সচরাচর ‘ঘাসফুল’ শব্দটির মধ্যে একটি তাচ্ছিল্যের অভিব্যক্তি নিহিত হয়ে থাকে। অপরাপর কুসুম বনে ঘাসফুল
নিতান্তই এক তুচ্ছ, অবহেলিত, দ্রষ্টার আকুল নয়নে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশে অক্ষম,
অনুল্লেখ্য প্রাকৃতিক ফুল। যেমন এ ভবসংসারের কোনোও এক মেধাহীন, রূপহীন, বিচার
বুদ্ধিহীন, অকর্মণ্য কোনও মানব-মানবী। কারোও দৃষ্টি আকর্ষণে অপারগ, অবহেলায় পড়ে
থেকে অর্থহীন জীবন যাপনের অনুৎকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ সযত্নে লালিত হলে, সুশিক্ষায়
যত্নবান হলে এরাও সমাজের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম। যেমন কখনো
নিরালা ঘাসের সবুজ বাগিচায় ঘাসফুলের রঙিন উপস্থিতি গোটা চারণক্ষেত্রকে করে তোলে
অনাবিল সৌন্দর্যের রম্যভূমি। ঘাসফুল আকারে ছোট হলেও সযত্নে লালিত হলে কুসুম বনে
তারও মাহাত্ম্য অপরিসীম। আবার কোনও গল্পকারের বয়ানে যদি গল্পের চরিত্রসমূহকে অতি
সাধারণ বলে ঘাসফুলের মর্যাদা বা তকমা দেওয়া হয়েছে তাহলেও বলা যায় এই ঘাসফুলই তো
পৃথিবীময় বনানীর সৃষ্টিকথা। এদের উপেক্ষা করে তো বৃহতের পথে অগ্রসর হওয়া যায় না।
ঘাসফুল কথাই তাই প্রকৃতপক্ষে জীবন কথা।
এই কথাটিরই সূত্র ধরে কৃতি তথা
জনপ্রিয় সাহিত্যিক শর্মিলী দেব কানুনগোর সদ্য প্রকাশিত অণুগল্প সংকলন ‘ঘাসফুল কথা’কে
অনায়াসে একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতি হিসেবে অভিহিত করাই যায়। অণুগল্প আকারে ছোট হলেও
তার রঙ, রূপ, রস, মাধুরী গল্পজগতে সাড়া জাগায় নিশ্চিতভাবেই। শর্মিলী তাঁর এই ৬৮
পৃষ্ঠার পুস্তিকা আকারের সংকলনে সন্নিবিষ্ট করেছেন মোট ২১টি অণুগল্প। অর্থাৎ
গ্রন্থের চেহারা বা আকার দেখে পাঠক মাত্রেরই ঠকে যাওয়ার একটি সম্ভাবনা থেকেই যায়।
কিন্তু একবার পড়া শুরু করলে লেখিকার লালিত স্বপ্নময় রচনাসমূহ পাঠককে সহজে ছেড়ে কথা
কইবে না - এ অনস্বীকার্য।
ডঃ রত্নম দেব কানুনগোর ছিমছাম দৃষ্টিনন্দন কোলাজময় প্রচ্ছদ প্রথম দর্শনেই গ্রন্থের প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। মান্না দেব-এর অক্ষর বিন্যাস ও অলংকরণ আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। ছাপাই, বাঁধাইও দৃষ্টিনন্দন। লেখিকা তাঁর এই প্রথম সাহিত্য ফসলটিকে নিবেদন করেছেন তাঁর সাহিত্য পথের সহযাত্রীদের। ‘কিছু কথা’ শিরোনামে ভূমিকায় লেখিকা লিখছেন - “ঘাসফুল কথা আমার চলার পথের কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি পাথর। আমার অনুভূতি আর বোধের সমন্বয়। আমার হারিয়ে যাওয়া আমিকে অন্বেষণ করা এবং খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা একার নয়। হাতে হাত ধরে ছিলেন হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা আরোও কিছু সুহৃদ। এদের ভালোবাসার কাছে নতজানু আমি।”
১০ থেকে ১৫ লাইনের দু’ দু’টি অণুগল্পে প্রথমেই চমক দেখালেন গল্পকার। ‘বিনিময়’ এবং ‘দাম’। এই দু’টি ছোটগল্পের মাধ্যমেই ঘাসফুলের শোভা ছড়িয়ে পড়ার শুরু। এর পর গোটা বই জুড়ে প্রায় প্রতিটি গল্পে জীবনের টুকরো টুকরো কিছু প্রাত্যহিক ছবির নিখুঁত চয়নে নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন লেখিকা। সাধারণ জীবন যাপনের মধ্যেও যে আপাতঃ ভাবে লুকিয়ে থাকে কত না বলা ব্যাথা, অনুচ্চারিত কথার কথামালা তা তাঁর স্বচ্ছ কলমে ধরা পড়লো অবর্ণনীয় উৎকর্ষতায়। কিছু স্পষ্ট কথা, কিছু প্রতিবাদের ভাষার চমৎকার প্রয়োগে সরল পঠনেও এলো ব্যতিক্রমী মোড় -
“আজ অনেক দিন পর সমরের পাশে টিভি দেখতে না বসে বেডরুমে এসে নিজের পছন্দের একটা গান চালালেন। সমর অভ্যাস বশতঃ ডাকলেন। তিনি গেলেন না। আজ প্রথমবার তিনি সমরের অর্ধাঙ্গিনীর ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি যে একাই একজন সম্পূর্ণ মানুষ আজ এটা অনুভব করলেন। কিংবা করতে পারলেন।”
কিংবা - “কুকুরগুলোর মুখ বন্ধ করার এটাই একটা রাস্তা ছিল। এরা কিছুতেই বুঝবে না সব সম্পর্ক বিছানায় পৌঁছানোর জন্য নয়। কিছু কিছু সম্পর্কের ঠাঁই হয় বুকের ভেতরে।”
অথবা - “প্রকাশবাবুর স্বপ্নমহল ভাঙার শব্দ সবাই শুনছে। ঘর ভাঙার শব্দ বড্ড জোরে হয়। তবে অনেক সময় নিঃশব্দেও ঘর ভাঙে। কেউ টেরও পায় না। যেমন ভেঙেছে সুমনার।”
‘সুখী’, ‘দত্তক’, বিভ্রম’, ‘ঠিকানা’, ‘বর্ম’ - আদি গল্পে সার্থক ছোটগল্পের আভাষ স্পষ্ট। তথাপি এই গল্পগুলোকে অণুগল্পের ছাঁচে ফেলে সুস্বাদু পরিবেশনার মাধ্যমে এলেম দেখিয়েছেন গল্পকার। অধিকাংশ গল্পেই মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের ছবিটি বড্ড প্রাঞ্জল করে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মন শেষ না পড়ে ক্ষান্ত হবার নয়।
‘রাতের বেলুন’, মিনিময় মূল্য, ‘ঋণী’ আদি অণুগল্পের সীমিত পরিসরে সমাজের কিছু অযৌক্তিক ধ্যান ধারণার, কিছু কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছেন। হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন কিছু মুখোশধারী নরপুঙ্গবের।
আবার স্বল্প কথায় সবটুকু বলে পাততাড়ি গুটানোর কাজটিও সুচারু ভাবেই সেরে নিয়েছেন তিনি। এক কথায় গল্পকার শর্মিলী পাঠক মনে এক ক্ষুধার সঞ্চার করে গেলেন এই ‘ঘাসফুল কথা’র মাধ্যমে। অচিরেই এমন সাজানো গোছানো ছন্দে একটি পূর্ণ দৈর্ঘের গল্প সংকলনের দায়ও স্বাভাবিক ভাবেই বর্তালো তাঁরই উপর। ঘাসফুলের শোভা নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে গগনচুম্বী সৌন্দর্যে একদিন মাতিয়ে তুলবে ভুবন - এ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
‘ঘাসফুল কথা’
মূল্য - ১০০ টাকা।
যোগাযোগ - ৮১৩৪০৯২৯৪৭
- - - - - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
ডঃ রত্নম দেব কানুনগোর ছিমছাম দৃষ্টিনন্দন কোলাজময় প্রচ্ছদ প্রথম দর্শনেই গ্রন্থের প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। মান্না দেব-এর অক্ষর বিন্যাস ও অলংকরণ আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। ছাপাই, বাঁধাইও দৃষ্টিনন্দন। লেখিকা তাঁর এই প্রথম সাহিত্য ফসলটিকে নিবেদন করেছেন তাঁর সাহিত্য পথের সহযাত্রীদের। ‘কিছু কথা’ শিরোনামে ভূমিকায় লেখিকা লিখছেন - “ঘাসফুল কথা আমার চলার পথের কুড়িয়ে পাওয়া নুড়ি পাথর। আমার অনুভূতি আর বোধের সমন্বয়। আমার হারিয়ে যাওয়া আমিকে অন্বেষণ করা এবং খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা একার নয়। হাতে হাত ধরে ছিলেন হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা আরোও কিছু সুহৃদ। এদের ভালোবাসার কাছে নতজানু আমি।”
১০ থেকে ১৫ লাইনের দু’ দু’টি অণুগল্পে প্রথমেই চমক দেখালেন গল্পকার। ‘বিনিময়’ এবং ‘দাম’। এই দু’টি ছোটগল্পের মাধ্যমেই ঘাসফুলের শোভা ছড়িয়ে পড়ার শুরু। এর পর গোটা বই জুড়ে প্রায় প্রতিটি গল্পে জীবনের টুকরো টুকরো কিছু প্রাত্যহিক ছবির নিখুঁত চয়নে নিজের জাত চিনিয়ে দিলেন লেখিকা। সাধারণ জীবন যাপনের মধ্যেও যে আপাতঃ ভাবে লুকিয়ে থাকে কত না বলা ব্যাথা, অনুচ্চারিত কথার কথামালা তা তাঁর স্বচ্ছ কলমে ধরা পড়লো অবর্ণনীয় উৎকর্ষতায়। কিছু স্পষ্ট কথা, কিছু প্রতিবাদের ভাষার চমৎকার প্রয়োগে সরল পঠনেও এলো ব্যতিক্রমী মোড় -
“আজ অনেক দিন পর সমরের পাশে টিভি দেখতে না বসে বেডরুমে এসে নিজের পছন্দের একটা গান চালালেন। সমর অভ্যাস বশতঃ ডাকলেন। তিনি গেলেন না। আজ প্রথমবার তিনি সমরের অর্ধাঙ্গিনীর ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি যে একাই একজন সম্পূর্ণ মানুষ আজ এটা অনুভব করলেন। কিংবা করতে পারলেন।”
কিংবা - “কুকুরগুলোর মুখ বন্ধ করার এটাই একটা রাস্তা ছিল। এরা কিছুতেই বুঝবে না সব সম্পর্ক বিছানায় পৌঁছানোর জন্য নয়। কিছু কিছু সম্পর্কের ঠাঁই হয় বুকের ভেতরে।”
অথবা - “প্রকাশবাবুর স্বপ্নমহল ভাঙার শব্দ সবাই শুনছে। ঘর ভাঙার শব্দ বড্ড জোরে হয়। তবে অনেক সময় নিঃশব্দেও ঘর ভাঙে। কেউ টেরও পায় না। যেমন ভেঙেছে সুমনার।”
‘সুখী’, ‘দত্তক’, বিভ্রম’, ‘ঠিকানা’, ‘বর্ম’ - আদি গল্পে সার্থক ছোটগল্পের আভাষ স্পষ্ট। তথাপি এই গল্পগুলোকে অণুগল্পের ছাঁচে ফেলে সুস্বাদু পরিবেশনার মাধ্যমে এলেম দেখিয়েছেন গল্পকার। অধিকাংশ গল্পেই মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের ছবিটি বড্ড প্রাঞ্জল করে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মন শেষ না পড়ে ক্ষান্ত হবার নয়।
‘রাতের বেলুন’, মিনিময় মূল্য, ‘ঋণী’ আদি অণুগল্পের সীমিত পরিসরে সমাজের কিছু অযৌক্তিক ধ্যান ধারণার, কিছু কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও মুখ খুলেছেন। হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন কিছু মুখোশধারী নরপুঙ্গবের।
আবার স্বল্প কথায় সবটুকু বলে পাততাড়ি গুটানোর কাজটিও সুচারু ভাবেই সেরে নিয়েছেন তিনি। এক কথায় গল্পকার শর্মিলী পাঠক মনে এক ক্ষুধার সঞ্চার করে গেলেন এই ‘ঘাসফুল কথা’র মাধ্যমে। অচিরেই এমন সাজানো গোছানো ছন্দে একটি পূর্ণ দৈর্ঘের গল্প সংকলনের দায়ও স্বাভাবিক ভাবেই বর্তালো তাঁরই উপর। ঘাসফুলের শোভা নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে গগনচুম্বী সৌন্দর্যে একদিন মাতিয়ে তুলবে ভুবন - এ শুধু সময়ের অপেক্ষা।
‘ঘাসফুল কথা’
মূল্য - ১০০ টাকা।
যোগাযোগ - ৮১৩৪০৯২৯৪৭
- - - - - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
Comments
Post a Comment