শীতের ভোরে ইচ্ছা
অনিচ্ছার দোটানায় বিছানা ছেড়ে ওঠা এক প্রচণ্ড বিরক্তিকর ব্যাপার। এরপর
হাতে যখন সময একেবারেই নেই এবং প্রায় দৌড়তে দৌড়তে স্টেশনে পৌঁছে দেখা যায় যে অন্য প্ল্যাটফর্মে
যাওয়ার চলমান সিঁড়ি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং ঢাউস ট্রলিটি হাতে করে বয়ে উপরে
উঠতে হয় তখন বিরক্তি কেমন চরমে পৌঁছায় ? কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিরক্তির
আরো বাকি ছিল। জিনিসপত্র নিয়ে জোর পা চালিয়ে প্ল্যাটফর্মের শেষ
প্রান্তে এসে মিনিট চারেক বাকি থাকতে কাঙ্খিত আসনে বসার পর দেখা গেল সময় পেরিয়ে যাওয়ার
পর ট্রেন তো নড়ছেই না। নির্ধারিত সময়ের পাক্কা 10 মিনিট পর ছাড়ল অগত্যা।
এতসব বিরক্তিকর
মুহূর্ত পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের যাত্রা হলো শুরু। গুয়াহাটি
থেকে নতুন করে আরম্ভ হওয়া ভিস্তা ডোম এক্সপ্ৰেস করে ন'জনের কনভয় হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়লাম আসামের শৈল শহর হাফলং এর উদ্দেশে। ক্রিসমাস
চমক।
জানি না এর পর
আর কী আছে কপালে। কারণ বিরক্তির শুরুটা কিন্তু একদিন আগে থেকেই শুরু
হয়ে গেছে। আসছি সে কথায়। আপাততঃ
ন'জন চলেছি। তিনটি পরিবার। মহিলারা
পাল্লায় ভারী। একটি আপ্তবাক্য মনে পড়ছে। 'যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন'জন'। সুজন তো সবাই বটে। তবে
কি ভাগ্যে তেঁতুল পাতাই লিখা আছে ? এমন সন্দেহের একটি প্রেক্ষাপট আছে
বৈকি। যেখানে যাচ্ছি সেখানে এক রাত থাকব। কাল
শেষ সকালে ফেরার ট্রেন। আগেভাগেই তাই ৫টি রুম বুক করা ছিল কৃষি
বিভাগের গেস্ট হাউসে। হঠাৎ করে যাত্রার একদিন আগে কর্তৃপক্ষ
জানিয়ে দিলেন উপায়ুক্ত মহোদয়ের সাডেন ভিজিট উপলক্ষে সব বুকিং ক্যান্সেল করা হলো। সরকারি
কাজের গুরুত্বের কাছে বিনোদনের ঘোরাঘুরির কোনও মূল্য থাকার কথা নয়। কিন্তু
তাহলে ঘোরাঘুরির জন্য বুকিং না করলেই ভালো। এভাবে শেষ মুহূর্তে
বিড়ম্বনায় ফেলে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। না পেলে আমরা
অবশ্যই আগেভাগে হোটেল বুকিং-এর চিন্তা করতাম।
এ সংবাদে আক্ষরিক
অর্থে মাথায় হাত সবার। এতগুলো টিকেট। ছেলেমেয়েগুলোর
এত উৎসাহ (বড়দেরও কম নয়)। সব কি
তবে বৃথা হবে ? যাওয়ার কথা ছিল দশ জনের। এর মধ্যে
একটি পরিবারের কর্তা একদিন আগে সরে দাঁড়ালেন তাঁর কর্মসূত্রে হঠাৎ করে এসে উপস্থিত
হওয়া ব্যস্ততার জন্য। কিছুতেই ম্যানেজ করে উঠতে পারলেন না। তাই
তিনি আমাদের উপর ভরসা রাখতে না পেয়ে ট্যুরটি ক্যান্সেল করে দেওয়ার পক্ষেই মত প্রকাশ
করলেন। এবং সাথে এই উৎসবের ভিড়ে এভাবে আমাদের মতো আনাড়িদের (?) পক্ষে একা একা (ন’জন সত্ত্বেও)
এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরে আসা সম্ভব নয় বলে এক প্রকার চাপ সৃষ্টিও
করতে লাগলেন। কিন্তু আমরা এভাবে শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে
আসাটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুতেই। তাই
শুরু হলো প্রচেষ্টা। বিকল্প ব্যবস্থার। কিন্তু
সব ব্যর্থ। আসামের একমাত্র শৈল শহরের সব হোটেল, লজ, সরকারি অতিথিশালা সব ক্রিসমাস উপলক্ষে ভর্তি। কোথাও
জায়গা নেই। ততক্ষণে রোখ চেপে গেছে মাথায়। ভেবেচিন্তে
ফোন করলাম এক বান্ধবীকে। তাঁর বাড়ি মাইবং। হাফলং
রুটের অন্য একটি শহর। পত্র পত্রিকায় ইতিমধ্যেই সেসব অঞ্চলের
ইতিকথা মূলক নিবন্ধ বেরিয়েছে একাধিক। বান্ধবী কর্মসূত্রে
এখন গুয়াহাটিতে। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেস্টায় হাফলং এর পার্শ্ববর্তী
শহর মাহুর এর অন্য একটি সরকারি গেস্ট হাউসে জায়গা পাওয়া গেছে। সৌজন্যে
বান্ধবীর এক ভাই। তবে শর্ত এখানেও একই। সরকারি
কোনও ঝটিতি সফর থাকলে এখানেও জায়গা হবে না আমাদের মতো প্রজার। দুরুদুরু
বুকে তাই এতগুলো প্রাণীকে নিয়ে বেরিয়েছি। দেখাই যাক ভাগ্য
কী বলে।
নতুন করে জংশনের
মর্যাদা পাওয়া পাথরখোলা থেকে ট্রেন ডান দিকে বাঁক নিয়ে মান্দারডিসা স্টেশন হয়ে ঢুকে
পড়ল উত্তর কাছাড়ের গভীর পাহাড়ে। মাঝে মাঝেই দীর্ঘ
সুড়ঙ্গ (টানেল)। ছোট ছোট স্টেশন, জনপদ - ছবির মতো সাজানো। সকন্যা
আমরা তিনজন। শ্বশুর বাড়ির সূত্রে আরোও চার আত্মীয় এবং মেয়ের
সঙ্গীত গুরু শ্রদ্ধার পাত্রী সন্দীপা ও তাঁর মেয়ে। অনেক
দিন থেকেই একসাথে কোথাও সফরসঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছিলেন যদিও এর আগের দু'বার মিস্ করেছেন। এবার আর তা হয়নি।
ছুটে চলেছে ট্রেন। রাতের
চিন্তায় মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত
জায়গা পাওয়া যাবে তো গেস্ট হাউসে ? দুপুর বারোটা পেরিয়ে সবাই মিলে নামলাম
সাজানো গোছানো হাফলং স্টেশনে। সাথে ট্রেনভর্তি
ট্যুরিস্ট। নতুন ট্যুরিস্ট ট্রেন। চাকচিক্যে
যতটা, চলনবলনে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। উদাস
চলনে যেখানে সেখানে যথেচ্ছা থেমে থেমে যখন পৌঁছালো তার অন্তত এক ঘণ্টা আগেই পৌঁছাতে
পারতো। সে যাই হোক। স্টেশনে
নেমে প্রথম যে কাজটি সারতে হলো তা হলো সারা দিনের জন্য একটি গাড়ি ঠিক করা। বেশ
খানিকটা কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে একটি স্থানীয় উদ্যমী যুবকের গাড়িটি আমরা হাজার পাঁচেক
টাকায় পেয়ে গেলাম। হাফলং, জাটিঙ্গা ঘুরে মাহুরে
পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
লটবহর নিয়ে উঠে
বসলাম গাড়িতে। প্রথম কাজ এবার পেটে কিছু খাবার দেওয়া। এবং
এখানেই আবিষ্কার করলাম যে সফরকারীদের জন্য এই শহরটির উপযুক্ত পরিকাঠামো এখনো ঠিকমতো
গড়ে ওঠেনি। দুপুর ১টা বাজতে না বাজতেই যে কয়টি হাতে গোণা হোটেল
আছে সেখানে গিয়ে নিজেদের পছন্দের খাবার কিছুই পাওয়া গেল না। শেষ
পর্যন্ত এই স্থানীয় ছেলেটির তৎপরতায় একটি হোটেলে কোনওরকমে সামান্য কিছু (অপছন্দের) খাবারই খেতে হলো। যাহোক
ক্ষুধা অন্তত মিটলো সাময়িক। ইতিমধ্যে বেলা
প্রায় আড়াইটা। হাফলং-এর বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্য
স্থান ক’দিন থেকে দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে রাখা আছে। কারণ
সামনেই অসম সরকারের ক্যাবিনেট মীটিং
বসবে এই শৈল শহরে। তাই
জোর নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। দর্শনীয় সার্কিট হাউসটি তাই দেখা হলো
না। আবার সরকারি সিদ্ধান্তে আমরা নাজেহাল হলাম। দূরের
স্থানগুলোতেও যেতে পারছি না সময়ের অভাবে। তবে তিনটি চমৎকার
ভিউ পয়েন্টে আমরা যেতে পেরেছি। সবচাইতে উঁচুতে
ছিল মনপং ভিউপয়েন্ট। সরকারি স্তরে সেখানেও ভাঙাগড়ার কাজ চলছে
সৌন্দর্যবর্ধনের। সেখান থেকে ছবির মতো হাফলং শহরটিকে দেখে বার বার শিলং-এর কথা মনে পড়ছিল। কয়েকটি চার্চ, দু’টি স্টেডিয়াম এবং দূর উঁচু উঁচু পাহাড়ের গায়ে লেগে
থাকা ঘরগুলো দেখে জুড়িয়ে যায় চোখ। পাহাড়গুলো যেন
ঢেউ-এর মতো অনিঃশেষ এক চরাচর। হাতে
হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত কাল। ছেলেমেয়েগুলোর
ছবি উঠানো আর শেষই হচ্ছিল না। ডেকে এনে ফের
বসিয়ে দিলাম গাড়িতে। পথে শহরের মাঝখানে অবস্থিত হাফলং লেকটি
এবং সংলগ্ন ল্যাণ্ডস্কেপটি সত্যি দেখার মতো। গাড়ি চলছে - ভেতরে সেই চিন্তাটি কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই যদি
ফোন আসে ? না তেমনটি হয়নি এখনো।
পরবর্তী গন্তব্য
জাটিঙ্গা। জন্মাবধি অসংখ্যবার এই জাটিঙ্গার উপর দিয়ে আসা যাওয়া
করেছি। তবে দেখেছি শুধু স্টেশনটিই। আর যতটুকু
জানি তার মধ্যে আছে শুধু জাটিঙ্গার কমলা আর পরিযায়ী পাখির মৃত্যু বৃত্তান্ত। সেই
জায়গাটিতেই গিয়ে উপস্থিত হলাম এরপর। এক অদ্ভূতুড়ে
প্রাকৃতিক অবস্থান। গগনচুম্বী পাহাড়ের নিচে বন জঙ্গল ঘেরা কিছু সমভূমি। পাতলা
ঘাস, গুল্মের আচ্ছাদন। দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। ভাবনায় সেই ভিনদেশি
পাখিগুলোর অবয়ব। কোথায় কোন দূর দেশ থেকে কীসের তাড়নায় এখানে ছুটে এসে
এই ইচ্ছামৃত্যু বরণ ? তবে শুনেছি রাতের আঁধারে গ্রামবাসীদের এই হত্যাযজ্ঞ
নাকি এখন সরকারি হস্তক্ষেপে অনেকটাই কমে এসেছে। স্থানীয়রাও
এতে সমর্থন দিচ্ছেন দেখে ভালো লেগেছে। ঘুরে এসে শীতের
শুকনো নদী দেখতে চলে এলাম অনেকটা নিচে। সন্ধ্যা তখন
সমাগত। বড় বড় পাথরের মাঝখান দিয়ে এক চিলতে জলধারার মতো বয়ে
চলেছে জাটিঙ্গা নদী। সেখানেই পাথরের উপর বসে আবারো একগাদা
ছবি ওঠা হলো। তীরে কয়েকজন যুবক মিলে ছোটখাটো পিকনিক সারছেন দেখা
গেল। এপারে এক জায়গায় বর্জ্য পদার্থের ঢের দেখে অস্বস্তি
হচ্ছিল। আবর্জনার বেশির ভাগই হলো প্লাস্টিক আর মদের বোতল। কী রুচি
নিয়ে এভাবে আমরা প্রকৃতিকে বিকৃত করছি সত্যিই তা ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিমারি
থেকে কী শিক্ষাই যে আমরা পেয়েছি তাও ভেবে দেখার। সেখানে
থাকা কয়েকটি ট্যুরিস্ট গাড়ির মালিক কাম ড্রাইভাররা আমাদের সাথে থাকা তিনটি সুন্দরী
মেয়ের হাতে তিনটি স্থানীয় কমলা তুলে দেয় নিখাদ সরলতায়। কমলা
পেয়ে ওরা ভীষণ খুশি। এই মুহূর্তে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো আমার। মাহুর
থেকে সেই সজ্জন বন্ধুর ফোন। আমার তো দুরুদুরু
বুক। ভদ্রলোক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে চাইলেন কোথায় আছি, কখন রওয়ানা হবো জাটিঙ্গা থেকে ইত্যাদি। যাই
হোক অনেকটাই নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি এতক্ষণে। আমরা এরপর মিনিট
দশেকের মধ্যেই রওয়ানা হলাম এবং একটি সফল দিনের যাত্রাশেষে প্রায় তরিশ মিনিটের সফর শেষে
রাতের প্রথম প্রহরে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই মাহুরের পি ডাবলু ডি গেস্ট হাউসের গেটে যে মাহুর
ছিল আসামের একমাত্র তুষারপাতের স্থান। ঠাণ্ডা অনুভূত
হচ্ছিল ধীরে ধীরে। গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে আই বির কেয়ারটেকার।
দেখে বাঙালি
বলেই মনে হলো এবং কথা বলে ধারণা সঠিক হলো। ভদ্রলোক বহু
বছর ধরে মাহুরের বাসিন্দা যদিও মূলতঃ তাঁর বাড়ি কাছাড়ের বিহাড়াতে। সদাহাস্য, সজ্জন মানুষটি পরদিন সকাল অবধি আমাদের প্রতি যে অমায়িক ব্যবহার আর অকুণ্ঠ সেবা
প্রদান করে গেলেন তার তুলনা হয় না। আমরা যখন রুমে
ঢুকে গেছি সেই মুহূর্ত থেকে সব টেনশন দূর হলো। সবাই
তখন এক বাক্যে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দিচ্ছেন আমার বন্ধু তথা সুপরিচিত লেখক মীনাক্ষী
চক্রবর্তীকে, যাঁর তৎপরতায় আমাদের এই রাত্রিবাসের নিশ্চিন্তি। তিনটি
প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড রুমে মোট পাঁচটি বিছানায় আমাদের জায়গা হলো। মাঝের
হলঘরটিতে খাওয়ার ব্যবস্থা যেখানে একসাথে অন্তত পনেরো জন বসে খেতে পারেন। ঢাউস
খাবার টেবিল। ইতিমধ্যে সেই সুজন বন্ধু দেবব্রত বাবু যিনি এখানে
সুবন বলে খ্যাত তিনিও এসে দেখে গেলেন আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক মতো হয়েছে কিনা। মাহুর
হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলের শিক্ষক বন্ধুটিকে দেখে, তাঁর সাথে কথা
বলে শিক্ষকদের প্রতি থাকা আমার চিরকালীন শ্রদ্ধা আবারো জাগ্রত হয়ে উঠলো। প্রসঙ্গত - আমাদের টিমেও দু’জন শিক্ষক আছেন। যাই
হোক, আমাদের পছন্দ মতো রাতের খাবার হিসেবে ডাল, আলুভাজা ও ডিমের ঝোল তৈরি করার ফরমায়েশ নিয়ে কেয়ারটেকার ভদ্রলোক চলে গেলেন
বাজারে। আমরাও ইতিমধ্যে বিছানা নির্বাচন করে সারা দিনের ধকল
শেষে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তিনি ফিরে এসেই
প্রথমে চা বানিয়ে নিয়ে এলেন। বিস্কুট আর গরম
গরম চা যেন আমাদের জীবনীশক্তি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ
পারা তখন নামছে। টের পাচ্ছি ভালোই।
পুজো দেখার সেই
উন্মাদনা যেন ফিরে এল খানি পর। কী করে ? আমরা এসে পৌঁছানোর পরই সুবন-দা আর কেয়ারটেকার দাসবাবু
মিলে ঠিক করেছেন যে খ্রিসমাস উপলক্ষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে চার্চে। এ এক
নতুন অভিজ্ঞতা। সেদিন খ্রিসমাস উপলক্ষে সেজে ওঠেছে শহর মাহুর। রাস্তায়
রাস্তায় পুজো প্যাণ্ডেলের মতোই আলোর রোশনাই। আমাদের থাকার
জায়গার কাছাকাছি মোট তিনটি চার্চ। সবক’টিতেই গেলাম পায়ে হেঁটে। উঁচু সিঁড়ি উঠতে
কারো কারো পায়ে ধরেছে ঠিকই কিন্তু উঠে যাওয়ার পর আয়োজকদের অন্তরঙ্গ স্বাগতম ও আন্তরিক
কথাবার্তায় সব ভুলে গেছি। ভাষার প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও প্রেয়ারে
শামিল হয়ে কাটালাম কিছুক্ষণ। বার বার মনে
পড়ছিল পুজোর ঘোরাঘুরির কথা। হুবহু এক। আসলেই
তো এক। মাঝখান থেকে নানা ঘাত প্রতিঘাত এসে এককে করে দেয় অনেক।
পবিত্র খ্রিসমাসের
রাতের ঘোরাঘুরির পর রুমে ফিরে এসে আরেক প্রস্থ চায়ের পর মাঝের হলঘরটিতে গোল হয়ে বসে
আমরা জমিয়ে দিয়েছি আসর। গানে, কবিতায়। মধ্যমণি
বিশিষ্ট গায়িকা সন্দীপা-দি, তাঁর কন্যা দেবিস্মিতা
আর ছাত্রী সুচয়িতা - যে আবার আমার কন্যাও বটে। আর শেষে
হালের ডামশারাস। এখানে আবার মধ্যমণি কর্ণেল আর ক্যাপ্টেন নামের দুই
দামাল ছেলে আর তাঁদের দিদি বনানী - যে আবার আমার স্বরচিত একটি কবিতায়
‘বনানী’র উল্লেখ পেয়ে খুব খুশি। সবাইকে
চমকে দিয়ে একটি অপ্রচলিত রবীন্দ্র সঙ্গীতের অন্তরা শুনিয়ে মুগ্ধ করে দিলেন দেবযানী
বৌদি। রাত প্রায় সাড়ে দশটায় নৈশ আহার সাঙ্গ হলো আমাদের। ঘরোয়া
রান্নার আমেজে দিনের অখাদ্য খাওয়ার যাতনা ভুলে পেট পুরে খেয়ে আবারো একপ্রস্থ আড্ডার
শেষে সবাই বিছানায় গেলাম। কারণ পরদিন সকালে আবার আরেক জায়গা দেখাতে
নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি এসে যাবে সকাল সাতটায়। সৌজন্যে
সেই সুজন - সুবন-দা। ততক্ষণে
প্রায় হিমশীতল পরিবেশ। কিন্তু মোটা ভারী ব্ল্যাঙ্কেটের ভেতর
ঢুকে পড়ার পর সারা দিনের ধকল শেষে ঘুমের দেশে যাওয়া ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
রাতের পরিপূর্ণ
নিদ্রা শেষে চনমনে সকালে উঠেই আমরা তৈরি হয়ে গেলাম পাহাড় চূড়ায় যাবো বলে। তার
আগে দাসবাবুর কাছ থেকে আগের রাতেই রান্নাঘরের চাবিটি নিয়ে রেখেছিলাম যেজন্য - সেই কাজটি সেরে ফেললাম আমি। নিজে চা বানিয়ে
তুলে দিলাম সবার হাতে হাতে। সবাই খুশি। গিন্নি
তো একেবারে আপ্লুত। বললেন সুদীর্ঘ বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনে সুস্থ অবস্থায়
এই প্রথম স্বামীরত্নটি থেকে উপহার পেলাম সকালের এক কাপ চনমনে চা। সবাই
হেসে উঠলেন এ কথায়। কিন্তু আমার সহধর্মিণী জানতেন না যে তাঁর জন্য অপেক্ষা
করছে আরোও চমক। আসছি সে কথায় পরে।
আধঘন্টা দেরিতে
আবার সবাই মিলে হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়লাম। দ্রষ্টব্য মাহুরের
সব চাইতে উঁচু পাহাড়চূড়া থিনবুং। গোটা বিস্তৃত
বড়াইল রেঞ্জের সর্বাধিক উঁচু মাধব পীক-এর নিচে অবস্থিত থিনবুং
ভিউ পয়েন্ট। মন প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো দৃশ্যাবলি। দেখা
আর শেষ হয় না। একদিকে গভীর পাহাড়তলার দৃশ্যপট আর বিপরীত দিকে মাধব
পিক-এর অপরূপ শোভা। মাঝে ছবির মতো
সাজানো হাতে গোণা কিছু বাড়িঘর। হাজার খানেক
ছবি বোধ হয় তোলা হলো সবক’টি মোবাইল কামেরা মিলে। একটু
সাহস করে খানিকটা নিচে নেমে এলাম আমি, সন্দীপা, দেবিস্মিতা আর ক্যাপ্টেন। বনানী এখানে
খানিকটা গভীর। আমাদের বনানী তাই আর এই সাহসিকতায় গেল না। অন্যরাও
না। সেই ‘ওস্তাদের মার শেষ রাত’
এর মতো এই অজানা, অনাস্বাদিত স্বাদ নিয়ে এবার ফেরার
পালা। দুপুর সাড়ে এগারোটায় ফেরার ট্রেন। টিকেট
যদিও হাফলং থেকে কিন্তু তার পরের স্টেশন মাহুর থেকেই আমরা উঠবো। তাই
নেমে আসতে লাগলাম। রাস্তার দু’পাশে প্রস্ফুটিত সূর্যমুখীর
মেলা। কী যে পাগলামোতে পেয়ে বসলো - গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে দু’টি ফুল পেড়ে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে
তুলে দিলাম সহধর্মিণীর হাতে। সে এক নশ্বর
দৃশ্য। সহধর্মিণী রুমকি বাকহারা। ভাগ্যিস
ছোটরা সবাই নামেনি গাড়ি থেকে। ছবি ওঠালো ক্যাপ্টেন
আর সুচয়িতা।
গেস্ট হাউসে
এসেই দেখি বলা মতো গরম গরম ভাত, ডাল আর আলু সেদ্ধ তৈরি। মহিলারা
হাত লাগিয়ে চটপট কয়েকটি ওমলেট বানিয়ে ফেললেন - যেন নিজের ঘরেই আছেন। খাওয়া
শেষ হতে না হতেই সুবন-দা এসে তাড়া লাগিয়ে দিলেন। সময়
মতো আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়ার দায়টিও যে তাঁরই। সকালে
ঘুরতে যাওয়া গাড়িটি আর সুবন-দার গাড়ি দু’টি করে আমরা চললাম রেল স্টেশনের উদ্দেশে। যাওয়ার
আগে কেয়ারটেকার দাসবাবু তাঁর মোবাইল খুলে দেখালেন তাঁর ছোট মেয়েটির ছবি। অবিকল
আমার মেয়ে সুচয়িতার মতো। আমার চোখটি কেন জানি খানিক সিক্ত হয়ে
উঠলো। এমনিতেই। মনে হলো সত্যি
কী বিচিত্র এই ধরণী। কী বিচিত্র আমাদের জীবনধারা। সুবন-দা আর দাসবাবুকে নিয়ে ছবি উঠলাম আইবির সামনে দাঁড়িয়ে - যেখানে যাপিত হলো জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। খানিক
বিহ্বলতার মুহূর্ত বৈকি।
শেষ হয়েও হইল
না শেষ গোছের চমকটি যে অপেক্ষা করে রয়েছিল আমাদের জন্য - জানতাম না তা। মাহুর স্টেশনে নেমে
আসতেই দু’চোখ জুড়িয়ে গেল তার প্রাকৃতিক দৃশ্যে। ছবির
মতো পাহাড় কেটে তৈরি স্টেশনটি। লাইনের পাশেই
অগুনতি কাশের গুচ্ছ দাঁড়িয়ে আছে যেন ঝরে যাওয়ার আগে আমাদের বিমোহিত করার দায় মাথায়
নিয়ে। কাশগুচ্ছ, রেলের আঁকাবাঁকা লাইন
আর পাহাড়ের অপরূপ মোহে আটকে রয়েছিলাম যেন দীর্ঘ সময়। হঠাৎ
দূরে দেখা গেল পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে আসছে আমাদের গাড়িটি। সে কী
স্বর্গীয় দৃশ্য তা লিখে বোঝানোর কোনও উপায় নেই। সুবন-দা তৈরি হয়ে গেলেন। গাড়ি এসে দাঁড়ালো। উঠলাম
একে একে। ছাড়ার আগে হাত নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম এই অমায়িক
মানুষটিকে।
এক শ্বাসে পড়লাম ও খুব উপভোগ করলাম ।দুর্দান্ত লিখলে ।।
ReplyDelete👍👍
DeleteJust Beautiful... Thank you for giving the opportunity to recall the memorable trip once again through your writing..
ReplyDeleteঅভিভূত।মানসভ্রমণ হয়ে গেল
ReplyDelete