Skip to main content

কেমন আছো তিতাস ?
















'তিতাস একটি নদীর নাম’ যদিও, তবু তিতাস এখন আর শুধুই একটি নদী মাত্র নয়। যুগন্ধর ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর হাত ধরে তিতাস এখন নদীমাতৃক অখণ্ড ভারতবর্ষ তথা অখণ্ড বাংলার সমাজদর্পণ হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের সবটুকু শর্ত না মেনেও একটি ক্লাসিকের মর্যাদা পাওয়া এই উপন্যাসটি যারাই পড়েছেন তারা তিতাসকে ভালো না বেসে পারেন না। 

আমি বয়সের সাথে রূপ পাল্টাই

নদী ঋতুর সাথে।

ঝাঁপিয়ে পড়েছি তার উদোম বুকে

সন্তরনের নবিশ যখন -

কুল ছাপানো উদ্বৃত্ত তটে, যেন

কাঁখে ধরা এক বেষ্টিত সন্তান।


এর পর ভরা শ্রাবনে

মদমত্ত যৌবন প্লাবনে

জলকেলিতে গেয়েছি প্রেমের গান,

নদী আমায় দিয়েছে উপহার

উজাড় করা ভালোবাসায় 

সন্তানসুখ প্রতিদানে নিশ্চিত পরপার। 


আজও তাই অমোঘ আকর্ষণে

ছুটে চলি নদীর পানে, 

নদী, তুমি স্থাপন করো

ভালোবাসার অপার সুখের বিশ্ব। 

কালহীন ঋতুমতী স্রোতে - 

ঋতুহীন অবিরত।

নদীর কুলুকুলু জলধারা শেষে মোহনায় বিলীন হয়ে যাওয়ার মতোই আমাদের জীবনধারা। এবং ধারাশেষে অনিবার্য মৃত্যুর মধ্য দিয়েই যেন নদীর সাথে আমাদের সখ্য, এত সাযুজ্য, এত ভালোবাসা। আমাদের নদীমাতৃক দেশের অগুনতি নদ-নদীকে পাশে সরিয়ে রেখে ভৌগোলিক সূত্রে ভিন দেশের একটি নদী - যা কিনা সেদিনও ছিল এক অখ্যাত অনামী জলধারা এবং আজ এতগুলো বছর পেরিয়েও রয়ে গেছে একই - সেই নদীটিকে নিয়ে লিখতে বসার মধ্যেও উপরোক্ত ভালোবাসার গরজটিই যে অন্যতম মুখ্য কারণ সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের গ্রাম, গঞ্জ, নদী, প্রান্তর - সে তো আমাদেরই শেকড়। কিছু আঁচড় টেনে দিলেই তো আর আলগা হয়ে যায় না জন্ম জন্মান্তরের বাঁধন। উপন্যাস পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে ভালোবেসে ফেলা সেই নদীটি আজ কেমন আছে - সে খবরটুকু রাখাও জরুরি বৈকি। এবং হাতে গোণা কয়েকটি উপন্যাস লিখেই ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের কলমে তিতাসের সার্বিক সৌন্দর্যের পুনরাবলোকন তথা রসাস্বাদনের মাধ্যমে একদিকে যেমন সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাইছি এই অনাবিল নদীকথা তেমনি নিবেদন করতে চাইছি তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। এখানে সংক্ষেপে বলে নেওয়া ভালো যে এখানে সার্বিক কথাটি উল্লেখ করার কারণ হলো এই যে একটি নদীর সৌন্দর্য শুধুমাত্র তার জলরাশি কিংবা দুই তীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উপর নির্ভর করে না। নদীর প্রাসঙ্গিকতা এবং সৌন্দর্য নির্ধারিত হয় তার জলধারার সাথে সাথে তার দুই পাড়ের জন জীবন এবং জনসম্পদের যাথার্থ্যের উপরও। সেই জলজীবনের অধ্যয়নের শেষে অদ্বৈতের তিতাসকে তাই কবিগুরুর সেই বাঁকে বাঁকে চলা হাঁটু জলের নদী কিংবা জীবনানন্দের ধানশিরিটির চাইতে কোনও অংশেই খাটো বলে মনে হয় না। 

আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা খুবই প্রাসঙ্গিক। উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিক, উপন্যাসকারের চোখে ও কলমে তিতাসের সৌন্দর্য এবং আজকের তিতাস। 

উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিক - ১৯০১ সালের ১ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার গোকর্ণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অদ্বৈত মল্লমর্মনের জন্ম। ১৯৩৩ সালে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর্থিক কষ্ট লাঘবের উদ্দেশে কলকাতায় পাড়ি জমিয়ে একে একে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। যোগ দেন ‘ত্রিপুরা’, ‘নবশক্তি’ ইত্যাদি পত্রিকায়। এরপর সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন দেশ, নবযুগ, আজাদ, মহম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায়। পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর সঙ্গেও যুক্ত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তিনি যা কিছু আয় করতেন তার অধিকাংশই ব্যয় করতেন দুস্থের সেবায়। তাই নিজের আর্থিক দুরবস্থার হাত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি কখনো। ১৯৫১ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেন এই প্রতিভাধর ঔপন্যাসিক। এর আগে মাসিক মহম্মদী পত্রিকায়ই প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর ধারাবাহিক রচনা - তিতাস একটি নদীর নাম এর তিনটি সংখ্যা। ইতিমধ্যে রাস্তায় পড়ে হারিয়ে যায় মূল পাণ্ডুলিপি। এরপর অসুস্থতা সত্ত্বেও আবার লিখেন উপন্যাসটি এবং হাসপাতালে যাওয়ার আগে তা বন্ধুদের হাতে সঁপে দিয়ে যান। তাঁর মৃত্যুর পরই এটি উপন্যাস হিসেবে প্রকাশ পায়।  

উপন্যাসটি মূলতঃ তিতাস নদী এবং তার অববাহিকায় বসবাসরত মালো সম্প্রদায়ের জীবন চরিত। উপন্যাসকার নিজে এই সম্প্রদায়ের হওয়ার সুবাদে মালোদের জীবনযাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে এক নিপুণ মুন্সিয়ানায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে উপন্যাস হিসাবে কতটুকু সফল এই রচনা ? উপন্যাসের কোনও একটি কাহিনি সরল গতি ধরে এগিয়ে যায়নি এঝানে। ডালপালা মেলেছে অবিন্যস্ত ভাবে। মোট চারটি খণ্ডে বিভক্ত এই উপন্যাসটি। প্রতিটিখণ্ডের আবার দু’টি করে অধ্যায়। প্রথম খণ্ডের দু’টি অধ্যায় হলো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং ‘প্রবাসখণ্ড’। দ্বিতীয় খণ্ডের দু’টি অধ্যায় - ‘নয়া বসত’ এবং ‘জন্ম মৃত্যু বিবাহ’। তেমনি তৃতীয় খণ্ডে ‘রামধনু’ ও ‘রাঙা নাও’ এবং চতুর্থ খণ্ডে ‘দুরঙা প্রজাপতি’ এবং ‘ভাসমান’। একটি ভাগের সঙ্গে আরেকটি ভাগের সম্পর্ক সূত্র অনেক ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অসংখ্য চরিত্র এসেছে কাহিনিরই প্রয়োজনে। কাহিনিপ্রিয় পাঠকের সরল পঠনে তাই ব্যাঘাত ঘটতেই পারে। একাগ্রতা সহকারে না পড়লে খেই হারিয়ে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। সমালোচকের চোখেও এই উপন্যাস কিছুটা অস্বস্তিকর। কিন্তু দিন শেষে নিবিড় পাঠকের কৌতূহলের কাছে হার মেনে যায় সবকিছু। প্রকৃতি, সমাজ এবং সমাজের প্রতিনিধি মানুষের অকপট জীবনদর্পণে প্রতিভাত হয়ে উঠে একটি ক্লাসিক উপন্যাসের যাবতীয় সৌন্দর্য। আপন সাহিত্য গুণে, সার্বিক উপস্থাপনায় ইতিহাসে স্থান করে নেয় - তিতাস একটি নদীর নাম।  

উপন্যাসকারের চোখে ও কলমে তিতাসের সৌন্দর্য - আগেই উল্লেখ করা হয়েছে একটি নদীর সার্বিক সৌন্দর্য শুধু তার জলধারাতেই সীমিত নয়। তার অববাহিকা জুড়ে মানব জীবন এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যতেই নদীর সৌন্দর্য। এখানেই অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাজিমাত করেছেন। ঋতুভেদে এবং অঞ্চলভেদে স্বল্প কথায় লিপিবদ্ধ করেছেন তিতাসের তৎকালীন রূপ। কখনও প্রকৃতি তো কখনো তার দুই পারের গ্রাম জনপদের সার্বিক চিত্র। 

উপন্যাসের সূচনাতেই সেই কাজটি সুনিপুণ শব্দবিন্যাসে গ্রথিত করেছেন উপন্যাসকার - “তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। 

মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যুদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণ পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্টু পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বউ নিয়া মাঝি কোনোদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।

তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।“ - একটি মাঝারি নদীর এমন অনাবিল বর্ণনায় পাঠক ইতিমধ্যেই উপন্যাসে মজে গেছেন বিলক্ষণ। কিন্তু এর পরেও আছে - “ কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারীদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংশাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্তলড়াইয়ে মাতিয়াছে - উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে, হাতী ঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়তো তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটি নদী। 

তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই। 

ঝরণা থেকে জল টানিয়া, পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনকালে সে পায় নাই। অসীম সাগরের বিরাট চুনবনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোনকালে কোন অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল; বাঁ তীরটা একটু মচকাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি খুঁজিয়া কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে। এক পাকে শত শত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল, অনেক মাঠ ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে - মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়। এই তার ইতিহাস। কিন্তু সে কি আজকের কথা ? কেউ মনেও করে না কিসে তার উৎপত্তি হইল। শুধু জানে সে একটি নদী। অনেক দূরপাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমণীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক - কিন্তু কাঁকনের মতোই তার বলয়াকৃতি।”

এ যাবৎ তিতাসের নদীবৃত্তান্ত এবং ইতিহাস বর্ণিত হলো সংক্ষেপে। এবার একই ধারাবাহিকতায় এসে পড়ে তার কূলের কাহিনি - “অনেক নদী আছে বর্ষার অকুণ্ঠ প্লাবনে ডুবিয়া তারা নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পারের কোন হদিশ থাকে না, সব দিক একাকার। কেউ তখন বলিতে পারে না এখানে একটি নদী ছিল। সুদিনে আবার তাদের উপর বাঁশের সাঁকোর বাঁধ পড়ে। ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়িরা পর্যন্ত একখানা বাঁশে হাত রাখিয়া আরেকখানা বাঁশে পা টিপিয়া টিপিয়া পার হইয়া যায়। ছেলে-কোলে নারীরাও যাইতে পারে। নৌকাগুলি অচল হয়। মাঝিরা কোমরে দড়ি বাঁধিয়া সেগুলিকে টানিয়া নেয়। এপারে ওপারে ক্ষেত। চাষীরা দিনের রোদে তাতিয়া কাজ করে। এপারের চাষী ওপারেরজনকে ডাকিয়া ঘরের খবর জিজ্ঞাসা করে। ওপারের চাষী ঘাম মুছিয়া জবাব দেয়। গরুগুলি নামিয়া স্নান করিতে চেষ্টা করে। অবগাহন স্নান। কিন্তু গা ডোবে না। কাক-স্নান মাত্র করা সম্ভব হয় কোনরকমে। নারীরা কোমরজলে গা ডুবাইবার চেষ্টায় উবু হইয়া দুই হাতে ঢেউ তুলিয়া নীচু করা ঘাড়ে-পিঠে জল দিয়া স্নানের কাজ শেষ করে। শিশুদের ডুবিবার ভয় নাই বলিয়া মায়েরা তাদের জলে ছাড়িয়া দিয়াও নিরুদ্বেগে বাসন মাজে, কাপড় কাচে আর এক পয়সা দামের কার্বলিক সাবানে পা ঘষে। অল্প দূরে ঘর। পুরুষমানুষে ডাক দিলে এখান হইতে শোনা যাইবে, তাই ব্যস্ততা নাই। 

কিন্তু সত্যি কি ব্যস্ততা নাই ? যে মানুষটা এক-গা ঘাম লইয়া ক্ষেতে কাজ করিয়া বাড়ি গেল, তার ভাত বাড়িয়া দিবার লোকের মনে ব্যস্ততা থাকিবেই তো। দুপুরে নারীরা ঘাটে বেশি দেরি করে না। কিন্তু সকালে সন্ধ্যায় দেরি করে। পুরুষেরা এর জন্য কিছু বলে না। তারা জানে এ নদী দিয়া কোন সদাগরের নৌকার আসা যাওয়া নাই।”

আমি বয়সের সাথে রূপ পাল্টাই

নদী ঋতুর সাথে 

- ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তিতাসও রূপ পালটায়। উপন্যাসকারের হাত ধরে বজায় থাকে ধারাবাহিকতা - “শীতে বড় কষ্ট। গম গম করিয়া জলে নামিতে পারে না। জল খুব কম। সারা গা তো ডুবেই না, কোমর অবধিও ডোবে না। শীতের কনকনে ঠাণ্ডা জলে হুম করিয়া ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিবার উপায় নাই; একটু একটু করিয়া শরীর ভিজে। মনে হয় একটু একটু করিয়া শরীরের মাংসের ভিতর ছুরি চালাইতেছে কেউ। চৈত্রের শেষে খরায় খাঁ খাঁ করে। এতদিন যে জলটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাও একটু একটু করিয়া শুষিতে শুষিতে একদিন নিঃশেষ হইয়া যায়। ঘামের গা ধুইবার আর উপায় থাকে না। গোরুরা জল খাইতে ভুল করিয়া আসিয়া ভাবনায় কাতর হয়। মাঘের মাঝামাঝি সর্ষে ফুলে আর কড়াইমটরের সবুজিমায় দুই পারে নকশা করা ছিল। নদীতেও ছিল একটু জল। জেলেরা তিন-কোণা ঠেলা জাল ঠেলিয়া চাঁদা, পুঁটি, টেংরা কিছু কিছু পাইত। কিন্তু চৈত্রের খরায় এসবের কিছুই থাকে না। মনে হয় মাঘ মাসটা ছিল একটা স্বপ্ন। চারিদিক ধু-ধু করা রুক্ষতায় কাতরায়। লোকে বিচলিত হয় না। জানে তারা, এসময় এমন হয়।”

উপন্যাসের শুরুতেই এই অসামান্য ভূমিকায় খেই ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে যেন একটি নদীমাতৃক চিত্রকল্পের। পাঠক নিশ্চিত এতক্ষণে নদীপথে তিতাসের একটি বলয়পাক ঘুরে আসতে প্রস্তুত। তবে তাই হোক। বিভিন্ন পর্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস-এর একটি রূপকল্পের সন্ধানে নদীপথে ঘুরে আসা যাক। 

“বাংলার বুকে জটার মতো নদীর প্যাঁচ। সাদা, ঢেউ-তোলা জটা। কোন মহাস্থবিরের চুম্বন-রসসিক্ত বাংলা। তার জটাগুলি তার বুকের তারুণ্যের উপর দিয়া সাপ খেলানো জটিলতা জাগাইয়া নিম্নাঙ্গের দিকে সরিয়া পড়িয়াছে। এ সবই নদী। 

সবগুলি নদীর রূপ এক নয়। বড় নদীতে সওদাগরের নৌকা আসে পাল উড়াইয়া - - -  জেলেরা সারাদিন নৌকা লইয়া ভাসিয়া থাকে। নৌকায় রাঁধে, খায়, ঘুমাইয়া থাকে। মাছ ধরে। সব মিলিয়ে একটা কঠোর রূপ এখানে প্রকটিত। - - - = ভাঙ্গাগড়ার এক রুদ্র দোলার দোলনায়- করাল এক চিত্তচঞ্চল ক্ষিপ্ত আনন্দ - - -  সেই এক ধরণের শিল্প।   

শিল্পের আরেকটা দিক আছে। সৌম্যশান্ত, করুণ, স্নিগ্ধ প্রসাদগুণের মাধুর্যে রঞ্জিত এ শিল্প। - - - এ শিল্পের শিল্পী মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করিয়াছে। এ শিল্পী যে ছবি আঁকে তা বড় মনোরম। তীর ঘেঁষিয়া সব ছোট ছোট পল্লী। তারপর জমি। তাতে অঘ্রাণ মাসে পাকা ধানের মৌসুম। মাঘ মাসে সর্ষেফুলের অজস্র হাসি। তারপর পল্লী। ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে জীবন্ত ছবি। মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে। বৌ-ঝিরা সব কলসী লইয়া ডুব দেয়। পরক্ষণে ভাসিয়া উঠে। অল্প দূর দিয়া নৌকা যায়, একের পর এক। কোনটাতে ছই থাকে, কোনটাতে থাকে না। কোন কোন সময় ছইয়ের ভিতর নয়া বউ থাকে। বাপের বাড়ি থেকে স্বামী তার বাড়িতে লইয়া যায়। তখন ছইয়ের এপারে ওপারে থাকে বউয়েরই শাড়ি কাপড়ের বেড়া। স্বামীর বাড়ি থেকে যখন বাপের বাড়ি যায় তখন কিন্তু কাপড়ের বেড়া থাকে না। থাকে না তার মাথায় ঘোমটা। ছইয়ের বাহিরে বসিয়া ঘাটগুলির দিকে চাহিয়া থাকে। সে। স্বামীর বাড়ির ঘাট অদৃশ্য না হইলে কিন্তু সে ছইয়ের বাইরে আসে না।” 

কী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। এভাবেই নদীর অনুষঙ্গ ধরা দেয় ঔপন্যাসিকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে। তাঁর গভীর মননে প্রতিভাত হয় নদী সৌন্দর্যের একাধিক রূপ।

“নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে, কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই। নদীরও বহার শেষ নাই। কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বহিয়াছে। তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে। কত মানুষ মরিয়াছে। - - - তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে। তার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের কত কান্নার রোল উঠিয়াছে। কত অশ্রু আসিয়া তার জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে। কত বুকের কত আগুন, কত চাপা বাতাস তার জলে মিশিয়াছে। কত কাল ধরিয়া এ-সব সে নীরবে দেখিয়াছে, দেখিয়াছে আর বহিয়াছে। আবার সে দেখিয়াছে কত শিশুর জন্ম, দেখিয়াছে আর ভাবিয়াছে। বারি নিগ্রহের নিগড়ে আবদ্ধ এই অজ্ঞ শিশুগুলি জানে না, হাসির নামে কত বিষাদ, সুখের নামে কত ব্যথা, মধুর নামে কত বিষ তাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে।

- - - মালোদের ঘরের আঙিনা থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ, সে সবই গিয়া মিশিতেছে তিতাসের জলে। সে সব পথ ছোট ছোট। পথের এধার থেকে বুকের শিশু কাঁদিয়া উঠিলে ওধার থেকে মা টের পায়। এধারের তরুণীর বুকের ধুকধুকানি ওধারের নৌকার মাচানে বসিয়া মালোদের তরুণরা শুনিতে পায়। এ পথ অতি খর্ব। দীর্ঘ পথ গিয়াছে মাঝ-তিতাসের বুক চিরিয়া। সে পথে চলে কেবল নৌকা।

তিতাস সাধারণ একটি নদী মাত্র। কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না। কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই। কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই ?

পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বউ-ঝিদের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে। সেই ইতিহাস হয়তো কেউ জানে, কেউ জানে না। তবু সে ইতিহাস সত্য। - - - আর সত্য তিতাস তীরের লোকেরা। তারা শীতের রাতে - - -  এক ছুটে আসে তিতাসের তীরে। - - - নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ জলের উপর মাঘের মৃদু বাতাস ঢেউ তুলিতে পারে না। জলের উপরিভাগে বাস্প ভাসে - দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া। তারা সে ধোঁয়ার নীচে হাত ডোবায়, পা ডোবায়। অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয়। কাঁথার নীচের মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকু না পাইলে  তারা যে কী করিত।

শরতের আকাশের মেঘগুলিতে জল থাকে না। কিন্তু ৎইতাসের বুকে থাকে ভরা জল। তার তীরের ডুবো মাঠময়দানে সাপলা-শালুকের ফুল নিয়া, লম্বা লতানে ঘাস নিয়া আর বাড়ন্ত বর্ষার ধান নিয়া থাকে অনেক জল। ধানগাছ আর সাপলা-শালুকের লতাগুলির অনেক রহস্য নিবিড় করিয়া রাখিয়া এ জল আরও কিছুকাল স্তব্ধ হইয়া থাকে। তারপর শরৎ শেষ হইয়া আসে। কে বুঝি বৃহৎ চুমুকে জল শুষিতে থাকে। বাড়তি জল শুকাইয়া গিয়া তিতাস তার স্বাভাবিক রূপ পায়। যে মাটি একদিন অথৈ জলের নীচে ৎহাকিয়া মাখনের মতো নরম হইয়া গিয়াছিল, সে মাটি আবার কঠিন হয়। আসে হেমন্ত।”

এভাবেই ঋতুর সাথে সাথে, অবস্থানের সাথে সাথে রূপ পালটায় তিতাস আর উপন্যাসের পৃষ্ঠা জুড়ে অরূপ লেখনীতে ফুটে উঠে তার অপরূপ সৌন্দর্য - তার নিজের রূপ সৌন্দর্য, তার দু’কূল ব্যাপী মানব জীবনের জীবনগাথা। জলে স্থলে মিলে পরিপূর্ণ তিতাসের অসামান্য এই গাথা পাঠকের মনকেও দোলা দিয়ে যায় নিরন্তর। হেমন্তের পর - “আসে বসন্ত। এই সময় মাঠের উপর রঙ থাকে না। তিতাসের তীর ছুঁইয়া যাদের বাড়ি ঘর তারা জেলে। তিতাসের মাছ ধরিয়া তারা বেচে, খায়। তাদের বাড়ি পিছু একটা করিয়া নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। 

বসন্ত এমনি ঋতু - এই সময় বুঝি সকলের মনে প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। জেলেরা নিজে রঙ মাখিয়া সাজে - তাতেই তৃপ্তি পায় না। যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে তাদেরও সাজাইতে চায়। - - - তখন আকাশে রঙ, ফুলে ফুলে রঙ, পাতায় পাতায় রঙ। রঙ মানুষের মনে মনে। তারা তাদের নৌকাগুলিকেও সাজায়। বউ-ঝিরা ছোট থলিতে আবীর নেয়, আর নেয় ধানদূর্বা। জলে পায়ের পাতা ডুবাইয়া থালিখানা আগাইয়া দেয়। নৌকাতে যে পুরুষ থাকে সে থালির আবীর নৌকার মাঝের গুরায় আর গলুইয়ে নিষ্ঠার সহিত মাখিয়া দেয়। ধানদূর্বাগুলি দুই অঙ্গুলি তুলিয়া ভক্তিভরে আবীর মাখানো জায়গাটুকুর উপরে রাখে। এই সময় বউ জোকার দায়। সে আবীরের রাগে তিতাসের বুকেও রঙের খেলা জাগে। তখন সন্ধ্যা হইবার বেশি বাকি নাই। তখনও আকাশ বন রঙিন - তিতাসের বুকের আরসিতে যে আকাশ নিজের মুখ দেখে সেই আকাশ। 

চৈত্রের খরার বুকে বৈশাখের বাউল বাতাস বহে। সেই বাতাস বৃষ্টি ডাকিয়া আনে। আকাশে কালো মেঘ গর্জায়। লাঙ্গল-চষা মাঠ-ময়দানে যে ঢল হয়, ক্ষেত উপচাইয়া তার জল ধারা স্রোতে বহিয়া তিতাসের উপর আসিয়া পড়ে। মাঠের মাটি মিশিয়া সে জলের রঙ হয় গেরুয়া। সেই জল তিতাসের জলকে দুই এক দিনের মধ্যেই গৈরিক করিয়া দেয়। সেই কাদা মাখা ঠাণ্ডা জল দেখিয়া মালোদের কত আনন্ত। মালোদের ছোট ছোট ছেলেদেরও কত আনন্দ। মাছগুলি অন্ধ হইয়া জালে আসিয়া ধরা দেয়। ছেলেরা মায়ের শাসন না মানিয়া কাদাজলে দাপাদাপি করে। এই শাসন-না-মানা দাপাদাপিতে কত সুখ। খরার পর শীতলের মাঝে গা ডুবাইতে কত আরাম।”

জলে মানুষে এভাবেই বারবার মিশে গেছে গোটা উপন্যাস জুড়ে। তিতাসের অপরূপ রূপ লাবণ্যে অনুসন্ধিৎসু পাঠক মনে জেগে উঠে নদীর প্রতি এক নিখাদ ভালোবাসা। তিতাসের সেই লাবণ্য যেন আলেয়ার মতো কাছে ডাকে পাঠককে। কিন্তু সে তো কবেকার কথা। সেই তিতাস এখন কেমন আছে ? বড় সাধ জাগে মনে একটিব্র ছুটে যাই সেই তিতাস পারের মালোদের গাঁয়ে। হারিয়ে যাই সেই অনাবিল দিন যাপনে। 

আজকের তিতাস - কালের স্রোতে এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে তিতাসের সেই সৌন্দর্য, সেই জৌলুস। কঠোর বাস্তব এসে দূরে ঠেলে দিয়েছে তিতাসের রূপমাধুরী। সেই সাদামাটা তিতাস - যার ছিল না কোন ইতিহাস, ছিল না কোন গৌরব, যে নদী পাহাড়ের বুক চিরে, পাথরের মাথায় মাথায় নেচে নেচে বনহরিণীর চলার ছন্দে নীচে নামেনি, যার জলরাশি তার উন্মত্ত উল্লাসে খলবল করেনি, পাক খেয়ে খেয়ে মত্ত মহিষের মত অন্ধ বেগে ছুটেনি কিংবা যে নদী আচমকা বানেও ভাসিয়ে লন্ডভন্ড করেনি দু’কূলের জনজীবন, যে নদীর পাড়বাসীদের উদ্বেগকুল ও উৎকন্ঠিত চিত্তে কোন দিন বলতে হয়নি-নদীর ধারে বাস, ভাবনা বার মাস সেই নদী - তিতাস এখনও সব দিক দিয়েই এক শান্ত, সৌম্য ও মাতৃময়ী নদী - যদিও জৌলুস হারিয়ে আজও এক সাদামাটা নদী।

বর্তমান তিতাস নদী বাংলাদেশের নাসিরনগরের চাতলপারের নিকট মেঘনা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে পূর্ব-দক্ষিণ মুখে প্রবাহিত হয়ে চান্দুরা গ্রাম হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ঘেষে আখাউড়া রেল-জংশনের দক্ষিণ-পশ্চিম-উত্তর মুখে নবীনগরের পশ্চিমে আশুগঞ্জের লালপুরের নিকট মেঘনা নদীতে এবং মানিকনগর আর কৃষ্ণনগরের মধ্যবর্তী এলাকা চিত্রি হয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। নদীটি বর্তমানে এদেশের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে প্রবাহিত হাওড়া নদীর সঙ্গমস্থলে এবং কৃষ্ণনগরের অদূরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ত্রিপুরায় উৎপত্তি হয়ে হাওড়া নদী গঙ্গাসাগর থেকে ৫ মাইল পূর্ব দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রবেশ করে পশ্চিম-উত্তর মুখী গতি ধারণ করে আখাউড়ার কিছু দক্ষিণে তিতাস নদীর সঙ্গে মিশেছে। বাংলাদেশের নাসিরনগর, সরাইল, ব্রাহ্মণবড়িয়া সদর, আখাউড়া, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে তিতাস প্রবাহিত। এর তীরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। 

মেঘনা থেকে উৎপত্তি হয়ে মেঘনাতেই বিলীন তিতাস নদী বর্তমান অবস্থায় আসার আগে আরো কয়েকবার তার গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। তিতাস একটি প্রচীন নদী। মানুষের জীবন যাত্রা ও ভূমি গঠনে এ নদীর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। তিতাস নদীর ধারা যদিও পরিবর্তিত হয়েছে একাধিকবার, তথাপিও এর উপ ও শাখা নদী চোখে পড়ে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বুড়িগঙ্গা, লোহুর, শালদা, ছোট সোনাই, বড় সোনাই, বিজনা সালিয়া ইত্যাদি। 

কিন্ত সেই তিতাস এখন আর নেই। আগের মত চঞ্চলা আর অবাধ গতি নয়। জায়গায় জায়গায় তার পায়ে বেড়ি পড়েছে, বাধার প্রাচীর খাড়া হয়েছে চলার পথে। আখাউড়া রেলসেতু থেকে শুরু করে উজানিসার সিএনডবি সেতু পর্যন্ত প্রায় ৫ মাইল এলাকা তিতাসের মর্মজ্বালার স্থান। সুদিনে গেলে সেখানে ইরি-বোরোর মাঠ। নদীর নাম নিশানা নেই, চিহ্নও নেই। নদীর স্বাভাবিক গতিধারা বন্ধ হওয়ায় কৃষি জমিতে সেচের পানির অভাব পড়েছে, বন্যার আশংকা বেড়েছে, বিঘ্নিত হচ্ছে নৌ চলাচল এবং মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নৌ-বাণিজ্য।

পলি জমে জমে ভরে গেছে তিতাসের বুক। নদী ভরাট হবার ফলে স্রোতধারা সংকুচিত হবার কারণে ষ্টীমার চলেনা, লঞ্চ চলে না, এমনকি বড় বড় মালবাহী নৌকার চলাচলও কঠিন হয়ে উঠেছে। গোকর্ণঘাটের কাছ থেকে দক্ষিণে চারগাছ বাজার পর্যন্ত ৪ মাইল এলাকায় নদীর মাঝে চর পড়েছে। এভাবে চর জাগতে থাকলে এক দিন মজে যাবে নদী - কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের সেই অপরূপা নদী বেঁচে থাকবে শুধু উপন্যাসেরই পরতে পরতে। 

- - - - - - - - - - -

কৃতজ্ঞতা - 

১। দেশ দর্শন প্রতিবেদন, আন্তর্জাল। 

২। তিতাস একটি নদীর নাম - অদ্বৈত মল্লবর্মণ। 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়