানুষের কথাই লিখতে চেয়েছেন। তুলে এনেছেন পারিপার্শ্বিকতা আপন চোখে দেখা জগতের নানা অনুষঙ্গে। মাটির গন্ধ ছড়িয়ে আছে তাঁর কবিতার শরীরে। ঝাকি জাল থেকে সন্ধ্যা প্রদীপ, নটে শাক থেকে চালতার টক-ই কবির অনুষঙ্গ। মানুষের কবি যোগেশ গগৈ কবিতায় প্রত্যয় রেখেছেন এক নূতন কবিতা-বিশ্ব গড়ে তোলার। তাই কবি লিখেন - এক আকাশ, একই মাটি/ এটিই সুন্দর ধরণী।/ পারি না নাকি গড়তে আমরা/ একটি নতুন পৃথিবী ? (কবিতা - নতুন পৃথিবী)। কিংবা - যে কারণে/ বেঁচে আছি/ সে কারণেই লিখি। ...... হয়তো আমিও ছেড়ে যাব/ আমার না দেখা/ কারোর জন্য/ একটি নতুন পৃথিবী। (কবিতা - একটি নতুন পৃথিবী)।
আবার এই ‘কারো’র সূত্র ধরেই কবির একাধিক কবিতায় আবিষ্কৃত হয় এক অদেখা অজানা ‘তুমি’। যে ‘তুমি’কে উদ্দেশ্য করে লিখা হয়েছে একাধিক কবিতা। বহু কথা, প্রতিশ্রুতি, বহু আশা আকাঙ্ক্ষার কথা আছে এই ‘তুমি’কে ঘিরে। উল্লেখ্য তাঁর ‘আছড়ে ভাঙো ফলক’, ‘ঝুলিতে রামধনু’, ‘সম্বন্ধ’, ‘আহ্বান’, ‘নিজস্ব পথ’ আদি কবিতা। এই তুমিকে উন্মোচিত করার দায় না হোক তোলা থাক পাঠকদের পাঠমগ্নতায়ই।  
প্রথম অনুবাদকর্মেই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন অনুবাদক জয়িতা। কোথাও মূল শব্দ এসে জটিলতার সৃষ্টি করেনি। এটাই অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যতি চিহ্নের অনাবশ্যকতা এবং গোটাচারেক বানান ভুলের বাইরে বলা যায় এক স্বচ্ছ অনুবাদের কাব্যগ্রন্থ।
৬০ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৫ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৪৩টি কবিতা। স্পষ্ট ছাপাইয়ের কাজ। বর্ণ, অক্ষর ও শব্দের যথাযথ সংস্থাপন ও বিন্যাস। প্রাসঙ্গিক আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের সৌজন্যে নবজ্যোতি ভট্টাচার্য। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর বাবা কৃষ্ণ চূড়ামণি চক্রবর্তী ও মা দীপ্তি চক্রবর্তীকে।  পরিশেষে গ্রন্থনাম ‘হৃদয়ের বালুচর’ শীর্ষক কবিতায় খুঁজে নেয়া যাক কবিতা ও অনুবাদ উভয়েরই উৎকর্ষ -
জীবন নদীর উর্বর বালুচরে
তুমি আর আমি।
ফেনা তুলে তন্ন তন্ন করে দেখব,
কাশবনে ঢেকে রাখব,
লজ্জায় মুখ লুকাব
পাশের বালুচরে।
 
বকুল তার বাউলের সুর তুলবে,
বুকের মালতীকে খুঁজে।
বিচ্ছিন্ন স্রোতে প্রাণ পাবে
সবুজ হবে লুইতের বালুচর।
লুইত কন্যা ও বরাক বধূ জয়িতার এই সমন্বয়ের প্রচেষ্টায় আরো আরো অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে সবুজ হবে লুইত ও বরাকের বালুচর এমন প্রত্যাশা করাই যেতে পারে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২০০ টাকা

যোগাযোগ - ৬০০১৪১৮৯১৩

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...