স্বল্পবাকের কবিতা সংকলন - ‘উত্তরগোধূলি’
অনীতা দাস ট্যান্ডন (কবি এভাবেই নামটি
লিখেন) উত্তরপূর্বের কবিতাবিশ্বে, বিশেষ
করে বরাক উপত্যকা ও আসামের বাংলা সাহিত্য জগতে একটি পরিচিত নাম। শুধু
কবিতাই নয় গদ্যের হাতটিও তাঁর যথেষ্ট পাকা বলেই জ্ঞাত। কবির ‘উত্তরগোধূলি’
কাব্যগ্রন্থটি বেশ কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। ৬৪
পৃষ্ঠার গ্রন্থটির দুই মলাটের ভিতরে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট পঞ্চাশটি ভাবসমৃদ্ধ কবিতা। আদ্যোপান্ত
ভাবের সুস্পষ্ট প্রকাশ। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘সেই প্রার্থনাকে যা আমাকে তোমার সাথে
বাঁধে ……’।
‘বাবাকে’ শিরোনামে লিপিবদ্ধ শেষ কবিতাটি মোট সাতটি বিভাগে লিখিত, তিন পৃষ্ঠা জোড়া এক দীর্ঘ কবিতা। এর বাইরে অন্য ৪৯ টি কবিতাই স্বল্পবাকের, স্বল্পদৈর্ঘের কবিতা। স্বল্প কথায় কবি স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর মননের বিচিত্র সব অনুভূতি। নিখাদ গদ্যছন্দে লিখিত বেশ ক’টি কবিতা আবার অবয়বের দিক থেকেও গদ্যরূপেই সজ্জিত।
অধিকাংশ কবিতায় কোথাও যেন এক পড়ন্ত বিকেলের আচ্ছন্নতার বোধ। তাই হয়তো - উত্তরগোধূলি -
ধোঁয়ায় ক্লান্ত চোখ
কানে কাঠ ভাঙার শব্দ
পোড়া-পোড়া গন্ধ নাকে
জিহ্বায় ছাইয়ের স্বাদ
ভেতরে চিতা জ্বলছে অবিরাম।
(কবিতা - দহন)।
‘মায়া’ সিরিজের তিনটি কবিতাও সেই গোধূলির আবছায়া রূপটিকেই মূর্ত করে তোলে যেন -
শুয়ে আছি, ঘুম নেই
জেগে আছি, হুঁশ নেই
চলে যাচ্ছি, পথ নেই
কেঁদে যাচ্ছি, অশ্রু নেই
হাসছি যদিও, হাসি নেই
বেঁচে রয়েছি, স্পন্দন নেই।
(মায়া - ২)।
ভাবসমৃদ্ধ কবিতার সমাহারে স্বভাবতই রূপক, ব্যঞ্জনার আধিক্য। এখানেও কবি অনেকটাই ব্যতিক্রমী। খুব সহজে খেই ধরিয়ে দিতে সক্ষম অভীষ্ট ভাবধারার সপক্ষে।
মন্দিরে ঢুকতে গিয়েই থমকে পড়ি
আর্ত স্বরে ডাকে গাছের গায়ে
ঝুলতে থাকা প্রার্থনা সকল
মন্ত্রমুগ্ধ আমি তাহাদের কাছে যাই
একে-একে সবাইকে ছুঁয়ে দেখি
অনুভব করি তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস
সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে
সঙ্গে আনা প্রার্থনাটি
বাইরে ঝুলিয়ে যাই।
(কবিতা - ডাক)।
কিংবা -
ঠোঁটে আটকে-থাকা সব কথা জমতে জমতে
এমন জট পাকিয়েছে যে কখনো যদি বলার সাহসও পাই, জট খুলতে খুলতেই
সময় পেরিয়ে যাবে। এই সত্য জেনে, এই কথাগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোপণ করে দিয়েছি
ভেজা বর্ণমালা।
(কবিতা - ভেজা বর্ণমালা)।
ভাবের ঘোরে কবির কল্পনায় আপন ছন্দে ভাস্বর হয়ে ওঠে কিছু ভাবনা, কিছু অনুভূতি - ব্যঞ্জনায় ব্যাঞ্জনায় -
একদিন খুব ভোরে ওঠে দেখি, চড়াই, শালিখ, পাহাড় ও মন্দিরের চূড়ায় ধ্যানস্থ শিব কোথায় যেন
চলে গেছে। সমস্ত
গাছের মাথা কেটে দিয়েছে আগের রাতের প্রবল বৃষ্টি। মেঘেরাও বসে আছে কান্না-কান্না চোখ নিয়ে। সবাই
কোথায় গেল ? প্রশ্ন ছুঁড়তেই বাতাসও থমকে গেল। কী অন্ধকার ! কী অন্ধকার
! নীলাম্বরের জন্য মন হাহাকার করে উঠল। অস্থির হয়ে খুঁড়তে আরম্ভ করলাম। প্রাণপণে
দু’হাতে
খুঁড়ছি, কিন্তু শ্রাবণ মাস, যত খুঁড়ি তত
জল বেরোয়। বুক
ধক করে উঠল। এ
কোন সমুদ্র গর্ভে নিয়ে বসেছে আকাশ, সে কি জানে না আজ পূর্ণিমা !
(কবিতা - আজ পূর্ণিমা)।
‘বাবাকে’ কবিতাটি একেবারেই ভিন্নধর্মী একটি কবিতা। এ যেন এক তারা হয়ে যাওয়া বাবার সাথে তার আদরের কন্যার এক নিভৃত আলাপন - যে আলাপনে উঠে এসেছে যাবতীয় কষ্ট, জীবনের যাবতীয় ব্যথা - কথা। দীর্ঘ এই আলাপন পাঠককে অশ্রুসিক্ত করে তোলে অনায়াসে।
গোধূলি লগনে এভাবেই পুরো গ্রন্থটি জুড়ে কবির কলম ছুঁয়ে গেছে পাঠক হৃদয়। কবির যাবতীয় বোধ, ভাবনার প্রতিফলন এভাবেই যেন একটি কবিতার উদাসী পংক্তিগুলোর হাত ধরে প্রতিভাত হয় সঠিক দিশায় -
প্রায়ই মনে হয়
এই জীবন আমার নয়
ভুলে-ভুলে অন্য
কারুর জীবন যাপন করছি
বহুকাল …
হয়তো আমার জীবন যাপন
করছে অন্য কোথাও
কোনও এক উদ্বায়ী প্রতিপক্ষ।
(কবিতা - পরগাছা)।
জীবনবোধের এক বিচিত্র উদাস বিশ্লেষণ তাই - ‘উত্তরগোধূলি’।
অক্ষর পাবলিকেশনস্, আগরতলা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মানানসই প্রচ্ছদ এঁকেছেন পল্লব ভট্টাচার্য। বর্ণ, অক্ষর ও শব্দ বিন্যাস যথাযথ। সামান্য সংখ্যক বানান ভুল ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভালো। কবির কবিতায় যতি চিহ্নের ব্যবহার বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে ‘উত্তরগোধূলি’ স্বল্পবাকের ভাবনাসঞ্জাত এক সুখপাঠ্য কবিতা সংকলন।
‘উত্তরগোধূলি’
অনীতা দাস ট্যান্ডন
মূল্য - ৭৫ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২৭০৫৭৮৯
‘বাবাকে’ শিরোনামে লিপিবদ্ধ শেষ কবিতাটি মোট সাতটি বিভাগে লিখিত, তিন পৃষ্ঠা জোড়া এক দীর্ঘ কবিতা। এর বাইরে অন্য ৪৯ টি কবিতাই স্বল্পবাকের, স্বল্পদৈর্ঘের কবিতা। স্বল্প কথায় কবি স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর মননের বিচিত্র সব অনুভূতি। নিখাদ গদ্যছন্দে লিখিত বেশ ক’টি কবিতা আবার অবয়বের দিক থেকেও গদ্যরূপেই সজ্জিত।
অধিকাংশ কবিতায় কোথাও যেন এক পড়ন্ত বিকেলের আচ্ছন্নতার বোধ। তাই হয়তো - উত্তরগোধূলি -
কানে কাঠ ভাঙার শব্দ
পোড়া-পোড়া গন্ধ নাকে
ভেতরে চিতা জ্বলছে অবিরাম।
(কবিতা - দহন)।
‘মায়া’ সিরিজের তিনটি কবিতাও সেই গোধূলির আবছায়া রূপটিকেই মূর্ত করে তোলে যেন -
শুয়ে আছি, ঘুম নেই
(মায়া - ২)।
ভাবসমৃদ্ধ কবিতার সমাহারে স্বভাবতই রূপক, ব্যঞ্জনার আধিক্য। এখানেও কবি অনেকটাই ব্যতিক্রমী। খুব সহজে খেই ধরিয়ে দিতে সক্ষম অভীষ্ট ভাবধারার সপক্ষে।
মন্দিরে ঢুকতে গিয়েই থমকে পড়ি
আর্ত স্বরে ডাকে গাছের গায়ে
ঝুলতে থাকা প্রার্থনা সকল
মন্ত্রমুগ্ধ আমি তাহাদের কাছে যাই
একে-একে সবাইকে ছুঁয়ে দেখি
সঙ্গে আনা প্রার্থনাটি
বাইরে ঝুলিয়ে যাই।
(কবিতা - ডাক)।
কিংবা -
(কবিতা - ভেজা বর্ণমালা)।
ভাবের ঘোরে কবির কল্পনায় আপন ছন্দে ভাস্বর হয়ে ওঠে কিছু ভাবনা, কিছু অনুভূতি - ব্যঞ্জনায় ব্যাঞ্জনায় -
‘বাবাকে’ কবিতাটি একেবারেই ভিন্নধর্মী একটি কবিতা। এ যেন এক তারা হয়ে যাওয়া বাবার সাথে তার আদরের কন্যার এক নিভৃত আলাপন - যে আলাপনে উঠে এসেছে যাবতীয় কষ্ট, জীবনের যাবতীয় ব্যথা - কথা। দীর্ঘ এই আলাপন পাঠককে অশ্রুসিক্ত করে তোলে অনায়াসে।
গোধূলি লগনে এভাবেই পুরো গ্রন্থটি জুড়ে কবির কলম ছুঁয়ে গেছে পাঠক হৃদয়। কবির যাবতীয় বোধ, ভাবনার প্রতিফলন এভাবেই যেন একটি কবিতার উদাসী পংক্তিগুলোর হাত ধরে প্রতিভাত হয় সঠিক দিশায় -
এই জীবন আমার নয়
ভুলে-ভুলে অন্য
বহুকাল …
করছে অন্য কোথাও
কোনও এক উদ্বায়ী প্রতিপক্ষ।
(কবিতা - পরগাছা)।
জীবনবোধের এক বিচিত্র উদাস বিশ্লেষণ তাই - ‘উত্তরগোধূলি’।
অক্ষর পাবলিকেশনস্, আগরতলা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির মানানসই প্রচ্ছদ এঁকেছেন পল্লব ভট্টাচার্য। বর্ণ, অক্ষর ও শব্দ বিন্যাস যথাযথ। সামান্য সংখ্যক বানান ভুল ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভালো। কবির কবিতায় যতি চিহ্নের ব্যবহার বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে ‘উত্তরগোধূলি’ স্বল্পবাকের ভাবনাসঞ্জাত এক সুখপাঠ্য কবিতা সংকলন।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
অনীতা দাস ট্যান্ডন
মূল্য - ৭৫ টাকা
Comments
Post a Comment