Skip to main content

ফিরে দেখা ভাবনার বিন্যস্ত প্রকাশ ‘অদেখা জলস্রোত’


মাত্র আড়াইতম কাব্যগ্রন্থ’ - কিছু লিখতে গিয়ে এই শব্দগুচ্ছটি প্রথমেই নিজর কাড়ল অথচ এটা লেখা আছে ৬৮ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক কাব্যগ্রন্থঅদেখা জলস্রোত’-এর শেষ মলাটে, পরিচিতি হিসেবে যেমন আছে পরিচিতি হিসেবে তা হুবহু তুলে দেওয়া যায়… ‘অর্ধশতক আগে কবিতা লেখার শুরু দীপক চক্রবর্তীর মাঝে দুই দশক (দুই দশক ??) কলম তুলে রেখেছিলেন তবুও, মানা যায় না যেন, ‘অদেখা জলস্রোততাঁর মাত্র আড়াইতম কাব্যগ্রন্থ নিজেকে গুটিয়ে রাখা পছন্দ কবির (সে তো বটেই, নাহলে দুই দশক কেউ কলম গুটিয়ে রাখেন ??) গল্প লিখেছেন বেশ কিছু, বই হয়ে বেরোয়নি আগে এই আড়াল গড়ে তোলার প্রবণতা কবির চরিত্রকে প্রকাশ করে - যা প্রতিফলিত তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিতে
কবির পূর্ব প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা দেখে বোঝা গেল এইআড়াইতমশব্দটির অর্থ দুটি একক এবং একটি যৌথ গ্রন্থ রয়েছে তাঁর, এই অর্থে আড়াইতম ব্লার্ব হিসেবে শেষ প্রচ্ছদের এই পরিচিতি সম্ভবত প্রকাশক - সৈকত প্রকাশন, আগরতলার পক্ষ থেকে ৬২টি পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে কবির ৬০টি কবিতা বড্ড তাৎপর্যময় গ্রন্থনামঅদেখাঅর্থে আমরাফিরে দেখাও বলতে পারতাম কিন্তু কবিতাগুলি পাঠ করে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলি কি সত্যিকার অর্থে ধরা দিয়েছে মননের মুঠোয় ? নাকি এক স্বপ্নবিভোর ছন্নছাড়া বালকের মতো অদেখাকে দেখার চেষ্টাতেইজলস্রোত’-এর মতো ছড়িয়ে পড়েছে একের পর এক কবিতার স্রোত ? সেই চেষ্টাতেই খানিকটা আলোচনা হোক নাহয়
অস্থিরতা আমার জন্মজড়ুলের মতো লেগে আছে
আমার কবিতায় কোনও স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তি নেই
কোনও কালজয়ী ভাবনা বা বক্তব্য নেই,
সাজানো ফুলবাগান নেই
আমার কবিতায় ছন্নছাড়া এক স্বপ্ন-বিভোর বালক
ঘুরে বেড়ায় (কবিতা - অদেখা জলস্রোত)
গ্রন্থনামের এই কবিতাটিতে কবি নিজেকে বোঝাতে গিয়েই আবার লিখছেন -
তোমাকে বোঝাতে পারিনি কিছুতেই
মাথার ভেতরে এক অদেখা জলস্রোত
আততায়ীর মতন ঘুরে বেড়ায়
এই যে খুঁজে দেখা, নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার প্রচেষ্টা তা-ই জলস্রোতের মতো খেলা করে বেড়িয়েছে একের পর এক কবিতার স্তবকে স্তবকে সপাট সহজ কথার সঠিক উপস্থাপনায় ফিরে দেখার আকুল ভাবনাগুলো যেন ঠিকরে বেরিয়েছে মোক্ষম হয়ে গ্রন্থের অন্তর্গত কিছু কবিতা যেন উৎকর্ষের মাত্রা সপ্তমে পৌঁছেছে শব্দের যথাযোগ্য প্রতিস্থাপনে উল্লেখযোগ্য তেমনই কিছু কবিতা - বেহায়া লেখালেখি, খরা, সে গেছে, পয়লা তারিখ, শব্দের ঘেরাটোপ, শেকড়ের কাছে ইত্যাদি কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত না হলে ঠিক বোঝা যাবে না -
তোমায় আমি নামিয়ে আনি মিনার থেকে…… মধ্যরাতে
রাত্রি যখন ঘুমিয়ে থাকে ভুবন জাগে
সুবাস লাগে হাওয়ায় হাওয়ায়
তোমায় যখন মানুষ ডাকে ভিন্ন নামে
আমার তখন শব্দ খরায় দহন লাগে (কবিতা - খরা)
 
শব্দের ঘেরাটোপে কতবার হারিয়েছি তোমাকে
তোমার বুকে মুখ রেখেছি, তবু শূন্য রইল বুকের গভীর -
তোমার কাছে রাত্রি যাপন সমস্ত ক্ষণ জ্বললো আগুন
সমস্ত ঋণ ছাই হয়েছে কুসুম গন্ধ
অন্ধ যেমন হাতড়ে বেড়ায় শব্দ ঘেঁটে
শব্দ সীমা ছাড়িয়ে যখন অনেক দূরে
উপমাবিহীন শাড়ির আঁচল ওড়াও তুমি
শীত-বিকেলে তোমার চিঠি তখন আসে (কবিতা - শব্দের ঘেরাটোপ)
 
কোনও ভূমিকাবিহীন এই গ্রন্থের অন্তর্গত অধিকাংশ কবিতাই ক্রমানুসারে ২০০০ সাল থেকে লেখা সাম্প্রতিক সময় অবধি প্রায় প্রতিটি কবিতা জুড়েই কবির এক সুতীব্র অন্বেষণ, দেখা না-দেখার আড়ালে এক ফিরে দেখা আর কবি ও কবিতার বিনয় কবিতার শরীরে একাধারে মিশে আছে অন্তর্নিহিত এক ছন্দ-সুষমা ছন্দহীনতার ছন্দে উঠে এসেছে দহন-যাপন, শ্লেষ, রূপক, অতীত যাপন, ইচ্ছেনদীর নৌকো বাওয়া আর দহনের দিনলিপি কবিতার পাঠ শুরু করলে কেমন এক ঘোর এসে দানা বাঁধে পাঠশেষে অদেখা, অচেনা কিংবা একেবারেই কোনও এক পরিচিত ছবির সঙ্গে আলাপনসূচক বহু কবিতা, সেখানে স্মৃতিরা এসে বলে গেছে বহু কথা প্রকাশিত হয়েছে বিকেলের ভাবনা ধরে রেখেছেন সমকাল রয়েছে সমকালিক কবি, পাঠক আলোচক এমনকি নিজের উদ্দেশেও এক অভাবিত নির্মোহ বার্তা -
এমনকি তুমিও বলে দাওনি
ধবধবে সত্যতার মাঝখানে কোথায় দাঁড়াবো
বলে দাওনি কোনটা পয়ার, কোনটা সনেট
আমি তাই লিখে চলেছি মাথামুণ্ডুহীন
ছাইপাঁশ লিখে চলেছি
এমনকি ক্রিটিকের ছুরির তলায় দেবারও যোগ্য নয়
তা হোক,
কোনোদিন ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে চলে এসো
শ্রমক্লান্ত বিকেলে ঘামে ভেজা তুমি
সমূহ কর্মক্ষেত্র থেকে চলে এসো কোনোদিন
বেহায়া লেখালেখির মাঝখানে
হাওয়ায় তোমার শাড়ির ছেঁড়া আঁচল উড়বে,
ক্রিটিকের মুখের উপর তুড়ি মেরে আমাদের
মিছিল বেরোবে কাব্যের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে (কবিতা - বেহায়া লেখালেখি)
এরপর আর আলোচনা এগোতে পারে না কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেনযাঁরা আমাকে ভালোবেসেছে, ভালোবাসেনি যাঁরাকে বস্তুত তাঁদের উদ্দেশে রয়েছেসম্পর্কশিরোনামে একটি কবিতাও প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ এঁকেছেন তপস্বিনী দে স্পষ্ট, ঝরঝরে ছাপা, বিন্যস্ত অক্ষর, শব্দ ও পঙ্ক্তিবিন্যাস যদিও কবিতাগুলোর শিরোনাম খানিকটা বড় হরফের হলে অধিক শোভনীয়, পঠননন্দন হতো সামান্য কয়েকটি বানান, কয়েকটি ছাপার ভুলের বাইরে আদ্যোপান্ত এক কাব্যিক উৎকর্ষের কাব্যগ্রন্থ - ‘অদেখা জলস্রোত

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

 

মূল্য - ১২০ টাকা
যোগাযোগ - অনুল্লেখিত

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি