Skip to main content

বরুণার কথা


স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ের উপাখ্যান 

উপন্যাসের প্রারম্ভেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে প্রবীণ নাথ, মনীষ দাশ, বিকাশ দেব ও বিজু কাকতির উদ্দেশে এ অঞ্চলে সাময়িক কালের এক অতি পরিচিত সাহিত্যিক অনিল দাশ পুরকায়স্থের এটি হচ্ছে সপ্তম প্রকাশিত গ্রন্থ - এর আগে উপন্যাস না লিখলেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লিখা বিষণ্ণ বেহালা (কাব্য), স্মৃতি থাক ছড়াতে (ছড়া), কিংবদন্তির আঙিনায় (লোককথা), সুরের ঝর্ণাধারায় (সংগীত), শ্রীহট্টের মালসী সংগীত ও ধুরা (লোকসংস্কৃতি) এবং শ্রীহট্টের ব্রতকথা (লোকসংস্কৃতি)

এ উপন্যাসের মূল থীম হচ্ছে বাল্যপ্রেম ও তার পরিণতি যদিও ত্রিভুজ প্রেমের খানিকটা আভাস পাওয়া যায় তবে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মূল নায়িকা, লেখকের মানসপ্রতিমা বরুণাকে কেন্দ্র করেই। নায়ক অনিমেষের (অনু) ভাবনাতেই রচিত হয়েছে উপন্যাস। উপন্যাসের আপাতঃ বিয়োগাত্মক পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত মেলে প্রারম্ভেই। শুরুটা এরকম - বরুণা চলে গেছে। শূন্য করে দিয়ে গেছে তার সমগ্র অস্তিত্বকে। আজ চারমাস সে একা। বরুণা আর কখনো আসবে না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই শূন্যতার বোঝা বয়ে বেড়ানো যে কী কষ্ট তা অনিমেষ বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, আর এক একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চূর্ণ করে বেরিয়ে আসে। তবুও বুকটা হালকা হতে চায় না। জগদ্দল পাথরের মতো বুকের উপর যেন বসে বসে অতীত রোমন্থন করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই।

কাহিনীর পটভূমি অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টের কিছু অঞ্চল। বিবিয়ানা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসরত তৎকালীন সমাজের এক সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে চরিত্র বিশ্লেষণে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ব সময়ের কাহিনীতে লেখক কিছুটা আভাস দিয়েছেন বিপ্লবী তৎপরতা এবং বাংলা বিভাজনের সম্ভাব্য করুণ পরিণতিরও।

নায়ক-নায়িকার শিক্ষিত, রুচিশীল মনের এক পবিত্র, নিটোল চিত্র পরিষ্ফুট হয়েছে সুচারু রূপে। মাঝে-মাঝেই কালিদাস, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথের উক্তির পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রদেরও অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা দুর্ঘটনাকে মূল কাহিনীর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে গল্পের জালের বুনোট হয়েছে পোক্ত।

প্রেক্ষাপট এবং সময়ের ব্যবধানে আধুনিক মানসে এ উপন্যাস পড়তে গেলে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না বাস্তবকে। কিন্তু তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা এবং পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাস সর্বার্থেই সার্থক বলে অভিহিত করা যায়। গ্রাম বাংলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সামাজিক উপাদানে ভরপুর এ উপন্যাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় বিশেষ করে শরৎচন্দ্রকে।

উপন্যাসের মূল কাহিনীটি এরকম - ‘একেবারে প্রথম কৈশোর গ্রামান্তরে মেসোর বাড়িতে পড়াশোনা করতে গিয়ে হঠাৎ করে বরুণাকে দেখে মনে ধরে যায় অনিমেষের। ক্রমে তা পরিণত হয় গভীর ভালোবাসায়। বরুণাও অনিমেষের মধ্যে খুঁজে পায় তার ভবিষ্যৎকে। একদিন বিবিয়ানার তীরে গোধূলি লগনে সবার অলক্ষ্যে বরুণা অনিমেষের গলায় পরিয়ে দেয় পুস্পমালা। সাক্ষী শুধু নদীমাতৃ। মালাটি ধীরে ধীরে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে অনিমেষ বলে - আমরা তোমার স্নেহের পুত্র-কন্যা। সময়ে সহায় করো মা।

এদিকে উচ্চশিক্ষার আশায় অনিমেষ যখন পাড়ি দেয় শহরের উদ্দেশে তখন নদীপথে নৌকাডুবিতে আত্মসমর্পণ করে পিতৃমাতৃ হারা কিশোরী মালা। নিজেরই অজান্তে অনিমেষকে ভালোবেসে ফেলে মালা।

এরপর উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনিমেষ যখন ফিরে আসে তখনই বরুণার এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মামার জেদের বশে হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে যায় প্রিয়নাথের সঙ্গে। এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি কেউই। বরুণাও না। কোনদিনই সে স্বামীসংলগ্না হয় নাএ বিড়ম্বনায় বিপর্যস্ত অনিমেষ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বরুণার মন রাখতে প্রিয়নাথ খুঁজে পেতে নিয়ে আসে উদভ্রান্ত অনিমেষকে। ইতিমধ্যে অনিমেষের বিয়ের জন্য চেষ্টা করতে থাকে বরুণা। মালার কাছে প্রস্তাব দিলে মালা তা প্রত্যাখ্যান করে সসম্মানে। থেকে যায় অ-উদ্বাহিত। এরপর বরুণার পীড়াপীড়িতে এবং বাবার আদেশে বিয়ে হয়ে যায় অপ্রস্তুত অনিমেষেরও। অনু একদিন স্ত্রী অর্পিতাকে খুলে বলে সব। অর্পিতার ইচ্ছানুযায়ী বরুণার সঙ্গে দেখা হয় অর্পিতার। অর্পিতা ও অনিমেষের একমাত্র পুত্র অর্পণের জন্ম দিয়েই মারা যায় অর্পিতা। মাতৃস্নেহে বরুণাই মানুষ করে তোলে অর্পণকে। পরিশেষে মালার হাতে অর্পণকে তুলে দিয়ে শেষ বিদায় নিয়ে প্রিয়নাথের কাছে চলে যায় বরুণা।

শেষ বিদায়ের সে দৃশ্য বড় করুণ। প্রত্যেকটি মূল চরিত্র হয়ে পড়ে বড় একাকী। তা বরুণার শেষ কথাগুলোর মধ্যে ধরা পড়ে। মালাকে বরুণা বলছে - কোথাও জায়গা নেই মালা, সব শূন্যতুমি একা, আমি একা, অর্পণের বাবা একা। সপ্তগ্রামে একা বসে আছেন তিনি (তিনি অর্থে প্রিয়নাথ)। এ যে একার সমাহার মালা। কী শূন্যতা, কী রিক্ততা। আজ আর কেউ নেই মালা, কেউ নেই। এই বিশ্ব সংসারে আমরা সবাই একা।

তাই ফিরে যায় বরুণা। বলে - বাকি জীবনটা আমি ওর কাছেই কাটাতে চাই মালা। জীবনের শেষ ক’টা দিন, যে আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করলো, তার একটু সেবা করে মরতে চাই।

পবিত্র প্রেম, মাতৃস্নেহ আর পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে রইল বরুণা। তাই ‘বরুণার কথা’ নামাকরণ একশো ভাগ সার্থক।

দৈব দুর্বিপাকের আবর্তেই যেন গড়ে উঠেছে কাহিনী। সম্পর্কের বীক্ষা একদিকে যেমন জোড়া লেগেছে তেমনি ভেঙেছেও স্বাভাবিক ছন্দে। এ উপন্যাসের চরিত্রসমূহের একটা বিশেষ দিক হচ্ছে এদের বলিষ্ঠ মানসিকতা। কেউই নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয়নি দুর্বিপাকের কবলে। বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে নিয়েছে স্বকীয়তায়। এখানেই সম্পূর্ণভাবে ফুটে ওঠে লেখকের এক আশাবাদী মনোভাব।

এ অঞ্চলে বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের সংখ্যা নিতান্তই সীমিত। তার উপর উপন্যাস প্রকাশিত হতে সচরাচর দেখাই যায় না। সে অর্থে লেখকের প্রচেষ্টা যতটুকু, সার্থকতাও ততটুকুই। উপন্যাসের বেশ কয়েকটা জায়গায় র এবং ড় এর পারস্পরিক স্থানচ্যুতি বই পড়ার স্বাভাবিক ছন্দকে বিঘ্নিত করে। যেমন -‘দু’টি গড়দ পড়েছে দু’জনে’ (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬১) ইত্যাদি।

এর বাইরে নগণ্য সংখ্যক মুদ্রণ প্রমাদ ছাড়া প্রকৃতার্থে বিরূপ সমালোচনার স্থান বিশেষ নেই বললেই চলে। পাকা বাঁধাই করা ৭৬ পৃষ্ঠার অফসেটে ছাপানো এ বই-এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন হিমাংকন দাস। দাম চল্লিশ টাকা। 

(সংযোজন - উপন্যাস এবং আলোচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ ইংরেজিতে। পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারে ৭৬ পৃষ্ঠার একটি কাহিনিকে হয়তো উপন্যাস বলা যাবে না। কিন্তু এ অঞ্চলের তৎকালীন সাহিত্য প্রকাশের ধারাবাহিকতায় এ ছিল এক উল্লেখযোগ্য অবদান। তাছাড়া কাহিনির বুনোটে ও বিস্তারে একে অনায়াসেই একটি উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া যায় বলেই ভাবি। এই আলোচনাটি আমার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ আলোচনা। প্রয়াত অনিল দাশ পুরকায়স্থই হলেন আমার প্রণম্য সাহিত্যগুরু। আলোচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৫ অক্টোবর ২০০৩ তারিকে গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত - অধুনা লুপ্ত - সময় প্রবাহ পত্রিকায়। বানান অপরিবর্তিত রইল)।

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...