মাতৃভাষা যেখানে মাতৃদুগ্ধ সমান
বলেই এতদিন প্রচলিত ছিল সেখানে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক পেরিয়ে বলতে
ব্যথা অনুভূত হয় যে আজ শিশু যেমন পৃথিবীব্যাপী ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, প্রকৃতি ধ্বংস,
মানবসৃষ্ট প্রদূষণ ইত্যাদির ফলশ্রুতিতে বেঁচে থাকার স্বার্থে মাতৃদুগ্ধের
উপর পুরোপুরি নির্ভর করে থাকতে পারছে না, পরিপূরকের উপর নির্ভর
করতে হচ্ছে ঠিক তেমনি পৃথিবীর বুক থেকে নিত্যদিন হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক
মাতৃভাষা। স্বভাবতই মাতৃদুগ্ধহীন, পুষ্টিহীন হয়ে বিচিত্র এক ভাষা-বিড়ম্বনার মধ্যেই
আজকের শিশুর, আজকের প্রজন্মের বেড়ে ওঠা। ভারতবর্ষ - আসাম - ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাও
এই পৃথিবীর বুকেরই এক ভূমিখণ্ড। ভারতবর্ষের অনন্য সম্পদ ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’। এই ভূখণ্ডে ঐক্য যেমনই
হোক ভাষাগত বৈচিত্র্য কিন্তু বিশাল। জাতি জনজাতি উপজাতি মিলিয়ে অগুনতি ভাষাভাষী
মানুষের বাস প্রকৃতির কোলে বিস্তৃত এই সুন্দর উপত্যকায়।
সরকারি, বেসরকারি তরফে যতই
গুরুত্ব আরোপ করা হোক না কেন মাতৃভাষার চর্চা ও প্রসারের উপর, আখেরে ভারতবর্ষের
মতো এক বিশাল জনসংখ্যার দেশে ভাষাবৈচিত্র্যের অবস্থিতির ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা ও
গণমাধ্যমে সমতার লক্ষ্যে ইংরেজির বাইরে গত্যন্তর নেই আপাতত। কেউ নিজের মাতৃভাষায়
পারঙ্গম হলেও ভিনভাষীদের সংস্পর্শে এলে একটি সর্বজনস্বীকৃত ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন
রয়েছে বইকী। মূলত এই কারণেই চাকরিবাকরি বা ব্যবসায় আদিতে যেহেতু ইংরেজি শিক্ষার
কোনও বিকল্প নেই তাই নতুন প্রজন্ম সেই পথটাই বেছে নেবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
একই চিত্র আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও। উপত্যকার সংযোগী ভাষা অসমিয়া হওয়া সত্ত্বেও মাতৃভাষা সূত্রে যাঁরা মূল অসমীয়া তাঁদের সন্তানসন্ততিরাও আজ ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার পক্ষপাতী। এই উপত্যকায় ভাষা বৈচিত্র্যের বিশাল রূপ। প্রত্যেকটি জাতি, উপজাতি মানুষের রয়েছে নিজ নিজ ভাষা। লিপিহীন কথ্য ভাষাও রয়েছে একাধিক। রয়েছে একাধিক সংবিধান-স্বীকৃত ভাষাভাষী মানুষের বাস। অসমিয়া, বাংলা, বড়ো, মণিপুরি ভাষার মানুষজন যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন কার্বি, গারো, তিওয়া, দেউরি, ডিমাসা, মিরি, কছারি, মিশমি, মার আদি ভাষাভাষী মানুষও। প্রায় নয়টি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করে তোলা হলেও এর বাইরে স্বভাবতই থেকে যাচ্ছেন বহু অধিবাসী। এই চিত্র, এই সমস্যা দেশজুড়ে, পৃথিবী জুড়ে সর্বত্র।
অর্থকরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না কোনওভাবেই। বিপরীতে মাতৃভাষা শিক্ষার দিকটি ইচ্ছাকৃত হওয়ার সুবাদে এর প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আজ ক্রমহ্রাসমান। ফলত সৃষ্টি হচ্ছে একটি নতুন প্রজন্ম যারা বলতে গেলে জন্ম থেকেই মাতৃভাষাহীন। কারণ ঘরে ঘরে আজ গোড়া থেকেই তাদের করে তোলা হচ্ছে বিশ্বনাগরিক অর্থাৎ মাতৃভাষা নামক তথাকথিত বস্তাপঁচা গোড়ামির বিরুদ্ধে জন্ম থেকেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার নামে তাদের মুখে তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি ভাষার বুলি। এ নিয়ে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও প্রাবন্ধিক সঞ্জীব দেবলস্কর তাঁর একটি নিবন্ধে লিখছেন - ‘শক্তিপদ ব্রহ্মচারী কথিত ‘ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়’ আজ আমাদের ঘরে ঘরে। হ্যাঁ, এই আসাম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক দুটো উপত্যকায়ও। এ রাজ্যে TET পাশ করা যুবকযুবতিদের বিশাল সংখ্যক যে ইংল্যান্ড, আমেরিকায় শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জন করলেও আসাম রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানোর ন্যূনতম যোগ্যতা যে অর্জন করা হয়ে ওঠেনি এদিকে লক্ষ করাই হয়নি আমাদের। এরা যে mother-tongue illeterate, মাতৃভাষাবিহীন। শুধু বাঙালি আর অসমিয়াই নন এদের দলে আরও অন্যান্য ভাষাভাষীরাও আছেন। কেউ কেউ হয়তো শিশুকাল থেকেই ইংরেজি ইশকুলে ইংরেজি শিখেছেন, হিন্দি ইশকুলে শিখেছেন হিন্দি। নিজের মাতৃভাষাটা আর শেখা হয়নি। আর যারা প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক স্তরে অসমিয়া বা বাংলা পড়েছিল এরা মাধ্যমিক, উচ্চতর মাধ্যমিক স্তরে এসেই অল্টারনেটিভ ইংরেজিতে নাম লিখিয়ে নিয়েছে। যারা একেবারে KG থেকেই ইংরেজি-হিন্দি পড়ছে, আর যারা ইংরেজি-হিন্দি পড়ছে মাধ্যমিক স্তর থেকে এদের নিয়েই আমাদের রাজ্যে (আমাদের দেশেও) একটা প্রজন্মের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে — এরা হল মাতৃভাষাবিহীন প্রজন্ম। ...... এই মাতৃভাষাবিহীনতা প্রবণতার কাছে অসমিয়া, বাঙালি সহ অপরাপর সব ক’টি ভাষাই পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছে। রাজ্যের শিশু, কিশোর, যুবকরা বাংলা কিংবা অসমিয়া পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, দেশীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। এদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি ঐতিহ্য-পরম্পরা থেকে বিচ্যুত, শিকড়বিহীন একটি প্রজন্ম। এও এক বাস্তুচ্যুতি। নিজদেশে বাস্তুচ্যুতি।
আমাদের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্র-নজরুল
নিয়ে অহংকার করে, কিন্তু এদের কানে গোঁজা ইয়ার ফোনে অষ্টপ্রহর বাজে বিজাতীয় গান, রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পীদের সামনে গীতবিতান বা স্বরবিতান নয়, রোমান হরফে লেখা বাংলা লিরিক। যারা বৈদুতিন যন্ত্র সহযোগে মঞ্চে লোকগান
গেয়ে বেড়ান, এদের উচ্চারণ ইংরেজি ঘেঁষা। এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপে এরা রোমান হরফে দেশীভাষায় বার্তা টেক্সট করে, এ ভাষা না ইংরেজি, না হিন্দি, না
বাংলা না অসমিয়া। এক বিচিত্র না ভাষাই এদের ভাষা। এ ভাষানৈরাজ্য কেউ জোর করে এদের
উপর চাপিয়ে দেয় নি, আমাদের নিজেদের দোষেই পরিস্থিতিটা আমরা
এরকম করে দিয়েছি। আমরা কি সন্তানসন্ততিদের মাতৃভাষায় কথা বলায় অক্ষমতা দেখে
আনন্দিত হই না ? সদর্পে বলি না আমার সন্তানটি বাংলা বলতে পারে না, লিখতে পারে না ? বাংলা বানান, বাংলা যুক্তাক্ষর,
ণত্ববিধি-ষত্ববিধি এসব নিরতিশয় কঠিন জিনিস - এ আওয়াজ তুলে
আলোকপ্রাপ্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রথম সুযোগেই মাতৃভাষার বইপত্র নদীতে বিসর্জন দিয়ে Alt-E
র দলে গিয়ে ভিড় জমায়। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আগামী দশ বছরে
স্বাভাবিকভাবেই মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঘটবে। আমার ধারণা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়
পরিস্থিতি অন্যরকম নয়।’
বর্তমান সময়ের চিন্তায় তাই ভবিষ্যৎ
নিতান্তই অন্ধকার। মাতৃভাষার
শিক্ষাই যখন লাটে ওঠার পথে তখন তার চর্চা তো অনর্থক। তবু অন্ধকারেও যেমন ‘জোনাকিরা দেয় আলো’,
‘অবাক রাতের তারারা আকাশে মিটমিট করে চায়’ তখনও
দুর্বার রানার ‘সবেগে হরিণের মতো ধায়’। দুর্বার কিংবা সবেগে না হলেও মাতৃভাষা
মাধ্যমের বিদ্যালয় দুরন্ত সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েও টিকে আছে আজও মূলত দরিদ্র গ্রামবাসীদের
অবদানে। এখানে
অবদান অর্থে সন্তানশিক্ষা। সরকারি তরফে মাতৃভাষা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলিকে
ইংরেজি মাধ্যমে পরিবর্তনের অভিযোগ উত্থাপিত হয় প্রায়শ। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারের নিরুপায়তাও
লক্ষণীয়। ছাত্রছাত্রীবিহীন
বিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মচারী পুষে রাখার বিলাসিতা আজকের বিশ্ব অর্থনীতির কঠিন দিনে কোনো
সরকারের পক্ষেই দেখানো সম্ভব নয়। ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার
যাবতীয় সরকারি প্রচেষ্টাকে উচ্চবিত্ত তো দূর অস্ত্, নিম্ন মধ্যবিত্তরাও অনায়াসে অস্বীকার
করে সন্তান সন্ততিদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার পণ নিয়ে রেখেছেন।
তবু জোনাকির মতোই বেঁচে আছে মাতৃভাষার বিদ্যালয়। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আজকের অবস্থা এমন নয় যে ক্লাসরুম শূন্য পড়ে আছে। আজকের দিনেও সংখ্যায় কম হলেও মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কিন্তু একেবারেই ছাত্রশূন্য হয়ে যায়নি। এর বাইরেও রয়েছে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। পাঠদান এবং পাঠগ্রহণ চলছে সেখানেও। বিভিন্ন ভাষায় তাই সাহিত্যচর্চা তথা লেখালেখি যে বন্ধ হয়ে গেছে তেমন নয়। বরং বলা ভালো সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছুটা বর্ধিত হয়ে আশার আলো দেখাতে সক্ষম হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সাহিত্যক্ষেত্রে দেখা যায় বেশ কিছু উঠতি মুখ, নবীন প্রজন্ম। এই উপত্যকা থেকে জিন্টু গিতার্থ, নীলিম কুমার, প্রদ্যুম্নকুমার গগৈ, অভিজিৎ বরা সহ একগুচ্ছ তরুণ অসমিয়া সাহিত্যে আশার আলো জ্বালিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন সর্বভারতীয় স্তরে। মাইনাওশ্রী দৈমারী, রুজাব মুশাহারী প্রমুখ বড়ো যুব প্রতিভাও আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন। শুধু তরুণ কবি সাহিত্যিকরাই নন, অসমিয়া ভাষার সাহিত্য জগৎ নিত্যদিন নানা বইপত্র, সাময়িকী আদির প্রকাশে নিরন্তর চমকিত হচ্ছে। আকাদেমি থেকে জ্ঞানপীঠ নিরন্তর বয়ে আসছে এই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। বড়ো ভাষায়ও সাহিত্য চর্চা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যেও কাজ হচ্ছে। অন্যান্য ভাষাভাষীদের এই চর্চা হয়তো অনেকটাই সীমিত মূলত জনসংখ্যার কম ঘনত্বের জন্য।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চিত্র ভিন্নতর। বাঙালি জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হওয়ার সুবাদে বহু বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম কিংবা শূন্য। যেখানে ঘনত্ব বেশি সেখানে বিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও আজ শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য কিংবা শূন্য হওয়ার সুবাদে বন্ধ হওয়ার পথে। রাজনীতির খাতিরে ভাবের ঘরে চুরির ধান্দা না করে একতরফা ভাবে সরকার বিরোধিতা কিংবা ভাষাবিভেদের জিগির না তোলাই শ্রেয়। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’। গুচ্ছ গুচ্ছ বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের কৃতকর্মের বিশ্লেষণ না করে গেল গেল রব তোলেন অথচ সেরকম অর্থে কোনও সৎচিন্তা বা সৎবুদ্ধির দাওয়াই দিতে অপারগ। মোদ্দা কথা বাংলা ভাষা চর্চার এই অথই সংকটের মূলে কিন্তু অভিভাবকরাই। শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বহু বিদ্যালয়। বহু বিদ্যালয়ের মাধ্যম পরিবর্তন করতে হয়েছে কিংবা ইংরেজি মাধ্যম জুড়তে হয়েছে। এহ বাহ্য। নান্য পন্থা।
তবু সেই জোনাকিরা এখানেও দেয় আলো। বাংলা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে পড়াশোনা করেও, বাংলাকে একটি বিষয় হিসেবে নিয়ে শিক্ষাদীক্ষা না করেও লেখালেখির জগতে পদার্পণ করেছে এবং করছে বহু তরুণ তরুণী। এমন নিদর্শন বিরল নয়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় স্তর অবধি শিক্ষা গ্রহণ করেও অনেকেই মাতৃভাষা চর্চায় নিজেকে নিরত রেখেছেন। বিভিন্ন কারণে বিশেষ কোনও পুরস্কার না জুটলেও সাহিত্যক্ষেত্রে এইসব তরুণ কবি লেখকদের অবদান ও প্রচেষ্টাকে কোনওভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। উল্লেখযোগ্য কিছু নাম - নীলদীপ চক্রবর্তী, কমলিকা মজুমদার, সঞ্জয় চন্দ্র দাস, শ্রাবন্তী পুরকায়স্থ, গীতাঞ্জলী রায়, অসীমা সিংহ রায়, অর্জুন দাস, শ্যামল ঘোষ, নিত্যানন্দ দাস, রণদীপ নন্দী, মধুমিতা সেনগুপ্ত, মম্পি গুপ্ত, রাজা চক্রবর্তী, কোলাজ রায়, অশোক কুমার রায় এবং আরোও অনেকেই। বাংলা ভাষায় ছোটপত্রিকা কিংবা সাময়িকীর প্রকাশ সীমিত হলেও বইপত্রের নিয়মিত প্রকাশ কিন্তু এখনও চলছে। প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি নবীন কবি, গল্পকারদের গ্রন্থ আকছার প্রকাশিত হচ্ছে। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রটি আজ থেকে বহুদিন আগেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে অনুভূত হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। এই চর্চা যে আগত দিনেও অবিচ্ছিন্ন থাকবে এমন প্রত্যাশা রাখা যেতেই পারে। আজকের দিনে অন্তত একটা রিভার্স ট্রেন্ড যে এসেছে তাও অস্বীকার করা যায় না। সাহিত্য চর্চার আগ্রহ নিয়ে সাহিত্যমূলক অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত অনুরাগীদের উপস্থিতি অন্তত এমন একটা ইঙ্গিতই দিয়ে যায়।
নিজ নিজ প্রচেষ্টায় নবীন কবি সাহিত্যিকরা যে যত্নের ছাপ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন এদের বাইরেও নিশ্চিতভাবেই আছেন আরোও বহু প্রতিভাধর ছাত্রছাত্রী। তবে সবচাইতে হতাশার ব্যাপারটি হচ্ছে এই যে এদের কিংবা আরোও বহু প্রতিভাকে সঠিক পথ দেখিয়ে মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রটিকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রচেষ্টা নেই। ব্যক্তিগত, প্রতিষ্ঠানগত কিংবা সরকারি কোনো তরফেই নেই কোনও উদ্যোগ। এটা ভাবার বিষয়।
শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সেই প্রাসঙ্গিক পঙ্ক্তি আজও তাই সমান প্রাসঙ্গিক – ‘মেখলা ও শাড়ি আজ পাশাপাশি হেঁটে যায় সালোয়ার পাঞ্জাবির দিকে’। ‘এখন যে ভাষা আমাদের প্রদেশ কিংবা দেশ তথা উপমহাদেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এ ভাষা হিন্দির মতো, তবে হিন্দি নয়, ইংরেজির মতো তবে ইংরেজি নয়, এ ভাষা একান্তই মিডিয়া লেঙ্গুয়েজ। এ ভাষার বিজ্ঞাপন হয়, প্রকাশ হয় না, বিপণন হয়, সৃজন হয় না। এ ভাষাই আগ্রাসনের ভাষা। এ ভাষা আমাদের সংহতির পথে নিয়ে যায় না, নিয়ে যায় উদভ্রান্তির দিকে, বিচ্ছিন্নতার দিকে।
মাতৃভাষা তো নিছক কিছু শব্দ কিংবা
বর্ণমালা নয়, নয় কিছু শুষ্ক পুঁথির বোঝা। মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি – সেটা অসমিয়াই হোক, বাংলাই হোক বা হোক বড়ো, কোচ, ডিমাসা, কার্বি, তাই আহোম, কুকি, মিজো, মার, নাগা, নেপালি কিংবা
ভোজপুরি।’
আজকের দিনে তাই ব্রহ্মপুত্র
উপত্যকায়ও মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রটি অভিভাবকহীনতায় ভুগছে আরোও অনেক উপত্যকা,
রাজ্য ও দেশের সঙ্গে। ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে এর গতিপথ। তবু প্রত্যয় রেখে বলাই যায়
- অন্ধকারে জোনাকিরা জ্বলবে চিরদিন, রাতের তারারা পথ দেখাবে চিরদিন।
একই চিত্র আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেও। উপত্যকার সংযোগী ভাষা অসমিয়া হওয়া সত্ত্বেও মাতৃভাষা সূত্রে যাঁরা মূল অসমীয়া তাঁদের সন্তানসন্ততিরাও আজ ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার পক্ষপাতী। এই উপত্যকায় ভাষা বৈচিত্র্যের বিশাল রূপ। প্রত্যেকটি জাতি, উপজাতি মানুষের রয়েছে নিজ নিজ ভাষা। লিপিহীন কথ্য ভাষাও রয়েছে একাধিক। রয়েছে একাধিক সংবিধান-স্বীকৃত ভাষাভাষী মানুষের বাস। অসমিয়া, বাংলা, বড়ো, মণিপুরি ভাষার মানুষজন যেমন রয়েছেন তেমনি রয়েছেন কার্বি, গারো, তিওয়া, দেউরি, ডিমাসা, মিরি, কছারি, মিশমি, মার আদি ভাষাভাষী মানুষও। প্রায় নয়টি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করে তোলা হলেও এর বাইরে স্বভাবতই থেকে যাচ্ছেন বহু অধিবাসী। এই চিত্র, এই সমস্যা দেশজুড়ে, পৃথিবী জুড়ে সর্বত্র।
অর্থকরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না কোনওভাবেই। বিপরীতে মাতৃভাষা শিক্ষার দিকটি ইচ্ছাকৃত হওয়ার সুবাদে এর প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আজ ক্রমহ্রাসমান। ফলত সৃষ্টি হচ্ছে একটি নতুন প্রজন্ম যারা বলতে গেলে জন্ম থেকেই মাতৃভাষাহীন। কারণ ঘরে ঘরে আজ গোড়া থেকেই তাদের করে তোলা হচ্ছে বিশ্বনাগরিক অর্থাৎ মাতৃভাষা নামক তথাকথিত বস্তাপঁচা গোড়ামির বিরুদ্ধে জন্ম থেকেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার নামে তাদের মুখে তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি ভাষার বুলি। এ নিয়ে বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও প্রাবন্ধিক সঞ্জীব দেবলস্কর তাঁর একটি নিবন্ধে লিখছেন - ‘শক্তিপদ ব্রহ্মচারী কথিত ‘ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়’ আজ আমাদের ঘরে ঘরে। হ্যাঁ, এই আসাম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক দুটো উপত্যকায়ও। এ রাজ্যে TET পাশ করা যুবকযুবতিদের বিশাল সংখ্যক যে ইংল্যান্ড, আমেরিকায় শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জন করলেও আসাম রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানোর ন্যূনতম যোগ্যতা যে অর্জন করা হয়ে ওঠেনি এদিকে লক্ষ করাই হয়নি আমাদের। এরা যে mother-tongue illeterate, মাতৃভাষাবিহীন। শুধু বাঙালি আর অসমিয়াই নন এদের দলে আরও অন্যান্য ভাষাভাষীরাও আছেন। কেউ কেউ হয়তো শিশুকাল থেকেই ইংরেজি ইশকুলে ইংরেজি শিখেছেন, হিন্দি ইশকুলে শিখেছেন হিন্দি। নিজের মাতৃভাষাটা আর শেখা হয়নি। আর যারা প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক স্তরে অসমিয়া বা বাংলা পড়েছিল এরা মাধ্যমিক, উচ্চতর মাধ্যমিক স্তরে এসেই অল্টারনেটিভ ইংরেজিতে নাম লিখিয়ে নিয়েছে। যারা একেবারে KG থেকেই ইংরেজি-হিন্দি পড়ছে, আর যারা ইংরেজি-হিন্দি পড়ছে মাধ্যমিক স্তর থেকে এদের নিয়েই আমাদের রাজ্যে (আমাদের দেশেও) একটা প্রজন্মের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে — এরা হল মাতৃভাষাবিহীন প্রজন্ম। ...... এই মাতৃভাষাবিহীনতা প্রবণতার কাছে অসমিয়া, বাঙালি সহ অপরাপর সব ক’টি ভাষাই পরাজয় স্বীকার করে নিচ্ছে। রাজ্যের শিশু, কিশোর, যুবকরা বাংলা কিংবা অসমিয়া পড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, দেশীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে ওরা বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। এদের নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি ঐতিহ্য-পরম্পরা থেকে বিচ্যুত, শিকড়বিহীন একটি প্রজন্ম। এও এক বাস্তুচ্যুতি। নিজদেশে বাস্তুচ্যুতি।
তবু জোনাকির মতোই বেঁচে আছে মাতৃভাষার বিদ্যালয়। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও আজকের অবস্থা এমন নয় যে ক্লাসরুম শূন্য পড়ে আছে। আজকের দিনেও সংখ্যায় কম হলেও মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কিন্তু একেবারেই ছাত্রশূন্য হয়ে যায়নি। এর বাইরেও রয়েছে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। পাঠদান এবং পাঠগ্রহণ চলছে সেখানেও। বিভিন্ন ভাষায় তাই সাহিত্যচর্চা তথা লেখালেখি যে বন্ধ হয়ে গেছে তেমন নয়। বরং বলা ভালো সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছুটা বর্ধিত হয়ে আশার আলো দেখাতে সক্ষম হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সাহিত্যক্ষেত্রে দেখা যায় বেশ কিছু উঠতি মুখ, নবীন প্রজন্ম। এই উপত্যকা থেকে জিন্টু গিতার্থ, নীলিম কুমার, প্রদ্যুম্নকুমার গগৈ, অভিজিৎ বরা সহ একগুচ্ছ তরুণ অসমিয়া সাহিত্যে আশার আলো জ্বালিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন সর্বভারতীয় স্তরে। মাইনাওশ্রী দৈমারী, রুজাব মুশাহারী প্রমুখ বড়ো যুব প্রতিভাও আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন। শুধু তরুণ কবি সাহিত্যিকরাই নন, অসমিয়া ভাষার সাহিত্য জগৎ নিত্যদিন নানা বইপত্র, সাময়িকী আদির প্রকাশে নিরন্তর চমকিত হচ্ছে। আকাদেমি থেকে জ্ঞানপীঠ নিরন্তর বয়ে আসছে এই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। বড়ো ভাষায়ও সাহিত্য চর্চা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যেও কাজ হচ্ছে। অন্যান্য ভাষাভাষীদের এই চর্চা হয়তো অনেকটাই সীমিত মূলত জনসংখ্যার কম ঘনত্বের জন্য।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চিত্র ভিন্নতর। বাঙালি জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হওয়ার সুবাদে বহু বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম কিংবা শূন্য। যেখানে ঘনত্ব বেশি সেখানে বিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও আজ শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য কিংবা শূন্য হওয়ার সুবাদে বন্ধ হওয়ার পথে। রাজনীতির খাতিরে ভাবের ঘরে চুরির ধান্দা না করে একতরফা ভাবে সরকার বিরোধিতা কিংবা ভাষাবিভেদের জিগির না তোলাই শ্রেয়। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’। গুচ্ছ গুচ্ছ বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের কৃতকর্মের বিশ্লেষণ না করে গেল গেল রব তোলেন অথচ সেরকম অর্থে কোনও সৎচিন্তা বা সৎবুদ্ধির দাওয়াই দিতে অপারগ। মোদ্দা কথা বাংলা ভাষা চর্চার এই অথই সংকটের মূলে কিন্তু অভিভাবকরাই। শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বহু বিদ্যালয়। বহু বিদ্যালয়ের মাধ্যম পরিবর্তন করতে হয়েছে কিংবা ইংরেজি মাধ্যম জুড়তে হয়েছে। এহ বাহ্য। নান্য পন্থা।
তবু সেই জোনাকিরা এখানেও দেয় আলো। বাংলা কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে পড়াশোনা করেও, বাংলাকে একটি বিষয় হিসেবে নিয়ে শিক্ষাদীক্ষা না করেও লেখালেখির জগতে পদার্পণ করেছে এবং করছে বহু তরুণ তরুণী। এমন নিদর্শন বিরল নয়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় স্তর অবধি শিক্ষা গ্রহণ করেও অনেকেই মাতৃভাষা চর্চায় নিজেকে নিরত রেখেছেন। বিভিন্ন কারণে বিশেষ কোনও পুরস্কার না জুটলেও সাহিত্যক্ষেত্রে এইসব তরুণ কবি লেখকদের অবদান ও প্রচেষ্টাকে কোনওভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। উল্লেখযোগ্য কিছু নাম - নীলদীপ চক্রবর্তী, কমলিকা মজুমদার, সঞ্জয় চন্দ্র দাস, শ্রাবন্তী পুরকায়স্থ, গীতাঞ্জলী রায়, অসীমা সিংহ রায়, অর্জুন দাস, শ্যামল ঘোষ, নিত্যানন্দ দাস, রণদীপ নন্দী, মধুমিতা সেনগুপ্ত, মম্পি গুপ্ত, রাজা চক্রবর্তী, কোলাজ রায়, অশোক কুমার রায় এবং আরোও অনেকেই। বাংলা ভাষায় ছোটপত্রিকা কিংবা সাময়িকীর প্রকাশ সীমিত হলেও বইপত্রের নিয়মিত প্রকাশ কিন্তু এখনও চলছে। প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি নবীন কবি, গল্পকারদের গ্রন্থ আকছার প্রকাশিত হচ্ছে। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রটি আজ থেকে বহুদিন আগেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে অনুভূত হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। এই চর্চা যে আগত দিনেও অবিচ্ছিন্ন থাকবে এমন প্রত্যাশা রাখা যেতেই পারে। আজকের দিনে অন্তত একটা রিভার্স ট্রেন্ড যে এসেছে তাও অস্বীকার করা যায় না। সাহিত্য চর্চার আগ্রহ নিয়ে সাহিত্যমূলক অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত অনুরাগীদের উপস্থিতি অন্তত এমন একটা ইঙ্গিতই দিয়ে যায়।
নিজ নিজ প্রচেষ্টায় নবীন কবি সাহিত্যিকরা যে যত্নের ছাপ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন এদের বাইরেও নিশ্চিতভাবেই আছেন আরোও বহু প্রতিভাধর ছাত্রছাত্রী। তবে সবচাইতে হতাশার ব্যাপারটি হচ্ছে এই যে এদের কিংবা আরোও বহু প্রতিভাকে সঠিক পথ দেখিয়ে মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রটিকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রচেষ্টা নেই। ব্যক্তিগত, প্রতিষ্ঠানগত কিংবা সরকারি কোনো তরফেই নেই কোনও উদ্যোগ। এটা ভাবার বিষয়।
শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সেই প্রাসঙ্গিক পঙ্ক্তি আজও তাই সমান প্রাসঙ্গিক – ‘মেখলা ও শাড়ি আজ পাশাপাশি হেঁটে যায় সালোয়ার পাঞ্জাবির দিকে’। ‘এখন যে ভাষা আমাদের প্রদেশ কিংবা দেশ তথা উপমহাদেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এ ভাষা হিন্দির মতো, তবে হিন্দি নয়, ইংরেজির মতো তবে ইংরেজি নয়, এ ভাষা একান্তই মিডিয়া লেঙ্গুয়েজ। এ ভাষার বিজ্ঞাপন হয়, প্রকাশ হয় না, বিপণন হয়, সৃজন হয় না। এ ভাষাই আগ্রাসনের ভাষা। এ ভাষা আমাদের সংহতির পথে নিয়ে যায় না, নিয়ে যায় উদভ্রান্তির দিকে, বিচ্ছিন্নতার দিকে।
সূত্র -
(১) ‘মাতৃভাষার অস্তিত্ব ও সংকট’, সঞ্জীব দেবলস্কর
(২)
আন্তর্জাল।
(১) ‘মাতৃভাষার অস্তিত্ব ও সংকট’, সঞ্জীব দেবলস্কর
Comments
Post a Comment