Skip to main content

যুদ্ধং শরণং

 


যুদ্ধং শরণং
- - - - - - - - - আজ ক'দিন থেকেই ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা দেরি হচ্ছে। এর কারণ ঘরের ভেতরের একটা আপাত শান্ত পরিস্থিতি। । সচরাচর এমনটি থাকে না। তবে এখন পরিবেশ বেশ শান্ত - যদিও গুমোট। মাত্র দু' রাত আগেই ছিল বার্ষিক ঝগড়া সপ্তাহের সমাপ্তি অনুষ্ঠান। জমজমাট অনুষ্ঠান হয়েছে এবারও। এক সপ্তাহ ধরে তুমুল ঝগড়া, বাকবিতণ্ডার শেষে আজ দু'দিন ধরে শান্তির নীরবতা ঘর জুড়ে। প্রতি বছরই আমি নব উদ্যমে লড়াই-এর ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ি। গত বাইশটি বছর ধরে এই চলছে। এর ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু বলতে খারাপ লাগারই কথা যে এখন অবধি এই যুদ্ধে আমি বিজয়ীর হাসিটি হাসতে পারিনি। কী অফুরন্ত দম মাইরি আমার প্রতিপক্ষের। সারাটি বছর মিনিমিনিয়ে কথা বলে আর এই সপ্তাহটির জন্য বোধ করি সব দম জিইয়ে রাখে। শুধু কি আর কথা-অস্ত্রেই যুদ্ধ করে ? মোটেই নয়। নানা রকম লুকোনো অস্ত্রের ভাণ্ডার একেবারে। দিনের পর দিন প্রায় অভুক্ত থাকার এই অদম্য কৌশল কী করে যে আয়ত্ত করে এরা। আমার তো নির্ধারিত সময়ের চাইতে একটি ঘণ্টা পেরোলেই হাসপাতালে যাওয়ার উপক্রম। আর কৌশল করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরও নিজের আওতায় নিয়ে আসে আগেভাগেই। কী বুদ্ধি, কী বুদ্ধি। তো এই যুদ্ধের ইতিহাস খানিকটা জানা না থাকলে বুঝতে অসুবিধে হবে বৈকি। তখন আমার বালক বেলা। বুদ্ধির বিকাশের পালা, পৃথিবীকে জানার পালা। দিনে কয়েক ঘন্টার পাঠশালায় শিক্ষা নেওয়ার বাইরে ঘরে সর্বক্ষণের চার চারজন শিক্ষক। মা, বাবার বাইরেও এক দাদা আর এক দিদি। দিদির হাতে নান্দনিক শিক্ষার ভার আর দাদার হাতে বহির্জগতের শিক্ষা। কিন্তু সবার উপরে মা ও বাবা। গরিবের সংসারে সবদিক সামলে সুমলে বারো মাসের তেরো পার্বণের নিয়মও রক্ষা হতো গরিবি ধাঁচে। তবে এসবের জন্য আজকের মতো বাজার নির্ভরতা ছিল না তখন। কাঁচা মাল সব স্থানীয় ভাবেই মছর (জোগাড়) হয়ে যেত। তাই এসবের আয়োজনে যথাসময়ে পূর্ণ প্রস্তুতির দরকার হতো। জৈষ্ঠ আষাঢ় এলেই আম, কাঁঠাল, লিচুর সন্ধানে যেমন ব্যস্ত হয়ে পড়তাম তেমনি একটি বিশেষ পূজার অপেক্ষায় থাকতাম মনে মনে। কারণ মায়ের এই তিন দিনের সাবিত্রী পূজায় আমার হতো আয়েসি পেটপূজা। পূজার প্রস্তুতিতে ছিল আমার অগাধ ঔৎসুক্য। এক বিশেষ ধরণের ফুল (নামই নাকি সাবিত্রী ফুল) দিয়ে এবং বিভিন্ন গাছের পাতা দিয়ে সাজানো হতো চার কাঠির মধ্যেকার বৃক্ষ সদৃশ একটি বেদী এবং তারই সামনে চলতো তিন দিন ব্যাপী পুজো। সেই সাজ সজ্জা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো খুব। সম্ভবত সেটি ছিল বনবৃক্ষের আভ্যন্তরীণ রূপ। আমি মা-বাবার কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ার সুবাদে সেই পূজায় বাবার কোনও আপত্তি দেখিনি কোনও দিনই। সম্ভবত বাবার তখন যুদ্ধশেষের বয়স। পূজার চতুর্থ দিন সকালে মা ও বাবার কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান থাকতো যা আমাদের দেখা বারণ ছিল। তবে আগের দিনই নিশিকাকাকে বলে দেওয়া হতো পরদিন সকালে হালের বলদ জোড়া নিয়ে আসার জন্য। এই অনুষ্ঠানটি আমার খুব প্রিয় ছিল। সকাল হতেই ধোয়া কাপড়চোপড় পরে নিশিকাকা এসে হাজির একেবারে তাগড়া এক হাল বলদ নিয়ে। বলদের কাঁধে জোয়াল। যেন কর্ষণের জন্য তৈরি। মা পূজার সামগ্রী নিয়ে এসে গরুর পা ধুইয়ে দিতেন। তেল, সিঁদূর পরিয়ে নিজের হাতে ওদের কলা খাইয়ে দিতেন। প্রণাম করতেন। আপাত চঞ্চল গরুগুলোও কী ভেবে যেন দাঁড়িয়ে থাকতো শান্ত হয়ে। আমার অসম্ভব ভালো লাগতো। নিশিকাকারও কিছু উপার্জন হয়ে যেত এই সুবাদে। কিছু কিছু নামের সাথে তখন থেকেই পরিচয়। সাবিত্রী, সত্যবান, সৈন্ধব লবন, জুমের চাল, বাণা, মিছরি ইত্যাদি। সেই বালক বেলার দিনগুলি একদিন ফুরালো। বাবা গত হলেন কালের নিয়মে। সাতটি বছর একা থাকার পর মা-ও যাত্রা করলেন মহাপ্রস্থানের পথে। কিন্তু পরিবার ও সমাজ পরম্পরায় রয়ে গেলেন সাবিত্রী ও সত্যবান। বৌদিদের দেখানো পথ ধরে এবার আমার সহধর্মিণীটি এসে নামলেন সংসার সমরাঙ্গনে। আর এসেই আমাকে করে নিলেন টারগেট। সে থেকে এই পুজো এলেই শুরু হয় আমার মরণপণ বিরোধিতা। আর এই মরণকে রুখে দেওয়া বা ঝুলিয়ে রাখার ব্রত নিয়ে মুখোমুখি লড়াই-এ অবতীর্ণ হন তিনি প্রতিবার। নানা অস্ত্রে ঘায়েল করার উদ্দেশে আমিও কিছু কম যাই না। কিন্তু প্রতিপক্ষকে বাঁচিয়ে রাখার দায় মাথায় নিয়ে বাধ্য হই রণে ভঙ্গ দিতে (এ-ও এক বিড়ম্বনা, কাকে যে কে বাঁচাচ্ছে)। একেক বার তো মাথায় খুন চড়ে যায়। একেবারে শেষ দেখে নেওয়ার লক্ষ্যে দাপিয়ে বেড়াই রণক্ষেত্র। কিন্তু তখনই প্রতিপক্ষ তাঁর তূণীরে থাকা ব্রহ্মাস্ত্রে (চোখের জলে) আমাকে বিদ্ধ করে বিজয়ীর হাসিটি ছড়িয়ে নব উদ্যমে লেগে পড়েন পূজার আয়োজনে। আমি থলে আর ফর্দ হাতে বেরোই বাজারে - মিছরি, সৈন্ধব লবণ, ফল, জুমের চাল - - - - - । তবে দৃষ্টি এবং বোধকটু কিছু প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটিয়ছি প্রথমেই। এতটুকুই যা প্রাপ্তি। জানি না বার্ষিক এই ঝগড়া উৎসবের শেষে কার ক’দিন আয়ু বাড়ে কিংবা কমে কিন্তু কিছু শব্দ এসে তালগোল পাকিয়ে দেয় আমার চিন্তাধারাকে। ধর্ম, ধর্মভীরুতা, ধর্মান্ধ, ধর্মপ্রাণা, ধার্মিক, সংস্কার-কুসংস্কার, বিশ্বাস-অন্ধ বিশ্বাস, তাগিদ, গরজ, ঐতিহ্য, পরম্পরা, ভাব-ভক্তি, প্রেম-ভালোবাসা, আধুনিকতা। তবে ফল খাওয়া ভালো - এটা নিশ্চিত। - - - - - - - - বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।


Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়