Skip to main content

ধারাবাহিকতায় ছিমছাম অষ্টাদশী ‘মানবী’


প্রকাশিত হয়ে গেল আঠারোতম বছরের প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি - মার্চ ২০২৪। নিয়মিত ত্রৈমাসিক ‘মানবী’। বরাক উপত্যকার কবির শহর শিলচর থেকে সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকা চারজন কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে এ সংখ্যার সম্পাদক দোলনচাঁপা দাসপাল।
‘মানবী’ পত্রিকার যে বিশেষত্বটি প্রথম দর্শনেই পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায় তা হল এর প্রচ্ছদ। প্রতিটি সংখ্যাতেই এই ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। এবারেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এ সংখ্যার প্রচ্ছদ সৌজন্যে ডা. কনকদীপ শর্মা। যেহেতু নিয়মিত সংখ্যা তাই ছিমছাম ৫৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে এই অষ্টাদশী ‘মানবী’। সুবিন্যস্ত সূচিপত্রে (এটাও ‘মানবী’র নিয়মিত উৎকর্ষ) রয়েছে ৭টি কবিতা, ৬টি ছোটগল্প এবং ১টি ভ্রমণ কাহিনি। কোনও প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিহনেই সেজে উঠেছে ভেতরের পাতা। সম্ভার আপাতদৃষ্টিতে অপ্রতুল মনে হলেও আদপেই তা নয়। ‘মানবী’ সেই ধাঁচের পত্রিকা নয়। সংখ্যা নয়, গভীরতাই এখাস্নে বিচার্য। প্রতিটি রচনা সুচয়িত এবং গভীর মানসম্পন্ন। এখানেই ‘মানবী’র বিশেষত্ব - সতত। সমানুপাতিক সম্পাদকীয়তে নব আঙ্গিকে সম্পাদক লিখছেন - ‘মানবী এখন অষ্টাদশী, প্রতিবাদী সে… হয়তো খানিকটা স্পর্ধিতাও … এই বয়সটিই তো স্বপ্নের বয়স… কিছু কিছু ইচ্ছেরা ঘাটে এসে বাসা বাঁধে…. আমাদের সেইসব ইচ্ছেরা জেগে থাকুক অনাদি অনন্তকাল… মিড-ডে মিলের পুষ্টিকর আহার হয়ে সবল করুক আমাদের দুর্বল ছেয়েমেয়েগুলোকে… বসন্ত হয়ে ফিরে আসুক যাপনের সমস্ত প্রতিকূলতায়… প্রকাশিত হোক কালি ও কলমে… বোধে ও চেতনার সহস্র যাপন জুড়ে…।’ ব্যতিক্রমী আঙ্গিকের সম্পাদকীয়।
সম্ভারে প্রবেশ করলে প্রথমেই কবিতা বিভাগ। সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সম্পাদক, কবি চন্দ্রিমা দত্তের দুটি কবিতার মাধ্যমেই শ্রীগণেশ হল এ সংখ্যার। কবিতা দুটি ‘এই ফাল্গুনে’ ও ‘মুক্ত ভাষা, মুক্তির ভাষা’ শিরোনাম অনুযায়ী বিষয়ের কাব্যিক প্রকাশ। এরপর ফের একবার অন্যতম সম্পাদক শেলী দাসচৌধুরীর দুটি কবিতা ‘পাথর’ ও ‘আর্দ্র’। উপরিউক্ত চারটি কবিতা সুখপাঠ্য হলেও কবিদের শ্রেষ্ঠ নিবেদন হয়তো নয়। এ মন্তব্য পূর্ব প্রকাশিত সংখ্যাগুলিতে তাঁদের কবিতা পাঠের পরিপ্রেক্ষিতেই করা হল। এই বিভাগে এর পর রয়েছে কবি অপাংশু দেবনাথের দুটি কবিতা - ‘আরেকটি ক্ষুধার্ত সকাল’ এবং ‘একান্তে’। উপস্থাপনা ও পঙ্‌ক্তিসজ্জায় বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য অস্তরাগ সুপ্রিয়-র কবিতার ক্ষেত্রেও বলা যায়। ছন্দা দাম ও শ্যামলী ভট্টাচার্য পাল-এর কবিতা দুটি একাধারে সুখপাঠ্য এবং বিষয় বৈচিত্রে যথাযথ। নিবেদিতা ভরালীর অসমিয়া কবিতা ‘ঠিকনা…’ অসমিয়া হরফেই হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। কোনও অনুবাদ নয়। এ এক চমকদার সংযোজন। এ অর্থে এবারের সংখ্যাটিকে দ্বিভাষিক সংখ্যা হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। পরীক্ষামূলক এবং ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত।
গল্প বিভাগও ‘মানবী’র বরাবরের উৎকৃষ্ট বিভাগ। এবারের সংখ্যায় প্রথমেই রয়েছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ভিন্ন ধারার ভালোবাসার গল্প ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’। বনানী চৌধুরীর ‘অব্যক্ত প্রেম’ ছিমছাম সুললিত গল্প। সুচিন্তিত বিষয়, দরদি বুনোট। সম্পাদক দোলনচাঁপা দাসপালের গল্প ‘তান্ত্রিক’। ব্যতিক্রমী বিষয়। চমৎকার বুনোট। পড়ে যেতে হয় বিরতিহীন। কিন্তু শেষটা অভিপ্রেত চমৎকারিত্ব থেকে যেন খানিকটা দূরেই থেকে গেল। ছোটগল্পের সংজ্ঞা মেনে ‘ছোট ছোট দুঃখব্যথা’ এসে যেন এক ছমছম ঘটনাপ্রবাহকে পত্রিকার সংজ্ঞা মেনে ‘ছিমছাম’-এ পর্যবসিত করে গেল ভয়ানক রসের মোড়কে হাস্যরসের ছোঁয়ায়। কবি চন্দ্রিমা দত্তের গল্পের হাতও অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। শুধুমাত্র সুললিত ভাষাপ্রয়োগের কারুকার্যে এক একটি গল্প প্রায়শই জায়গা করে নেয় পাঠকের হৃদয়ে। এ সংখ্যার গল্প ‘নির্বাণ পাঠের দিদিমণি’ তেমনই। প্রমাণ স্বরূপ প্রথম লাইনটি উদ্ধৃত করা যাক - ‘মধ্যাহ্ন-কালীন আহারের পর বিশ্রামের সময়টা পেরিয়ে গেলে যে ছায়া জানান দ্যায় - এখন বিকেল, তখন ঘরফেরা দলবদ্ধ পাখির ডানার আওয়াজ শুনতে পায় সোমলতা…।’ কোনও তন্ত্র-মন্ত্র নয়, পিতৃতন্ত্র ও পাখিতন্ত্রের এক গোছানো প্রতিবেদন এই গল্প। বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হওয়া না হওয়ার দায় পাঠকের। গল্প হিসেবে অসাধারণ।
এই বিভাগে এরপর রয়েছে সম্প্রতি বরাকবঙ্গ আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতা ২০২৪-এ প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা দুটি গল্প। প্রথমে রয়েছে প্রথম স্থানাধিকারী শর্মিলী দেব কানুনগোর গল্প ‘শ্রাবণ সঙ্গ সুধায়’। একেবারেই এক ভিন্নচিন্তার গল্প। স্বল্প কথায়, ভিন্ন আবহে বিষয়কে প্রতিস্থাপন করেছেন গল্পকার। চার পর্বের গল্পের তৃতীয় পর্বের শেষটায় ইঙ্গিতবাহী করে রাখলেন ঘটনাপ্রবাহ। নান্দনিক উপস্থাপনা। এরপর রয়েছে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী গল্প দেবরাজ দাশগুপ্তের ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’। চার পর্বে বিস্তৃত এই গল্পে সমকালকে সমকালীন কথাসুষমায় অপূর্ব উপস্থাপন করেছেন গল্পকার। কঠোর বাস্তব এসে কীভাবে যাবতীয় সুখকল্পকে হারিয়ে যেতে বাধ্য করে তার এক নির্মোহ সজ্জা। পাঠক হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়ার মতো গল্প।
এ সংখ্যার শেষ নিবেদন সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সম্পাদক, গল্পকার শর্মিলা দত্তের ভ্রমণ কাহিনি ‘অপার সবুজের সমারোহে এক টুকরো ভ্রমণ’। বড়াইল উপত্যকার শৈল শহর হাফলংকে কেন্দ্র করে উদ্দাম প্রাকৃতিক সুষমায় বিরাজিত পাহাড়ের অবুঝ, অবাধ সৌন্দর্যের আবহে প্রকৃতার্থেই এক ‘এক টুকরো’ ভ্রমণগাথা। জম্পেশ করে বসে ভ্রমণ কাহিনি পড়ার মতো বিস্তৃত হতেই পারত। শেষ পর্যন্ত সেই ‘ছিমছাম’-ধর্ম এসেই বাজিমাত করল। হয়তো পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তৃত হতেও পারে - যদিও তেমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
ছাপার মান মোটামুটি যথাযথ হলেও বাক্য ও প্যারাগ্রাফ বিন্যাসের কিছু অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়েছে। বনানী চৌধুরীর গল্প ও দু-একটি রচনার শিরোনামে বানান ভুল দৃষ্টিকটু হয়েছে। পঠনকটু হবে বোদ্ধা পাঠকেরও। সব মিলিয়ে এই কঠিন সময়ে ধারাবাহিকতার ধর্ম মেনে সুচয়িত সম্ভারের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছিমছাম অষ্টাদশী ‘মানবী’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৮০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪০১৩৭৭০৩০ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি