Skip to main content

কবিতার হাত ধরে বইমেলায় উদ্ভাসিত জীবনের জয়গান

        কবিতার হাত ধরে বইমেলায় উদ্ভাসিত জীবনের জয়গান

 

বিপুল তরঙ্গ রে
সব গগন উদবেলিয়া
মগন করি অতীত অনাগত
আলোকে উজ্জ্বল জীবনে চঞ্চল
একি আনন্দ তরঙ্গ।

                                                            - - - - - - - - - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অসম প্রকাশন পরিষদ আয়োজিত ৩৩তম গুয়াহাটি গ্রন্থ মেলার শেষ দিনে গত ১০ই জানুয়ারি রবিবার এই ছিল মেলা চত্বরের জীবন্ত চিত্র। বছরের পর বছর জোড়া খরার শেষে এ যেন এক আশার বার্তা, জ্ঞানপিপাসু জনতার অবিশ্রান্ত উৎসাহে উদ্ভাসিত যেন এক নতুন ভবিষ্যতের সোনালি আভা। তাহলে ছাপা অক্ষরের বই এর দিন শেষ হয়ে যায়নি মোটেও ? অদূর ভবিষ্যতে তেমন সম্ভাবনা, তেমন আশঙ্কাকে এই মুহূর্তে তুড়ি মেরে নাকচ করে দেওয়া যায় নির্দ্বিধায়। অন্তত শেষ বেলার বিপুল জনতরঙ্গ সে ইঙ্গিতই দেয়।

মেলা প্রাঙ্গনের লাগামহীন জনস্রোত আর অগুনতি সব বইঘরের বিকিকিনির এমন বিরল দৃশ্য এ শহরে অন্তত দেখা যায়নি এর আগে। আর এই অনাবিল দৃশ্যের পাশাপাশি স্টল নং ৪৩/৪৪ এর দৃশ্য আবার একেবারেই ছিল ভিন্ন। বিকেল ৪টে থেকে রাত প্রায় ৮টা অবধি ভিকি পাবলিশার্সের স্টলে অনুষ্ঠিত হলো জমজমাট কবিতার আড্ডা। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন এক ঝাঁক কবি, সাহিত্যিক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েই আড্ডার খেইটি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ধরে নিলেন উত্তর পূর্বের খ্যাতনামা সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য। কবিতা তিনি পড়েননি ঠিকই তবে পরবর্তী আড্ডায় পড়বেন বলে কথা দিতে হলো তাঁকেও। কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী তো যেন মধ্যমণি হয়েই বসে রয়েছিলেন আড্ডায়। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলেন এমন নিখাদ আড্ডার অন্তর্লীন নির্যাস। পাশে অধ্যাপক প্রসূন বর্মন এবং ভিকি পাবলিশার্সের কর্ণধার সৌমেন ভারতীয়াও ছিলেন হাজির। নবীন, প্রবীণ কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্যেই ধূমকেতুর মতো হঠাৎ করে আড্ডায় এসে উপস্থিত হলেন প্রথিতযশা কবি শঙ্খশুভ্র দেববর্মন। মুহূর্তে পালটে গেল আড্ডার মেজাজ। তাঁর চমৎকার বাচন শৈলীতে আচ্ছন্ন করে রাখলেন উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের। বাচিক নৈপুণ্যে অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন কবি, সাহিত্যিক তুষার কান্তি সাহা। এক পশলা বৃষ্টির মতো অঝোর ধারায় বর্ষিত হতে লাগলো একের পর এক কবির নানা স্বাদের কবিতা। কিছু কথায় কিছু কবিতায় জমে উঠেছে তখন অনুষ্ঠান। সম্বর্ধিত হলেন অতিথি কবি। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন দুই তারকা ব্যক্তিত্ব - ঊষারঞ্জন ও শঙ্খশুভ্র। পথ চলতি বইপোকারা বই কেনা স্থগিত রেখে থমকে আছে স্টলের বাইরে। নিঃসন্দেহে এ এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য।

দুই তরুণী কবি তনুশ্রী মৈত্র ও রিমঝিম দে’র ইংরেজি কবিতা পাঠে এক অন্য অনুভূতির সৃষ্টি হলো আসরে। ভবিষ্যতে বাংলায় কবিতা লিখার প্রতিশ্রুতি দিলেন তাঁরাও। অসাধারণ সব কবিতা পড়ে শোনালেন দীপিকা বিশ্বাস, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, দেবলীনা সেনগুপ্ত, রতীশ দেব, কমলিকা মজুমদার, জ্যোতিষ দেব, সঞ্জয় চন্দ্র দাস, তিমির দে, সুব্রত চৌধুরী, পারমিতা নাগ দে, শাস্বতী ঘোষ, সুমিতা দাস, সজল পাল, তুষার কান্তি সাহা এবং  শান্তনু রায়চৌধুরী। এই মুহূর্তে উত্তর পূবের সবচাইতে নামী কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী শোনালেন তাঁর দু’টি সিরিজ-অন্তর্গত কবিতা। যথারীতি ভিন্ন স্বাদের। অনুষ্ঠানে পঠিত আগাগোড়া প্রতিটি কবিতায় যেন গাঁথা ছিল সময়ের গাথা, মানুষের কথা। এখানেই তো আড্ডার সাফল্য। এভাবেই তো আকণ্ঠ অবগাহন হয় মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চার অনাবিল সুখসাগরে এভাবেই হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক দিশাবলোকন। এরপর সঞ্জয় চক্রবর্তীর কবিতা পড়ে শোনালেন বাচিক শিল্পী জয়রাজ সিনহা। শেষপাতে পায়েসের মতো বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী গৌতম ভট্টাচার্য পড়ে শোনালেন কবিগুরুর ‘ভুল স্বর্গ’ কবিতাটি। অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল দক্ষিণ ভারতীয় কবি কার্তিকা নায়ারের কবিতার স্বকৃত বাংলা অনুবাদের আবৃত্তি। আবৃত্তি করলেন প্রণব আচার্য।

অনেক সময় ধরে চুপচাপ এক কোণে বসে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন গায়িকা সোমা মুখার্জি। উদ্যোক্তার নজরে আসতেই এবার তাঁর গান দিয়ে অনুষ্ঠান শেষের ঘোষণা হলো। ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি, বসন্ত যদি না আসে’ সোমা মুখার্জির খালি গলায় গান শেষ হতেই এবার পুরোপুরি পাল্টে গেল আড্ডার মেজাজ। সাহিত্যের হাত ধরে সংস্কৃতি এসে জাঁকিয়ে বসলো শীতের রাতের আমেজ নিয়ে। গান ধরলেন পারমিতা নাগ দে - ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’। আর যায় কোথায় ? কবি দেবলীনা সেনগুপ্ত রবীন্দ্র নৃত্যের ছন্দে এগিয়ে এলেন গুটিগুটি। আসর জমানোর ওস্তাদ জ্যোতিষ দেব এবার নাচে গানে নামলেন আসরে। লোকগানে সুর চড়ালেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস। এরই ফাঁকে এই ক’দিন ধরে স্টলের দায়িত্বে থাকা কবি, অধ্যাপক শান্তনু রায়চৌধুরীকে সম্বর্ধনাও জানানো হলো।

মধুরেণ সমাপয়েৎ - আড্ডাসভায় ধামাইল না হলে কি চলে ? হলো তাও। বহুদিন পর এমন এক আসর। প্রায় বছর জোড়া কালবেলার শেষে নির্ভেজাল আড্ডায় স্বস্তি সুখের অক্সিজেন নিয়ে শেষমেশ ঘরে ফেরার পালা। এ স্মৃতি স্থায়ী হয়ে থাকবে সবারই মানসপটে। ভিকি পাবলিশার্স ও বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজের এই উদ্যোগ ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।  

- - - - - - - - - - - - -

                                                             বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়