Skip to main content

অসহনীয় সময়ের দলিল - 'সময়ের দর্পণ'



বিশে বিশ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে হাজির
তীব্রগতির মৃত্যুথাবা গড়েছে নজির,
একটি বছর নিরালা করে গেল
কত পরিবার স্বজনহারা হল।
বিশে বিশ বিষণ্ণতার।
 
এক বুক আশা নিয়ে ইতিউতি সংবাদ
বিয়োগের ঘরে একটি বছর পূর্ণবিষাদ।
ভালোবাসার ভাগীরথী অন্তঃসলিলা
ভেতরে শুকোয় সরস্বতী।
স্রোতে ভাসে যাপনের ককতা
চারদেওয়ালে জীবন বাজি।
...... (কবিতা - বিশের বিশ বিষময়)
কিংবা -
ডোমেরা আজ ক্লান্ত, শ্মশানে
এত ব্যস্ততা ছিল না কখনো,
মর্গ থেকে থরে থরে আসে
আরো ভেসে আসে গঙ্গার স্রোতে,
মৃত্যুমিছিল ঠিকানাবিহীন
শেষযাত্রায় সম্মানহীন।
মৃত্যু এখন সহজলভ্য
বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য।
...... (কবিতা - সময়ের দর্পণ)।
হালে অতিমারীর ভয়াবহ সময়টিকে এভাবেই দুই মলাটে ধরে রেখেছেন কবি মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম তাঁর সদ্যপ্রকাশিত প্রথম কাব্য সংকলন ‘সময়ের দর্পণ’-এ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া অসম গ্রন্থমেলা, গুয়াহাটিতে উন্মোচিত হয় তাঁর এই অসামান্য সময়ের দলিল। গ্রন্থটি উন্মোচন করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক দেবব্রত রায়চৌধুরী যিনি আবার অনবদ্য লেখনীতে ভূমিকাও লিখে দিয়েছেন এই গ্রন্থটির। ভূমিকাতে গ্রন্থের সারমর্ম অনেকটাই বর্ণিত হয়ে আছে। তবু কবির কবিতার রসাস্বাদনে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে হয় না থেমে। পাঠকের হৃদয়ে বিগত দুঃসময়ের বিষাদময় এক চিত্র ভেসে ওঠে। তনুমন আন্দোলিত হয় পাঠের নিমগ্নতায়, কবিতার ভাষায়, বাঁধনে। প্রতিটি কবিতায় সময়টিকে ধরে রাখার প্রয়াসের পাশাপাশি অনুভূত হয় এক লুক্কায়িত ছন্দ। সে ছন্দ হয়তো ব্যাকরণের নিয়ম মেনে নয় তবু হৃদয় দোলায় নিশ্চিত।
মোট ৯৮ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ৫০ টি কবিতা। বিষয়ভিত্তিক এই সংকলনেও কবি অনবদ্য মুন্সিয়ানায় ধরে রেখেছেন বৈচিত্র। আছে কিছু ছড়ার ফর্মাটে লিখা কবিতা। যেমন - লকডাউন, মতিভ্রম, পরিত্রাণের খোঁজে, সুখের পদ্য, উৎসব ইত্যাদি। কিছু নমুনা -
উড়নচণ্ডী বাতাবরণ
প্রশাসনের নিদ্রাহরণ।
আমিই আমার মধুসূদন
চারদেয়ালে দিনযাপন ... (কবিতা - উৎসব)। কিংবা -
নতুন ব্যামো করোনা
ঘর থেকে বেরোতে মানা।
ঘরে বসে কাজ নেই
ছড়া তাই লিখে যাই ... (কবিতা - লকডাউন)।
করোনার আবহে আছে কিছু শ্লেষাত্মক কবিতা। যেমন - পরীক্ষা, জীবশ্রেষ্ঠ, ঘোমটার আড়ালে, সংকটে ঈশ্বরপুত্র, অজান্তে ইত্যাদি। কোভিডকালে যারা নেতিবাচক ভূমিকায় সমাজকে বিভ্রান্ত করেছিলেন তাদের প্রতি বিদ্রুপে বর্ষিত হয়েছে কাব্যিক কশাঘাত।
পুরো সময়টাকে ধরে রাখতে একের পর এক কবিতা সাজিয়েছেন কবি অন্তরের গরজে। সব কবিতাই ছুঁয়ে যায় পাঠক মন। তবু উল্লেখ করতেই হয় বিশেষ করে - কোভিড নাইন্টিন, হঠাৎ, বিষণ্ণ কথামালা, যোগ বিয়োগ, মাতৃভূমি, লকডাউন ডায়েরি, খোলা চিঠি, বিকল্প জ্ঞান, সৎকার, অজানা ঠিকানা, সময়ের দর্পণ, স্বপ্নের মাস্তুল ইত্যাদি কবিতাগুলির কথা। বস্তুতঃ পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া এই নিদারুণ সংকটবেলার প্রতিটি দিক ছুঁয়ে গেছেন কবি তাঁর কবিতার মাধ্যমে। দেশনেতা থেকে ভণ্ড নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান থেকে আমজনতা, বুভুক্ষা থেকে খাদ্য উৎসব, কোভিড যোদ্ধা থেকে দিনমজুর, ছাত্র থেকে শিক্ষক, অফলাইন থেকে অনলাইনের পালাবদল সব সব কিছু বন্দি করে রেখেছেন দুই মলাটে।
অবশেষে কোভিড বিদায়ের শান্তি, আগামীর স্বস্তিবেলার আবাহন দিয়ে টেনেছেন সমাপ্তিরেখা।
ব্রহ্মপুত্রের বালিচরে
ধুলোর ঝড় উঠেছে,
একদিন সব ঝড় থেমে যাবে
পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হবে। (কবিতা - আশায় আশায়)। কিংবা -
যদি জিতে ফিরে মানুষ
মিলন হবে আবার
ভালোবাসার উঠোনে।
বাড়িয়ে দেব তোমার দিকে,
মারী শেষে মুক্ত হাত।
উন্মুক্ত আকাশের নীচে
ভালোবাসা বেঁচে থাক। (কবিতা - সেরে ওঠো পৃথিবী),
অনেক দিন পর,
স্বপ্নহীন দমবন্ধ নিঃসঙ্গতার শেষে
যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে নতুন আলো,
নতুন জীবনের শুরু।
ভীষণ অন্ধকার আবর্ত ঘুরে
পৃথিবী আজ সুস্থ। (কবিতা - অনেক দিন পর)।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা - ‘পরিযায়ী’। করোনা বিভীষিকার আবহে পরিযায়ী শ্রমিকের দুঃসহ বেদনার এক অসাধারণ প্রতিবেদন। ভূমিকা লেখকের কথায় - ‘পরিযায়ী’ কবিতা দিয়েই কবি মীনাক্ষী তার জাত চিনিয়ে দিয়েছে।
কবি আবার শেষের কবিতা ‘প্রত্যয়’-এ ধরে রেখেছেন সুস্থ পৃথিবীর গভীর প্রত্যয় -
নতুন দিনে শোকতাপ ভুলে
মারীকে আমরা করব জয়,
আবার হাসব, ভালোবাসব
মনের গভীরে দৃঢ় প্রত্যয়।
কবি ও প্রকাশক উঁই প্রকাশনী বানানের শুদ্ধতার জন্য ধন্যবাদার্হ অবশ্যই। তবে আরো খানিকটা যত্নবান হলে পংক্তিসজ্জার ছোটখাটো ত্রুটিগুলোও দূর করা যেত। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ করেছেন নান্নু। কবি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন - ‘মা হিরণ্ময়ী চক্রবর্তী ও বাবা আশুতোষ চক্রবর্তীর করকমলে’।
 
কবি মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম বড় যতনে সাজিয়ে রেখেছেন সময়টাকে। তাই ইতিহাসের পাতায় এক কাব্যিক দলিল হয়ে রইল ‘সময়ের দর্পণ’।
 
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
‘সময়ের দর্পণ’
মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৩৯২৬০৬

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়