এখানে বৃষ্টি আসে না প্রায়শই,
গুমোট জমে আছে মেঘও–
নারকেলের মালার মতো
ছোট দুই টিলার ওপরে ঝুঁকে আছে আকাশ
স্তব্ধ চরাচর, উন্মুক্ত জমি-
কাঁধে লাঙল, কৃষক এগোন নির্দ্বিধায়
মুখ রাখি নদীখাতে,
সোজা হয়ে আসে শিরদাঁড়া
বর্ষা নামে দিগন্তে–
মেতে উঠি কৃষিকাজে। (কবিতা - কৃষিকাজ)
রূপকের এমন সার্থক প্রয়োগ সহজে দেখা যায় না। বিশেষ করে এতদঞ্চলের কাব্য-কবিতায়। তবে শুধুই রূপক কিংবা দ্যোতনা নয়, রত্নদীপ দেব-এর কবিতার সতর্ক পাঠে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় অজস্র শব্দ ও শব্দদ্বিত্বের এক অসাধারণ প্রয়োগ, এক জাগলারি যা স্পর্শ করে যায় পাঠক মন। অনর্থক তো নয়ই, শব্দের কাটাকুটিও নয় - বলা ভালো শব্দের কারিকুরি যা আকছার জুড়ে আছে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তির শরীরে। গ্রন্থনামের উল্লেখ থাকা কবিতাটিও এমনই এক অনাবিল উপস্থাপন -
ছুঁয়ে দেখেছি নীহারিকা
জলের কাছে পুনর্জন্মের স্বাদ–
ভার্সিটির পথে
অন্ধকার চিবুক ধোয়া সন্ধ্যায়
তোমার নীরব নিঃশ্বাস, আর
বাকি সব অনর্থক কাটাকুটি
রাতের পালকেও এরপর
খুঁজে পাই অস্পষ্ট ঘুমের দাগ
তবু, বৃষ্টির গন্ধে
ভোরের ইশারা এলে আরও
জলসুখে নোঙর তুলি... (কবিতা - জলসুখ)।
‘অনর্থক কাটাকুটি’। কবি রত্নদীপ দেব-এর সদ্য প্রকাশিত বেশ ক’টি গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম। কবিতায় এক আলাদা পরিচিতি, ব্যতিক্রমী ধাঁচ গড়ে তুলেছেন রত্নদীপ। তাঁর লেখালেখির যবে থেকে শুরু এতদিনে আরোও বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হতে পারত। কিন্তু ক্যোয়ান্টিটি নয়, ক্যোয়ালিটিতেই তাঁর আস্থা এমন প্রতীতি জাগে। এই গুণমানের অগুনতি প্রকাশ আলোচ্য গ্রন্থে।
কিছু অনুষঙ্গকে ঘিরেই এই গ্রন্থ। তবে একমুখী বলা যাবে না বরং বলা ভালো বহুমুখী অনুষঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে কবিতাসমূহ। এক ‘তুমি’কে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে বহু কবিতা। অধরা এই ‘তুমি’র আবহে প্রকাশিত হয়েছে কবির বহু অনুভব আর অনুভূতি - ‘তুমি’রূপ নদীর কাছেই কবি বারবার হয়েছেন নতজানু, কবিকল্পনায় কবিকে ঘিরে থাকে এই ‘তুমি’র অগুনতি প্রহর। ‘তুমি’কে নিয়ে এই অনর্গল কাটাকুটিকেই হয়তো কবি অনর্থক বলতে চেয়েছেন -
রোজ নিয়ম করে সূর্য ওঠে/ তোমার মুখে,/ দু’চোখে তবু বৃষ্টির দাগ/ গাড়ির আধখোলা কাচে/ থমকে আছেন পর্যটক–/ ব্যর্থ প্রেমিকের তুমুল আনন্দ/ নদীর কাছেই এখন/ নতজানু... (কবিতা - নিজস্ব শর্তে)।
দু’হাতে বৃষ্টি মেখে/ বোতামবিহীন বিকেল নামে/ মাঝরাস্তায়,/ দলছুট মেঘ দু’চোখে/ নির্জনতার রং এঁকে দিয়ে গেলেও/ তোমার বুকে শুনি/ পুকুরপাড়ের উদ্ধত সংলাপ–.../ আমি নই/ বাদামের খোসার মতো/ ইতস্তত ঘরময় ছড়িয়ে আছে/ তোমার এক একটা প্রহর... (কবিতা - প্রহর)।
এই বৃষ্টিও এসেছে বহু কবিতায় অনুষঙ্গ হয়ে। বলা যায় কবি বৃষ্টিকে নামিয়ে এনেছেন কবিতার চলমানতায়, বৃষ্টিকথায় -
শ্রাবণের চড়া রোদেও/ মুখ গুঁজে থাকে বৃষ্টি,/ ছায়া হয়ে আসে মেঘ–/ বাতাসের স্পষ্ট আনাগোনায়/ বর্ষার আভাস এলে/ চুমুকে চুমুক রাখে মেয়েটি,/ চিবুকধোয়া শিশিরজলে/ বৃষ্টি নামে এরপর... (কবিতা - শিশির)
এভাবেই কবিতায় কবিতায় বারবার এসেছে আরোও বহু অনুষঙ্গ। যেমন জল, চাঁদ, রক্তক্ষরণ আদি। উনিশ আর বরাক তো কবির মজ্জায়। এক ভিন্নধর্মী কবিতা - সুইসাইড নোট ১, ২ ও ৩। বলা যায় এখান থেকেই কবিতার গতিপথ কিছুটা হলেও বাঁক নিয়েছে নদীর মতো - এক অনুষঙ্গ থেকে অন্য অনুষঙ্গে যেখানে শব্দাবলির গভীর প্রয়োগে সৃষ্টি হয়েছে কিছু অমোঘ পঙ্ক্তি, স্তবক। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় -
চাঁদের গা চুঁইয়ে পড়া জলে
সমুদ্রের নোনা স্বাদ... (কবিতা মাঝরাতের কাব্য)।
আঠারোর তছনছ সিলেবাস
ছুঁয়ে থাকি তিরিশে...
পরকীয়া স্পর্শে তোমাকে খুঁজি
নতুন সহজপাঠে। (কবিতা - পরকীয়া)।
...দাঁড়িয়েই আছি প্ল্যাটফর্মে–
রেলগেটের নির্জনতায়
কবিতায় সাজি রেলপথ
দিনের শেষ ট্রেন থামে উঠোনের ঘাসে
কাছেই দমদম রোড... (কবিতা - রেলপথ)।
প্রায় সবগুলি কবিতাই এমন চমৎকারিত্বে ভরপুর। তবু বিশেষোল্লেখে রাখতেই হয় - কবিতার কাছে, জলসুখ, সর্বস্বান্ত মুহূর্ত, মন্থন, অদ্ভুত ক্ষয়, প্রহর, বৃষ্টি, বানভাসি (দীর্ঘ কবিতা), ঠিকানা, সাঁকো, জ্যামিতি, মহাষ্টমী, শাসন - এই কবিতাগুলিকে। সব মিলিয়ে এক নান্দনিক মননের কবিতায় সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ।
ছাপা, হার্ড বোর্ড বাঁধাই, অক্ষর/শব্দ বিন্যাস যথাযথ। শুদ্ধ আধুনিক বানানের প্রয়োগ অন্যতম উৎকর্ষ বলে প্রতীয়মান হলেও ফাঁক গলে বোধ করি থেকেই যায় দু’চারটে শেষ অবধি। এখানেও তাই হয়েছে। ৫৬টি কবিতার সমাহারে ৬৪ পৃষ্ঠার এই ভূমিকাহীন গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর শ্রদ্ধাস্পদ প্রিয় শিক্ষক শ্রী তপন রায়, ড. বিশ্বতোষ চৌধুরী, ড. রূপরাজ ভট্টাচার্য ও ড. তপোধীর ভট্টচার্যকে। পুণ্যব্রত পত্রীর প্রচ্ছদচিত্র প্রাসঙ্গিক হলেও বর্ণবিন্যাস যথাযথ মনে হয়নি। ব্লার্বে রয়েছে কবি পরিচিতি ও অতি সংক্ষিপ্ত আকারে কবির কাব্যপরিচিতি। পাঠশেষে পাঠকমনে থেকে যাবে এক অগতানুগতিক কাব্যসুধার রেশ এটা বলা যায় হলফ করেই।
গুমোট জমে আছে মেঘও–
নারকেলের মালার মতো
ছোট দুই টিলার ওপরে ঝুঁকে আছে আকাশ
স্তব্ধ চরাচর, উন্মুক্ত জমি-
কাঁধে লাঙল, কৃষক এগোন নির্দ্বিধায়
মুখ রাখি নদীখাতে,
সোজা হয়ে আসে শিরদাঁড়া
বর্ষা নামে দিগন্তে–
মেতে উঠি কৃষিকাজে। (কবিতা - কৃষিকাজ)
রূপকের এমন সার্থক প্রয়োগ সহজে দেখা যায় না। বিশেষ করে এতদঞ্চলের কাব্য-কবিতায়। তবে শুধুই রূপক কিংবা দ্যোতনা নয়, রত্নদীপ দেব-এর কবিতার সতর্ক পাঠে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় অজস্র শব্দ ও শব্দদ্বিত্বের এক অসাধারণ প্রয়োগ, এক জাগলারি যা স্পর্শ করে যায় পাঠক মন। অনর্থক তো নয়ই, শব্দের কাটাকুটিও নয় - বলা ভালো শব্দের কারিকুরি যা আকছার জুড়ে আছে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তির শরীরে। গ্রন্থনামের উল্লেখ থাকা কবিতাটিও এমনই এক অনাবিল উপস্থাপন -
ছুঁয়ে দেখেছি নীহারিকা
জলের কাছে পুনর্জন্মের স্বাদ–
ভার্সিটির পথে
অন্ধকার চিবুক ধোয়া সন্ধ্যায়
তোমার নীরব নিঃশ্বাস, আর
বাকি সব অনর্থক কাটাকুটি
রাতের পালকেও এরপর
খুঁজে পাই অস্পষ্ট ঘুমের দাগ
তবু, বৃষ্টির গন্ধে
ভোরের ইশারা এলে আরও
জলসুখে নোঙর তুলি... (কবিতা - জলসুখ)।
‘অনর্থক কাটাকুটি’। কবি রত্নদীপ দেব-এর সদ্য প্রকাশিত বেশ ক’টি গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম। কবিতায় এক আলাদা পরিচিতি, ব্যতিক্রমী ধাঁচ গড়ে তুলেছেন রত্নদীপ। তাঁর লেখালেখির যবে থেকে শুরু এতদিনে আরোও বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হতে পারত। কিন্তু ক্যোয়ান্টিটি নয়, ক্যোয়ালিটিতেই তাঁর আস্থা এমন প্রতীতি জাগে। এই গুণমানের অগুনতি প্রকাশ আলোচ্য গ্রন্থে।
কিছু অনুষঙ্গকে ঘিরেই এই গ্রন্থ। তবে একমুখী বলা যাবে না বরং বলা ভালো বহুমুখী অনুষঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে কবিতাসমূহ। এক ‘তুমি’কে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে বহু কবিতা। অধরা এই ‘তুমি’র আবহে প্রকাশিত হয়েছে কবির বহু অনুভব আর অনুভূতি - ‘তুমি’রূপ নদীর কাছেই কবি বারবার হয়েছেন নতজানু, কবিকল্পনায় কবিকে ঘিরে থাকে এই ‘তুমি’র অগুনতি প্রহর। ‘তুমি’কে নিয়ে এই অনর্গল কাটাকুটিকেই হয়তো কবি অনর্থক বলতে চেয়েছেন -
রোজ নিয়ম করে সূর্য ওঠে/ তোমার মুখে,/ দু’চোখে তবু বৃষ্টির দাগ/ গাড়ির আধখোলা কাচে/ থমকে আছেন পর্যটক–/ ব্যর্থ প্রেমিকের তুমুল আনন্দ/ নদীর কাছেই এখন/ নতজানু... (কবিতা - নিজস্ব শর্তে)।
দু’হাতে বৃষ্টি মেখে/ বোতামবিহীন বিকেল নামে/ মাঝরাস্তায়,/ দলছুট মেঘ দু’চোখে/ নির্জনতার রং এঁকে দিয়ে গেলেও/ তোমার বুকে শুনি/ পুকুরপাড়ের উদ্ধত সংলাপ–.../ আমি নই/ বাদামের খোসার মতো/ ইতস্তত ঘরময় ছড়িয়ে আছে/ তোমার এক একটা প্রহর... (কবিতা - প্রহর)।
এই বৃষ্টিও এসেছে বহু কবিতায় অনুষঙ্গ হয়ে। বলা যায় কবি বৃষ্টিকে নামিয়ে এনেছেন কবিতার চলমানতায়, বৃষ্টিকথায় -
শ্রাবণের চড়া রোদেও/ মুখ গুঁজে থাকে বৃষ্টি,/ ছায়া হয়ে আসে মেঘ–/ বাতাসের স্পষ্ট আনাগোনায়/ বর্ষার আভাস এলে/ চুমুকে চুমুক রাখে মেয়েটি,/ চিবুকধোয়া শিশিরজলে/ বৃষ্টি নামে এরপর... (কবিতা - শিশির)
এভাবেই কবিতায় কবিতায় বারবার এসেছে আরোও বহু অনুষঙ্গ। যেমন জল, চাঁদ, রক্তক্ষরণ আদি। উনিশ আর বরাক তো কবির মজ্জায়। এক ভিন্নধর্মী কবিতা - সুইসাইড নোট ১, ২ ও ৩। বলা যায় এখান থেকেই কবিতার গতিপথ কিছুটা হলেও বাঁক নিয়েছে নদীর মতো - এক অনুষঙ্গ থেকে অন্য অনুষঙ্গে যেখানে শব্দাবলির গভীর প্রয়োগে সৃষ্টি হয়েছে কিছু অমোঘ পঙ্ক্তি, স্তবক। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় -
সমুদ্রের নোনা স্বাদ... (কবিতা মাঝরাতের কাব্য)।
আঠারোর তছনছ সিলেবাস
ছুঁয়ে থাকি তিরিশে...
পরকীয়া স্পর্শে তোমাকে খুঁজি
নতুন সহজপাঠে। (কবিতা - পরকীয়া)।
...দাঁড়িয়েই আছি প্ল্যাটফর্মে–
রেলগেটের নির্জনতায়
কবিতায় সাজি রেলপথ
দিনের শেষ ট্রেন থামে উঠোনের ঘাসে
কাছেই দমদম রোড... (কবিতা - রেলপথ)।
প্রায় সবগুলি কবিতাই এমন চমৎকারিত্বে ভরপুর। তবু বিশেষোল্লেখে রাখতেই হয় - কবিতার কাছে, জলসুখ, সর্বস্বান্ত মুহূর্ত, মন্থন, অদ্ভুত ক্ষয়, প্রহর, বৃষ্টি, বানভাসি (দীর্ঘ কবিতা), ঠিকানা, সাঁকো, জ্যামিতি, মহাষ্টমী, শাসন - এই কবিতাগুলিকে। সব মিলিয়ে এক নান্দনিক মননের কবিতায় সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ।
ছাপা, হার্ড বোর্ড বাঁধাই, অক্ষর/শব্দ বিন্যাস যথাযথ। শুদ্ধ আধুনিক বানানের প্রয়োগ অন্যতম উৎকর্ষ বলে প্রতীয়মান হলেও ফাঁক গলে বোধ করি থেকেই যায় দু’চারটে শেষ অবধি। এখানেও তাই হয়েছে। ৫৬টি কবিতার সমাহারে ৬৪ পৃষ্ঠার এই ভূমিকাহীন গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর শ্রদ্ধাস্পদ প্রিয় শিক্ষক শ্রী তপন রায়, ড. বিশ্বতোষ চৌধুরী, ড. রূপরাজ ভট্টাচার্য ও ড. তপোধীর ভট্টচার্যকে। পুণ্যব্রত পত্রীর প্রচ্ছদচিত্র প্রাসঙ্গিক হলেও বর্ণবিন্যাস যথাযথ মনে হয়নি। ব্লার্বে রয়েছে কবি পরিচিতি ও অতি সংক্ষিপ্ত আকারে কবির কাব্যপরিচিতি। পাঠশেষে পাঠকমনে থেকে যাবে এক অগতানুগতিক কাব্যসুধার রেশ এটা বলা যায় হলফ করেই।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - সপ্তর্ষি প্রকাশন,
কলকাতা
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৫১৬১০৬
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৫১৬১০৬
Comments
Post a Comment