সাহিত্যিক সজল পাল-এর ‘ছোটদের গল্প সংকলন - অল্যলকম গন্প’। প্রকাশক - ভিকি পাবলিশার্স, গুয়াহাটি।
আলোচনায় উঠে আসার মূল কারণ - এর বিষয় বৈচিত্র।
একজন সফল শিশু সাহিত্যিক যে কী অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী হয়ে, শিশু মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করে ঋদ্ধ করেন শিশু সাহিত্যের মতো এক জটিল এবং ব্যতিক্রমী ধারার সৃষ্টিসম্ভার তা এই গল্প সংকলনটি না পড়লে অনুধাবন করা মুশকিল। সচরাচর অনুচ্চারিত, অনাস্বাদিত - শিশু মনের কিছু অনবদ্য বিষয়কে সহজ সরল করে এমন ভাবে বিন্যস্ত করেছেন যে সব বয়সের পাঠক পাঠিকার কাছে এই সংকলন হয়ে উঠেছে এক নিবিড় পাঠের উপকরণ।
লেখক এই বইটি ‘উৎসর্গ’ নয়, ‘উপহার’ দিয়েছেন পুত্র সায়ন্তন (সায়ন)কে। পূর্বাভাষে আরেক নামী সাহিত্যিক মানিক দাস বেশ কয়েকটি গল্পের সূত্র ধরে পাঠকবর্গকে সুচারুভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থকারের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে। বিচিত্র সব চিন্তাশক্তির সুনিপুণ প্রয়োগের খেইটি ধরিয়ে দিয়েছেন প্রাঞ্জল কথায়।
মোট আঠারোটি গল্পের সমাহার এই গ্রন্থে। মগ্ন পাঠে একটির পর একটি গল্প অনায়াসে পড়ে ফেলা যায় সুস্বাদু খাবারের গলাধঃকরণের মতো। পশুপাখির জগতের সঙ্গে শিশুদের যে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে রচিত হয়েছে একাধিক গল্প। আবার প্রতিটি গল্পের মধ্যে গল্প ছাড়াও যে রয়েছে এক একটি বার্তা সেই গরজটুকু কোনওভাবেই এড়িয়ে যায় না পাঠকের চোখ। এখানেই প্রতিটি গল্পের সার্থকতা। তাই অনায়াসে বলা চলে গ্রন্থের প্রতিটি গল্প শুধু শিশুদের ‘নিয়ে’ই নয়, শিশুদের ‘জন্য’ও।
প্রথম দিকের কয়েকটি গল্প - ‘ধন্যবাদ তোমাদের’, ‘বেটা জ্যায়সা বন্দর’, ‘খাঁচার বাইরে’, ‘হনুর মানুষ হওয়া’, ‘মিয়াঁও এবং চিয়াঁও’ এবং ‘মিয়াঁও’ পশুপাখির জগতের সঙ্গে শিশুদের আত্মিক যোগসূত্র কথারই উচ্চারণ। কয়েকটি গল্প আবার শুধুমাত্র ভাষার খেলায় জমে উঠেছে দারুণ ভাবে। মানুষের নাম, নামের বিড়ম্বনা এবং কথ্য ভাষার চতুরতায় অসাধারণ ‘উপাদেয়’ হয়ে উঠেছে গল্প - ‘ঝামেলার একশেষ’ - ১, ২ ও ৩, ‘টা টা ইবা ইবা’, পমমআ ও এমএলএ’ ইত্যাদি।
‘হনুর মানুষ হওয়া’, ‘ধরা যাক গাঁজাখুরি’ এবং ‘প্রতিভার নেপথ্যে’ জাতীয় গল্পে লেখক সমাজের কিছু অন্ধ বিশ্বাস এবং কুসংস্কারকে তার ভাষার চাবুকে ধরাশায়ী করে শিশুমনে যে বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন তার তুলনা হয় না।
গ্রন্থের শিরোনাম অনুযায়ী রয়েছে একটি গল্প। ‘অল্যলকম গন্প’। দুই সহপাঠী শিশু বন্ধুর মধ্যে একজনের ‘ল’ এবং অন্যজনের ‘ন’ অক্ষর উচ্চারণ করতে না পারা জনিত বিড়ম্বনা নিয়ে লিখা হয়েছে এই অনবদ্য হাসির গল্পটি। কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা গেল না।
সহপাঠী বন্ধু একজনের নাম লাল্টু লস্কর যে কিনা ‘ল’কে ‘ন’ বলে। আবার অন্য বন্ধু নান্টু নস্কর ‘ন’কে ‘ল’ বলে। এবার উদ্ধৃতি - “সেদিন স্কুল পরিদর্শক এলেন স্কুলে। সঙ্গে ছায়ার মতো সারাক্ষণ লেগে আছেন প্রধান শিক্ষক চন্দন নন্দী। - - - এক সময় এল লাল্টুর পালা। পরিদর্শক জানতে চাইলেন - তোমার নাম কী ?
লাল্টু বলল - নান্টু নস্কর।
প্রধান শিক্ষক গলা নামিয়ে জানিয়ে দিলেন - তার নাম আসলে লাল্টু, লাল্টু লস্কর। মানে ল-রে ন কয় আরকি - - -
পরিদর্শক বললেন - তাই নাকি ? আচ্ছা লাল্টু, এবার পাঁচটা রঙের নাম কও দেখি ?
লাল্টুর জবাব - নান, নীন, কমনা, হনুদ - - -
- থাক, হইছে। পাঁচটা ফুলের নাম কও -
- ফুন ? গোনাপ, শেফানি, শাপনা, শিমূন, পনাশ।
পাশেই বসে আছে নান্টু। অতএব এবার নান্টুর পালা। প্রথামতো প্রথমে নামটা জানতে চাইলেন পরিদর্শক। নান্টুর জবাব - লাল্টু লস্কর।
প্রধান শিক্ষক এবারও নিচু গলায় বললেন - অর আসল নাম হইছে নান্টু নস্কর স্যার। মানে ন-রে ল কয়।
পরিদর্শক একবার প্রধান শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে তারপর নান্টুর কাছে জানতে চাইলেন - তোমার স্কুলের নামটা কী কও দেখি ?
নান্টু বলল - জালি, তিললাথ লিম্ল বুলিয়াদি বিদ্যা লিকেতল।
- ভাল ভাল। তোমার প্রধান শিক্ষকের নাম কী ?
- মাললীয় শ্রীযুত চলদল ললদী।
- বাঃ পাঁচজন কবির নাম কও তো ?
- রবীলদ্রলাথ, লজরুল, জীবলালদ, সুকালত আর ইসে হ্যা - রজলীকালত।
- এ বয়সে জ্ঞান তো ভালোই, শুধু - ।”
গল্পকার সজল পাল এভাবেই বিভিন্ন ভাবে খেলার ছলে,
হাস্যরসে গল্পগুলোকে করে তুলেছেন শিশুমনের উপযুক্ত। ১৩০ পৃষ্ঠার সমগ্র বইটির
অধ্যয়নে মনের মধ্যে একটা ভাবনার উদ্রেক হয়। এই বইটি শিশুদের জন্য অবশ্য-পাঠ্য একটি
বই। কিন্তু ক’টি শিশুর কাছে পৌঁছাচ্ছে এই বই, এই বার্তা ? একের পর এক গল্পে
একাধারে ভাষার চাকচিক্য, বিষয়ের সুচিন্তিত প্রয়োগ ও অভিনবত্ব, উপযুক্ত বার্তা,
গল্পের সরল স্বচ্ছন্দ গতি পাঠক মনে উদ্রেক করে তীব্র পঠনস্পৃহা। কিন্তু ক’টি শিশু
আর বাংলায় শিক্ষাদীক্ষা চালিয়ে যেতে পারছে বা যাচ্ছে যে এই কল্পজগতের আস্বাদটুকু
উপলব্ধি করতে পারবে ?
সবকিছু মিলিয়ে এক কথায় ছোটদের জন্য দারুণ এক সংকলন উপহার দিয়েছেন লেখক। বোর্ড বাঁধাইয়ে ঝকঝকে ছাপার কাজ। বানান ভুল নিতান্তই নগণ্য যদিও গ্রন্থ কিংবা সেই লাল্টু-নান্টুর গল্পের নামটি কিন্তু ‘অল্যলকম গন্প’ না হয়ে ‘অল্যরকম গন্প’ হলে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো বলে মনে হয়। উপযুক্ত প্রচ্ছদ এঁকেছেন গল্পকার নিজেই - যেহেতু তিনি একজন সাহত্যিকের বাইরে একজন কারু এবং চিত্র শিল্পীও।
যেখানে শিশু সাহিত্যের উপর পুস্তকাদির নিতান্তই অভাব এই অঞ্চলে সেখানে গল্পকার সজল পালের এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য নিবেদন।
‘অল্যলকম গন্প’
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮৭৬৮৩৬১৮৩
- - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
একজন সফল শিশু সাহিত্যিক যে কী অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী হয়ে, শিশু মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করে ঋদ্ধ করেন শিশু সাহিত্যের মতো এক জটিল এবং ব্যতিক্রমী ধারার সৃষ্টিসম্ভার তা এই গল্প সংকলনটি না পড়লে অনুধাবন করা মুশকিল। সচরাচর অনুচ্চারিত, অনাস্বাদিত - শিশু মনের কিছু অনবদ্য বিষয়কে সহজ সরল করে এমন ভাবে বিন্যস্ত করেছেন যে সব বয়সের পাঠক পাঠিকার কাছে এই সংকলন হয়ে উঠেছে এক নিবিড় পাঠের উপকরণ।
লেখক এই বইটি ‘উৎসর্গ’ নয়, ‘উপহার’ দিয়েছেন পুত্র সায়ন্তন (সায়ন)কে। পূর্বাভাষে আরেক নামী সাহিত্যিক মানিক দাস বেশ কয়েকটি গল্পের সূত্র ধরে পাঠকবর্গকে সুচারুভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থকারের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে। বিচিত্র সব চিন্তাশক্তির সুনিপুণ প্রয়োগের খেইটি ধরিয়ে দিয়েছেন প্রাঞ্জল কথায়।
মোট আঠারোটি গল্পের সমাহার এই গ্রন্থে। মগ্ন পাঠে একটির পর একটি গল্প অনায়াসে পড়ে ফেলা যায় সুস্বাদু খাবারের গলাধঃকরণের মতো। পশুপাখির জগতের সঙ্গে শিশুদের যে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে রচিত হয়েছে একাধিক গল্প। আবার প্রতিটি গল্পের মধ্যে গল্প ছাড়াও যে রয়েছে এক একটি বার্তা সেই গরজটুকু কোনওভাবেই এড়িয়ে যায় না পাঠকের চোখ। এখানেই প্রতিটি গল্পের সার্থকতা। তাই অনায়াসে বলা চলে গ্রন্থের প্রতিটি গল্প শুধু শিশুদের ‘নিয়ে’ই নয়, শিশুদের ‘জন্য’ও।
প্রথম দিকের কয়েকটি গল্প - ‘ধন্যবাদ তোমাদের’, ‘বেটা জ্যায়সা বন্দর’, ‘খাঁচার বাইরে’, ‘হনুর মানুষ হওয়া’, ‘মিয়াঁও এবং চিয়াঁও’ এবং ‘মিয়াঁও’ পশুপাখির জগতের সঙ্গে শিশুদের আত্মিক যোগসূত্র কথারই উচ্চারণ। কয়েকটি গল্প আবার শুধুমাত্র ভাষার খেলায় জমে উঠেছে দারুণ ভাবে। মানুষের নাম, নামের বিড়ম্বনা এবং কথ্য ভাষার চতুরতায় অসাধারণ ‘উপাদেয়’ হয়ে উঠেছে গল্প - ‘ঝামেলার একশেষ’ - ১, ২ ও ৩, ‘টা টা ইবা ইবা’, পমমআ ও এমএলএ’ ইত্যাদি।
‘হনুর মানুষ হওয়া’, ‘ধরা যাক গাঁজাখুরি’ এবং ‘প্রতিভার নেপথ্যে’ জাতীয় গল্পে লেখক সমাজের কিছু অন্ধ বিশ্বাস এবং কুসংস্কারকে তার ভাষার চাবুকে ধরাশায়ী করে শিশুমনে যে বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন তার তুলনা হয় না।
গ্রন্থের শিরোনাম অনুযায়ী রয়েছে একটি গল্প। ‘অল্যলকম গন্প’। দুই সহপাঠী শিশু বন্ধুর মধ্যে একজনের ‘ল’ এবং অন্যজনের ‘ন’ অক্ষর উচ্চারণ করতে না পারা জনিত বিড়ম্বনা নিয়ে লিখা হয়েছে এই অনবদ্য হাসির গল্পটি। কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা গেল না।
সহপাঠী বন্ধু একজনের নাম লাল্টু লস্কর যে কিনা ‘ল’কে ‘ন’ বলে। আবার অন্য বন্ধু নান্টু নস্কর ‘ন’কে ‘ল’ বলে। এবার উদ্ধৃতি - “সেদিন স্কুল পরিদর্শক এলেন স্কুলে। সঙ্গে ছায়ার মতো সারাক্ষণ লেগে আছেন প্রধান শিক্ষক চন্দন নন্দী। - - - এক সময় এল লাল্টুর পালা। পরিদর্শক জানতে চাইলেন - তোমার নাম কী ?
লাল্টু বলল - নান্টু নস্কর।
প্রধান শিক্ষক গলা নামিয়ে জানিয়ে দিলেন - তার নাম আসলে লাল্টু, লাল্টু লস্কর। মানে ল-রে ন কয় আরকি - - -
পরিদর্শক বললেন - তাই নাকি ? আচ্ছা লাল্টু, এবার পাঁচটা রঙের নাম কও দেখি ?
লাল্টুর জবাব - নান, নীন, কমনা, হনুদ - - -
- থাক, হইছে। পাঁচটা ফুলের নাম কও -
- ফুন ? গোনাপ, শেফানি, শাপনা, শিমূন, পনাশ।
পাশেই বসে আছে নান্টু। অতএব এবার নান্টুর পালা। প্রথামতো প্রথমে নামটা জানতে চাইলেন পরিদর্শক। নান্টুর জবাব - লাল্টু লস্কর।
প্রধান শিক্ষক এবারও নিচু গলায় বললেন - অর আসল নাম হইছে নান্টু নস্কর স্যার। মানে ন-রে ল কয়।
পরিদর্শক একবার প্রধান শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে তারপর নান্টুর কাছে জানতে চাইলেন - তোমার স্কুলের নামটা কী কও দেখি ?
নান্টু বলল - জালি, তিললাথ লিম্ল বুলিয়াদি বিদ্যা লিকেতল।
- ভাল ভাল। তোমার প্রধান শিক্ষকের নাম কী ?
- মাললীয় শ্রীযুত চলদল ললদী।
- বাঃ পাঁচজন কবির নাম কও তো ?
- রবীলদ্রলাথ, লজরুল, জীবলালদ, সুকালত আর ইসে হ্যা - রজলীকালত।
- এ বয়সে জ্ঞান তো ভালোই, শুধু - ।”
সবকিছু মিলিয়ে এক কথায় ছোটদের জন্য দারুণ এক সংকলন উপহার দিয়েছেন লেখক। বোর্ড বাঁধাইয়ে ঝকঝকে ছাপার কাজ। বানান ভুল নিতান্তই নগণ্য যদিও গ্রন্থ কিংবা সেই লাল্টু-নান্টুর গল্পের নামটি কিন্তু ‘অল্যলকম গন্প’ না হয়ে ‘অল্যরকম গন্প’ হলে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো বলে মনে হয়। উপযুক্ত প্রচ্ছদ এঁকেছেন গল্পকার নিজেই - যেহেতু তিনি একজন সাহত্যিকের বাইরে একজন কারু এবং চিত্র শিল্পীও।
যেখানে শিশু সাহিত্যের উপর পুস্তকাদির নিতান্তই অভাব এই অঞ্চলে সেখানে গল্পকার সজল পালের এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য নিবেদন।
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮৭৬৮৩৬১৮৩
- - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
Comments
Post a Comment