Skip to main content

‘প্রথম পঞ্চাশ’ - কবিতায় গ্রন্থিত সমকাল

‘প্রথম পঞ্চাশ’ - কবিতায় গ্রন্থিত সমকাল

 


‘শতাব্দীর মধ্যরাত্রিতে মানুষের মনুষ্যত্ব এখন গভীর নিদ্রায়। দিকে দিকে ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মহাসড়ক থেকে প্রতিটি গলির আনাচে কানাচে শোনা যায় জন্তু জানোয়ারের আস্ফালন। সময় বুঝে প্রকৃতি দীর্ঘদিনের নির্যাতনের প্রতিশোধে ব্যস্ত। সমাজের বুক জুড়ে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য মাকড়সা। অসহায় গান্ধারীর বুক কুরে কুরে খেয়ে বেড়ে উঠছে ওরা। যারা অভাগা তারা ভোগ বিলাসের বলি। রাত্রি ক্রমে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

সময়ের এই সংকটে কবির কবিতা কখনো কাব্যিক কল্পনা হতে পারে না, সামাজিক চালচিত্রের সে প্রতিবিম্ব মাত্র। ফুল, লতা, পাতা নিছকই বিলাসিতা। রক্তাক্ত হৃদয় নিংড়ানো লাল মসি কলমের ঠোঁটে বিষাক্ত ফেনার জন্ম দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। প্রতিবন্ধী শিশুদের চাপা আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় সমাজের শব থেকে শবান্তর’। - এভাবেই কবি সুপ্রদীপ দত্তরায় তাঁর আত্মকথায় অসামান্য বক্তব্যের মাধ্যমে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম পঞ্চাশ’-এর খেইটি ধরিয়ে দিলেন প্রথম প্রচ্ছদের ভেতরের পাতায়। সামাজিক মাধ্যমে সুপ্রদীপ দত্তরায় বহুল পরিচিত কবি। পরিচিত এবং জনপ্রিয়ও বটে। সেই সূত্রে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের চাহিদা ছিল পাঠকের দরবারে। চাকুরি জীবন থেকে অবসর নিয়েই সেই কাজটি সেরে ফেললেন ঝটিতি। সদ্য প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থের ভেতরে যেন কবি ধরে রেখেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অঙ্কিত সমকালীন অব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। যে প্রতিবাদী সত্ত্বার পরিচয় তিনি এ যাবৎ তুলে ধরেছেন পাঠকবর্গের মধ্যে তারই সার্থক প্রতিফলন তাঁর ‘প্রথম পঞ্চাশ’। বর্ষীয়ান সাহিত্যিক সুমিত্রা দত্ত ‘সবুজ সঙ্কেত’ শিরোনামে ভূমিকা লিখেছেন গ্রন্থটির। চুলচেরা বিশ্লেষণে পুরো গ্রন্থটির একটা স্পষ্ট ছবি যেন তিনি এঁকে দিয়েছেন নিপুণ শিল্পীরই মতো। পুরো ভূমিকার সারকথাটি হলো - “মন ছুঁয়ে যায়”। ৫০টি কবিতাতেই গ্রন্থের পৃষ্ঠাসংখ্যা ১২২। সহজেই অনুমেয় যে অধিকাংশ কবিতাই দীর্ঘ কবিতা। পাঠক সুপ্রদীপের এই কাব্যধারার সঙ্গে আগেই কমবেশি পরিচিত। 

প্রতিবাদী সত্ত্বার বাইরে তিনি যে একজন প্রকৃত কবিও সেই প্রমাণটি কিন্তু সুপ্রদীপ অজান্তেই তুলে ধরেছেন তাঁর প্রথম কবিতাটির মাধ্যমেই। ফুল, লতা পাতা দিয়ে এখন কবিতা হতে পারে না বললেও এই কবিতায় কবি সন্নিবিষ্ট করেছেন প্রকৃতি, ফুল (আমার শিমূলতলার সই, আমার সন্ধ্যারাতের যুঁই)। আছে পাখি, আছে শিশিরকণা, আছে বৃষ্টি - “ওই ঘুম ভাঙানিয়া কাক, আমার পিয়ার ঠোঁটে শাঁখ, ভোরের শিশিরকণা - সে যে অনেক দিনের চেনা - - -), আছে প্রেম ভালোবাসা (আমার প্রথম প্রেমের কান্তা, আমার স্বপ্ন ভাঙা শান্তা, সারা বছর বৃষ্টি ঝরাও - মিথ্যে তোমার মনটা)।

এবার ধীরে ধীরে আপন ছন্দে এগিয়ে যায় কবিতার ফল্গুধারা। প্রতিটি কবিতাই হচ্ছে কবি মনের খোলামেলা আলাপন। একাধিক কবিতায় অতিমারী সময়ের অসহায় বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে কাব্যসুষমা ও বর্ণনার অসাধারণ সংমিশ্রণে। দিন আনি দিন খাই গোছের লোকজনের চূড়ান্ত দুঃখবেলার মর্মান্তিক চিত্র এঁকেছেন অন্তর দিয়ে।  সমকালীন সমস্যারাজির প্রতিটি বিষয়কে ছুঁয়ে গেছেন কবি তাঁর নিজের মতো করেই। প্রায় প্রতিটি কবিতার শেষে ঝরে পড়েছে সামাজিক অরাজকতার বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ। অধিকাংশ দীর্ঘ কবিতার পরতে পরতে এবং শেষের চরণে কবি ধরে রেখেছেন অন্ত্যমিলের সুষমা যা নিমগ্ন পাঠক পাঠিকার পঠনে নিশ্চিতই যোগ করেছে পঠন সুখের স্বস্তি।

মন কাড়া কিছু কবিতার উল্লেখ অবশ্যই করতে হয়। যেমন - লজ্জাবতী, কনা, কাগজ, ঝড়, বৃষ্টি, তানপুরা, ইত্যাদি। কবিতার দীর্ঘ অবয়বে কবি সিদ্ধহস্ত হলেও উপরের তালিকা দেখলেই বুঝা যায় শিরোনামে তিনি সংযত। এও এক ব্যতিক্রমী ধারা। আছে এমন কিছু কবিতা যা পাঠকের হৃদয় নিংড়ে চোখের পাতা ভিজিয়ে দিতে সক্ষম। যেমন জয়া, দোয়া, বাবুমশাই, বাবা, আব্বা ইত্যাদি। ‘ধোঁয়াশা’ ও ‘বৃষ্টি’ কবিতায় কবির প্রেমিক মন সৃষ্টি করেছে অনাবিল কিছু প্রেমের ছবি। প্রকৃতপক্ষে পরিসর বিস্তৃত হলে সুপ্রদীপের প্রতিটি কবিতা নিয়েই চলতে পারে দীর্ঘ আলোচনা। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত কিছু কবিতা গ্রন্থটিকে এনে দিয়েছে এক আলাদা মর্যাদা। যেমন - আহা ইলা দিন যদি আইত, রবিঠাকুর, দাদা শুনছেন, ঝড় ইত্যাদি।

সব মিলিয়ে কবি সুপ্রদীপের কবিতায় অনবদ্য ভাবে যে কথাটি ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ভাষ্যে তা হলো অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সোজাসাপটা প্রতিবাদ। একহাত নিয়েছেন তাঁদেরও যাঁরা সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। তাই কিছু পংক্তি তিনি সাজিয়েছেন এভাবেও -

চিংড়ির মালাইকারি দাঁতে কাটতে কাটতে

দেশভাগের কবিতা লেখা যায় ? তুমিই বলো ?

(কবিতা - দলিল)

কিংবা -

রাতের আকাশটা বড় সুন্দর জানেন।

অসংখ্য তারার মধ্যে একটা হলদেটে চাঁদ -

ঘুমন্ত পৃথিবীটাকে মায়াবী মনে হয়।

যদি পূর্ণিমা হয়,

পিছনের ওই এঁদো পুকুরটা

ডাল লেকের মতো।

- - - - -  ভালো লাগে খুব, তাই না ?

কেন লাগে জানেন ?

মাথার উপরে আছে নিশ্চিত ছাদ, তাই।

যে ছাদের তলায় ঘুম আসে শান্তিতে।

যদি উড়ে যায় সেই ছাদ ? বীভৎস পরিস্থিতি,

আতঙ্কে চিৎকার করি - - -

পৃথিবীটা বড় কুৎসিত তখন।

(কবিতা - ছাদ)

এভাবেই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ স্পষ্ট বক্তব্যে কাব্যিকতায় লিপিবদ্ধ করেছেন একের পর এক অনবদ্য কবিতা। কোথাও অতিকথনে ছন্দপতনের সুযোগ রাখেননি তিনি।

শেষ প্রুফ রিডিং-এ আরোও একটু যত্নবান হলে বানান ভুলের মাত্রা হয়তো অনেকটাই কনিয়ে আনা যেত। সব মিলিয়ে অনায়াসে বলা যায় ‘প্রথম পঞ্চাশ’-এই বাজিমাত করেছেন কবি সুপ্রদীপ দত্তরায়। পাঠক মন তাই নিশ্চিতই অপেক্ষমান হয়ে রইল প্রচ্ছদে অঙ্কিত অনন্ত সব সারিবদ্ধ খিলানের মতো তাঁর পরবর্তী আরোও একাধিক ‘পঞ্চাশ’-এর পথ চেয়ে।

 

‘প্রথম পঞ্চাশ’

সুপ্রদীপ দত্তরায়।

মূল্য - ২০০ টাকা।

যোগাযোগ - ৯৪৩৫১৭৩২৭৩, ৭০০২৮৬০৭২৪।

 

- - - - বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।


Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়