গল্প, উপন্যাসের পথে না
হেঁটেও একজন লেখক যে একজন সফল কথাশিল্পী হয়ে উঠতে পারেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন সঞ্জয়
গুপ্ত। কিংবা কথাটি এভাবেও বলা
যায় - শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমে (বিশেষ করে ফেসবুক) প্যারাগ্রাফ লিখেও যে একজন
লেখক জনপ্রিয় কথাকার হিসেবে পাঠক মনে জায়গা করে নিতে পারেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ
হলেন সঞ্জয় গুপ্ত। কোথাও অচেনা অজানা পথের
হদিশ তো কোথাও অতি সামান্য ঘটনাকে অসামান্য হিসেবে (তিলকে তাল করে ?) পাঠকের
দরবারে পেশ করতে জুড়ি নেই তাঁর। সত্য ঘটনাকে সত্য হিসেবেই রেখে তিলকে তাল করার
মধ্যেও একটা এলেম থাকতে হয়, একটা শিল্পবোধ থাকতে হয়। তা বিলক্ষণ আছে বলেই সঞ্জয়
গুপ্তকে নিয়ে লিখতে বসতে হয়।
হালে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম
গদ্যগ্রন্থ ‘এলোমেলো-১’। এলোমেলো ভাবনাগুলোকে বইবন্দি করার প্রয়াসে লেখক হয়তো তাঁর
অজান্তেই সৃষ্টি করে ফেলেছেন অসম্ভব রকমের একটি গোছালো সম্ভার। পেপারব্যাক-এ ১২৪
পৃষ্ঠার বইটির প্রকাশক ভিকি পাবলিশার্স, গুয়াহাটি। ছিমছাম অথচ আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ
তৈরি করেছেন নয়নজ্যোতি শর্মা।
তিনটি ভাগে বিন্যস্ত এই গ্রন্থ।
‘একটি অসম্পূর্ণ কাহিনি’, ‘শিলং স্মৃতি’ এবং ‘অন্যান্য’। ভেতরের প্রাসঙ্গিক
স্কেচগুলো এঁকেছেন ফারুক শাহিদ ও নির্মল পাল চৌধুরী। বইটি উৎসর্গ করেছেন - ‘মেয়ে
সুদেষ্ণা গুপ্তকে, যে বাংলা পড়তে শিখে গেল এই ফেসবুক পোস্টগুলো পড়তে পড়তে এবং
সেইসব মানুষরা, যাঁরা পোস্ট পড়ে নিরন্তর উৎসাহ যুগিয়েছেন’। লেখকের নিজস্ব কোনও
প্রাককথন না থাকলেও তাঁর সম্যক পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন প্রকাশক গোষ্ঠী গ্রন্থের শেষ
প্রচ্ছদে। লেখক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন -সোনালী গুপ্তকে, ‘যিনি সংসার সামলে না রাখলে
লেখার সময় পাওয়া যেত না’ এবং মনোজ নন্দী মজুমদারকে, ‘যাঁর উৎসাহ এবং সাহায্য ছাড়া
এই বই প্রকাশের মুখ দেখত না’।
প্রথম বিভাগে আছে একটই বড় গল্প। আলাদা
কোনও নাম নেই। দীর্ঘ চাকুরি জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনারাজিকে টানটান রহস্য গল্পের
আদলে এমন ভাবে পরিবেশন করেছেন যে এটি নিশ্চিত ভাবেই হয়ে উঠেছে এক সার্থক বড় গল্প।
দীর্ঘ ৫৬ পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠক মনে সঞ্চারিত করে গেছেন এক অদম্য পঠন স্পৃহা। গল্পের
বুনোট, শব্দ ও বাক্যের শিল্পময় বিন্যাস, ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং সংলাপের চাতুর্যে
মুগ্ধতায় ভরে ওঠে পাঠক মন। এই একটি গল্পের মাধ্যমেই লেখককে একজন সফল গল্পকার বলে
অভিহিত করা যেতেই পারে নিঃসন্দেহে।
দ্বিতীয় ভাগে লেখকের শিলংবাসকালীন
ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকে ধরে রেখেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ টুকরো কথার বুননে। মোট
সাতটি কথাসার লিপিবদ্ধ হয়েছে এই অংশে। ‘প্রথম যাত্রা’ এবং ‘সাহেব চা’ একেবারেই
ব্যতিক্রমী এবং এক কথায় অনবদ্য। শেষে শৈল শহরে উদ্ভুত অশান্তিজনিত পরিস্থিতির জন্য
দুঃখবোধ উপচে পড়েছে লেখনীতে। পড়তে পড়তে মনে হয় শিলং নিয়ে আরোও কিছু লেখা এখানে
সন্নিবিষ্ট হতেই পারত। ‘চাঁদা তোলার গল্প এবং - - - ‘ পড়লে কোথাও যেন একটি
ছোটগল্পের ছোঁয়া পাওয়া যায়। প্রতিটি লেখায় পাঠক মন হয়ে ওঠে উদ্বেলিত। কিছু ভাবনা,
কিছু নস্টালজিয়ায় লেখকের যাবতীয় বোধ যেন অবলীলায় সঞ্চারিত হয় পাঠকের মননে।
তৃতীয় ভাগে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট
একুশটি বিষয়ভিত্তিক লেখা। বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর এই ভাগের প্রতিটি লেখাতেই সুনিপুণ
ভাবে ব্যক্ত হয়েছে বিষয়ের সাথে লেখকের বিশ্লেষণজনিত বোধ। ‘ভাষা বিষয়ক’ এক কথায়
অনবদ্য। ‘অভিজ্ঞতা’ - সরস বাস্তব। ‘প্রাদেশিক’ - এক গভীর দুঃখবোধের বর্ণনা। ‘অডিট
সফর’ - বাস্তবের প্রেক্ষাপটে দস্তুর মতো একটি উপভোগ্য ছোটগল্প। ‘দাম’ - বাস্তবতায়
মোড়া এক গঠনমূলক লেখা। ‘করোনার কারণে’ এবং ‘বিপাসনা’ - রসাত্মক রচনা। ‘রেডিওর
গল্প’ - এক অদ্ভুত ভালোলাগার ছবি। গল্পের মতো। পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া যায়।
সব মিলিয়ে প্রায় প্রতিটি লেখাই
উপভোগ্য হয়ে ওঠে ভাষা ও লিখন চাতুর্যে। কখনো বাক্যের শেষটুকু পাঠকের হাতেই ছেড়ে
দিয়েছেন লেখক। এও এক নূতন ধাঁচ। অধিকাংশ লেখারই এক ব্যতিক্রমী সমাপন - অনেকটাই ছোট
গল্পের আদল।
কিছু বাক্যবন্ধ চমৎকারিত্ব বয়ে
আনে পাঠক মনে -
“নিচে শিশুরা, তাদের মায়েরা হৈ হৈ
করে আবীর খেলে। পিচকারি দিয়ে জল ছুঁড়ে। এক সময়, স্নান করার সময় নেমে আসি, তেতালার
নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে, বড়দের পায়ে - - -
তারপর শিশুদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিজেকে। অধিকাংশ বছর এভাবেই - - - তারপর
একসময় শিশুরা বড় হয়ে যায় আর বড়রা ছবি।” ( দোল ২০২০)। কিংবা -
“যত দিন যাচ্ছে - - - তত এই
প্রশ্নটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কতজনকে সময় থাকতে শুধানো হয়নি, কেমন আছো ?
মানুষের নাকি দু’বার মৃত্যু হয় -
- - একবার শারীরিক - - - আর আরেক বার যখন তার কথা আর কারো মনে নেই।
সেইদিনই আসলে তার সত্যিকারের মৃত্যু ঘটে।
পারুলবালা দাসগুপ্ত চলে গেছেন - -
- বেশ কিছু বছর হয়েছে।
কিন্তু আজ হঠাৎ মনে পড়ল। এবং
তারপর অনেক কিছু মনে পড়তেই থাকলো।
বেশ বুঝতে পারছি, তোমার পার্থিব
জীবনের রেশ এখনও রয়ে গেছে দিদা - - -
- - - যতদিন না আমি - - - না ঠিক বললাম না - - - যারা যারা তোমাকে পেয়েছি - - - তারা আছি - - - মায়া কাটিয়ে আর অসীমে যেতে পারছ কই ?” (সাহেব
চা)।
শেষ কথাটি তবে এভাবে বলা যেতেই
পারে - এলোমেলো নিছকই এক নাম। আসলে এ দুর্দান্ত ভাবে এক গোছালো পরিবেশনা। তবে
যেহেতু নামাকরণ হয়েই গেছে তাই ‘এলোমেলো’র পরবর্তী সংললনগুলো অচিরেই এসে যাবে
পাঠকের হাতে - সে প্রত্যাশা ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে। এর বাইরে ছোটগল্পের জগতেও সঞ্জয়
গুপ্ত নামটি অবশ্য অদূর ভবিষ্যতে দেখা যেতেই পারে।
‘এলোমেলো ১’
মূল্য - উল্লেখ নেই
যোগাযোগ - ৯৪৩৫১০৪১৯৬
- - - - - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
ভীষণ ভালো লাগলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ সৌম্যদীপ
ReplyDelete