Skip to main content

বোগেনভেলিয়া ফুটেছে


বোগেনভেলিয়া ফুটেছে
 
মূল অসমিয়া গল্প - বোগেনভেলীয়া ফুলিছে - রুমী লস্কর বরা
অনুবাদ - বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
 
- কোথায় যাচ্ছ ?
সুশান্ত চলিহার প্রশ্নটি বেলি বোধহয় শুনলো না পুত্রবধূ বেলির এই শান্ত, সমাহিত রূপ আগে কখনো দেখেননি চলিহা সেজন্য চলিহা ভেতরে ভেতরে অবাক হওয়ার সাথে সাথে চিন্তিতও হলেন এবার তিনি প্রয়োজনের চাইতে উচ্চস্বরে কথাটি বউকে পুনঃ জিজ্ঞেস করলেন - ‘কোথায় যাচ্ছ বেলি ? ঘরের প্রবেশপথ কখনই পেরিয়ে এলাম
উদাস উদাস ভাব নিয়ে গাড়ি চালাতে থাকা বেলি শ্বশুরের প্রশ্নে চমকে ওঠার মতো করে জোরে ব্রেক কষে দিল সুশান্ত চলিহা সামনে হেলে গিয়ে আবার বসে থাকা সিটে নিজে থেকেই ঠেস খেয়ে বসে গেলেন এক হাতে গাড়ির সামনের দিকে ভর দিয়ে খুক খুক করে কাশতে শুরু করলেন বেলি ব্যস্ত হয়ে পড়ল
- কী হলো ? কী হলো বাবা ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?
- না না তোমার কিছু হয়েছে নাকি ? ঘরে ঢোকার রাস্তাটি কখন ছেড়ে এলাম বুঝতে পারলে না ? কথাটি কী ?
কাশতে থাকার মাঝে সুশান্ত চলিহা কথাটি বউকে জিজ্ঞেস করলেন
বউ প্রথমবারের মতো শ্বশুরকে অবাক করে বিনম্রভাবে বলল -
- বুঝতে পেরেছি বাবা আজ আপনাকে নগরটির এক মাথায় থাকা অনাথ আশ্রমটিতে নিয়ে যাব
- কী ? কী বললে ?
না সুশান্ত চলিহা কোনভাবেই কথাটি বিশ্বাস করতে পারেননি এ তাঁর সামনে সেই উদণ্ড স্বভাবের, স্বার্থপর হেন বেলি চলিহাই তো ? তাঁর সুখ-দুঃখ, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, অসুখ-বিসুখ এর ব্যাপারে সম্পূর্ণ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে কেবল নিজের আমোদ-বিলাস, বৈষয়িক প্রেমে অন্ধ হয়ে থাকা বেলি চলিহার মুখের কথা তো ? না স্বপ্ন দেখছেন ? হ্যাঁ; নিজের একাকীত্বের বেদনা, বঊ-এর তরফ থেকে পেয়ে আসা লাঞ্ছনা, দৃষ্টিকটু ব্যবহার, ছেলের উদাসীন স্বভাব, সহজ ধনলাভের প্রতি থাকা অত্যধিক মোহ দেখে-শুনে সুশান্ত চলিহার হৃদয়কে বোবা বেদনা কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁর জীবনের সঞ্চিত সীমিত উপার্জনে নিজেকে চালিয়ে যাচ্ছিলেন একই ঘরে পুত্র-পুত্রবধূর সাথে থেকেও তিনি বহু যোজন দূরে বাস করছিলেন মেলে না ছেলের সঙ্গে, বউ-এর সঙ্গে কোনভাবেই তিনি একই পথের যাত্রী হতে পারেন না তাঁর পথ ছিল মানব প্রেম হাতে লেগে থাকা কলম থেকে নির্গত শব্দ সৃষ্টি বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে নিমগ্ন থাকা শ্বশুর সুশান্ত চলিহার কাজকর্মকে পুত্র-পুত্রবধূ কোনোদিনই সম্মানের চোখে দেখেনি সেই কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে আসা সুশান্ত চলিহা অন্তরের আঘাত চেপে রেখে স্বপ্ন দেখেছিলেন বুঝবে, একদিন ছেলে-বউও তাঁর কাজের মূল্য বুঝে উঠবে সুশান্ত চলিহা পুত্রবধুর মুখের দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকালেন আজ হঠাৎ বেলির উগ্র স্বভাবের পরিবর্তে দেখতে পারা শান্ত, বিনম্র আচরণ, সুশান্ত চলিহার ভালো লাগা - খারাপ লাগা দিশার প্রতি এত সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি আঃ হ্যাঁ, চলিহা আশাবাদী কিন্তু এতটুকু পলকে জগতে সব প্রাপ্তি কি সম্ভব ? বিদ্যুৎ, মেঘগর্জন, বজ্রপাতের মধ্য দিয়ে বছরের প্রতিটি দিন বর্ষার আভাস বোঝাতে থাকা বেলির আচরণ আজ যেন অকালে আশ্বিন আবহের স্বচ্ছ বার্তা চলিহার আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ যেন মনে হলো আজই এত বড় একটি সামাজিক সম্মানে তিনি বিভূষিত হয়েছেন অথচ সেই সম্মানপ্রাপ্তিতে তিনি যতটা আনন্দিত হয়েছিলেন, পুত্রবধূর এই আবদার তাঁকে যেন আজ হাতে স্বর্গ ছোঁয়ালো আবেগের আতিশয্যে তাঁর দুই চোখ সিক্ত হয়ে উঠল তাঁর ভাবনায় যতি ফেলে বউ বেলি চলিহা বলল -
- বাবা, প্রায়ই আপনি তাঁকে, অর্থাৎ আপনার ছেলেকে বলতে শুনেছি, অনাথ শিশুর আশ্রমে আপনি কিছু টাকা দান দিতে চান কথাগুলোয় আমরা দুজন গুরুত্ব দিইনি আজ হঠাৎ আমারও সেই আশ্রমটি দেখার ইচ্ছে হয়েছে তাই ভেবেছি, আপনার এই আনন্দের দিনটিতে সেই মনোবাঞ্ছাও পূর্ণ হোক
সুশান্ত চলিহা যেন এবার নিজের অবস্থিতিকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি কি সত্যি জেগে আছেন ? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানায় থেকে তিনি শুধু মুগ্ধ নেত্রে বউ-এর মুখের দিকে তাকালেন বেলি যেন পশ্চিমাকাশের বেলাটির মতো উজ্জ্বল, রঙিন আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভর দুপুরের প্রচণ্ড উত্তাপ, চোখে ছাট মারা প্রখর রশ্মির জন্য যে সূর্যের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না, সেই সূর্যই বিকেলে মোহিত করে সবাইকে পশ্চিমাকাশের বেলার উত্তাপহীন, প্রখর রশ্মিহীন রূপেই বেলার সমস্ত গুণাগুণ নির্ণীত হয়, এই রূপ অনন্য সৌন্দর্য বিলিয়ে জগতকে সম্মোহিত করে যায় সুশান্ত চলিহা একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামনের আঁকাবাঁকা পথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলেন অন্যদিকে বেলি ? একান্ত মনে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া বেলির মনের পথটি কত যে স্পীড ব্রেকার, বাঁক, এবড়ো-খেবড়োতে ঝাকুনি খেতে হচ্ছে এমন লাগছে যেন তার ফেলে আসা সারা জীবনেই বিশৃঙ্খলা সুদীর্ঘ জীবনের অন্তে শুধু একটি মুহূর্তের একটি কথাতে বুঝে উঠেছে তার প্রতি থাকা শ্বশুরের মমত্ববোধ পিতৃসম শ্বশুরের গুরুত্ব কী, ভূমিকা কী সে আজ ভালো করে বুঝে উঠেছে অথচ …… অথচ কী ? ছিঃ ছিঃ, ফিরে তাকিয়ে বেলি নিজের কাছেই আজ ঘৃণিত হয়ে পড়েছে বিকৃত হয়ে পড়েছে কেন ? কীসের মোহে সে আচ্ছন্ন ছিল ? কীসের জন্য তার এসে পড়েছিল এই উপরি অহমিকা ? এই জীবনে তার অস্তিত্বই বা কী ?
- বেলি, গাড়ির স্পীড বেশি হচ্ছে বুড়ো হয়েছি না ? ঘন্টায় ষাট কিলোমিটারের বেশি দেবে না মাথা ঘুরায়
- আচ্ছা বাবা
বলতে না পারার মতো করে বেলি ভাবনার তীব্রবেগী গাড়িটির সাথে পাল্লা দিয়ে গন্টায় আশি-একশো স্পীডে গাড়ি ছুটিয়ে চলছিল শ্বশুরের কথাতেই তার সম্বিৎ ঘুরে এল গাড়ির স্পীড কমালো স্টিয়ারিং ধরে থাকা বেলি গাড়ির স্পীড কমালেও বেলির জীবনের ফেলে আসা পথে কিন্তু অন্য এক গাড়ি চলতে থাকল তীব্র বেগে সেই স্মৃতির গাড়ির স্পীড কমলো না আজ তীব্রবেগে তার বুকের পথ দিয়ে আসা যাওয়া করে তাকে চঞ্চল করে তুলেছে সময়ে অসময়ে বুকের সুকোমল পথ ঘুঁড়ে নিয়ে তীব্র বেদনা দিচ্ছে
###
পনের বছর আগে প্রশাসনিক আধিকারিক নিশান্ত চলিহার কাছে বেলি বিয়ে হয়ে এসেছিল প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিক হিসেবে, বেলির দিকেও এসেছিল কিছু উপ-সম্মান সেই সম্মানের কৃত্রিম স্রোতে ভেসে থাকা বেলির ভাবার অবকাশই ছিল না - এর মধ্যে তার নিজের স্থিতি কোথায় বিলাসী আবাস, বিলাসী গাড়ি, দামি আসবাব, চাকর-বাকর, ক্ষীনতনু শোভিত করতে পারার মতো কাপড়, গয়না - বাঃ, এর চাইতে বেশি কী লাগে মানুষের ? এগুলোই তো অন্বেষণ করে মানুষ হাহাকার করে এসবের জন্যই তো মানুষ অমানুষের মতো অন্যায়-অনীতি করে তাহলে ? স্বামী নিশান্ত চলিহা তার জন্মদিনে উপহার দেওয়াআই টেনগাড়িটি সে চালাতে শিখেছিল গাড়ির কোন পার্ট্সের সঙ্গে কোন পার্ট্সের কী ধরণের সংযোগ থাকে - এসব মেকানিক্যাল কথা জানতে বেলি আগ্রহান্বিত ছিল না তার স্ফূর্তি - সে গাড়ি চালাতে পারা হয়ে গেল গাড়ির স্টিয়ারিং, ব্রেক, অ্যাক্সেলেটর, গিয়ার - এসব তার কন্ট্রোলে থাকে ব্যস্‌, এর চাইতে বেশি আর কী লাগে যে কটি কথা জেনে সে নিজেকে সুদক্ষ ড্রাইভার বলে ভেবে নিয়েছিল, ঠিক সেভাবে বিবাহিত জীবনের এই পনেরো বছরে কিছু উপরি প্রাপ্তিকে জীবনের সমস্ত প্রাপ্তি বলে সে ভ্রান্ত ধারণাতে ছিল নাকি ?
###
সামনে একটি বাঁক পেয়ে বেলি গাড়ির গিয়ার পরিবর্তন করে কিছু স্লো মোশনে আনলো সে এইটুকু সময়ে নির্বিকার হয়ে বসে থাকা শ্বশুরের মুখের দিকে তাকালো শ্রদ্ধা জেগে উঠল বলতে না পারার মতো এমন দেবতুল্য ব্যক্তিকে কত আঘাত দিয়েছিল
###
উপরি ধনের অহঙ্কারে উথলে উঠে লেখক শ্বশুরে করে আসা সামাজিক কাজকর্মকে সে তাচ্ছিল্য করে আসছিল বিয়ের সাত বছরের মধ্যে বেলি ও নিশান্তের জীবনে আসা দুই পুত্র সন্তানের দেখাশোনার কাজ থেকেও অব্যাহতি নেওয়ার জন্য দার্জিলিং-এর একটি বোর্ডিং স্কুলে রেখেছিল শ্বশুরের হাজার বাধা, কাকুতি - বেলি ও নিশান্ত শুনলো না স্বেচ্ছাচারী রানির মতো দর্পে-গর্বে অন্ধ বেলি শ্বশুরের নিষেধবাক্য, ছেলেদুটির চোখের জলকেও গুরুত্ব না দিয়ে তাদের বোর্ডিং-এ রেখে আজকের প্রচলিত অর্থেফ্রী উওমেনহয়ে থাকল শ্বশুরকে মানসিক ভাবে হত্যা করে সে যেন এক অবর্ণনীয় তৃপ্তি লভেছিল ভেবেছিল - এসব অত্যাচার সে করে যাবে, শ্বশুর অতিষ্ঠ হয়ে তার বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়াবেন আর এই সুযোগে স্বামী নিশান্তকে উত্যক্ত করে শ্বশুরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবে না শ্বশুরমশাই তার কোনো কথাতেই কোনো আপত্তি করেননি শ্বশুরের পছন্দ-অপছন্দকে গ্রাহ্য না করে দিনের বাসি ভাত টেবিলে সাজিয়ে রাখলেও তিনি নীরবে খেয়ে উঠে গিয়েছিলেন সভা-সমিতির জন্য প্রায়শঃ শ্বশুরের দেখা পেতে আসা মানুষের উপস্থিতিও বেলি সহজভাবে না নিয়ে সেরকমই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল কোনো সভা-সমিতি থেকে আসা শ্বশুরের গামছায় সুশোভিত গলাটি দেখলেই বেলি তাচ্ছিল্য করে বলত - ‘পঞ্চাশ-ষাট টাকার গামছাকটি পরতে দিনের পর দিন যে এভাবে লেগে থাকতে পারে, আশ্চর্য ছেলে কী দেয়নি ? না বুড়ো সেই খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি পরে একেবারে মহাত্মা সেজে ঘুরঘুর করতে থাকবে ছেলের মান-সম্মান কিছু বাকি রাখল না এই বুড়োটিএকজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে অবসর নেওয়া শ্বশুর সুবিধা পেলেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন -
- ‘নিশু, তুই এত তাড়াতাড়ি এত সম্পত্তি করেছিস যে ? বেতন কত পাস, অ্যাঁ ?’
কথাটি জিজ্ঞেস করে শ্বশুর সেদিন যেন ভীমরুলের চাকেই হাত দিয়েছিলেন ছেলে কিছু বলার আগেই বেলি গর্জে উঠেছিল উফ্‌, সেদিন সে শ্বশুরকে কত বাজেভাবে অপদস্থ করেছিল শ্বশুরমশাই নীরবে শুনে গিয়েছিলেন কোঠার দ্বার বন্ধ করে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন
###
ধেত্তেরি, পথের উপর থাকা স্পীডব্রেকারটি বেলি বুঝতেই পারলো না এক মৃদু ঝাঁকুনি খেল গাড়িটির সাথে বেলি এবং তার শ্বশুর বেলি বিড়বিড় করে বলল - ‘স্পীডব্রেকারে সাদা কালো দাগ না থাকলে কী করে ধরতে পারি দূর থেকে ?’
গাড়ি এগিয়ে যেতে থাকল হ্যাঁ, জীবনের পথে থাকা স্পীডব্রেকারগুলিও বোধহয় সে ধরতে পারল না ধাক্কা খেতে খেতে শুধু গাড়ি চালিয়েই গেল বেলি শাশুড়িকে দেখেনি ওদের বিয়ের এক বছর আগে শাশুড়ি ক্যান্সার রোগে মারা গিয়েছিলেন শাশুড়ি থাকা-নাথাকা কথাটি বেলিকে এত করে ভাবায়নি সে শুধু ভেবেছিল - শ্বশুরও না থাকলে ভালো হতো কী ক্ষতি হতো ? ছিঃ, এত নীচ কথাগুলো তার মনে কোন পথে এসে বাসা বেঁধেছিল ? শ্বশুরকে গুরুত্ব না দিলেও শ্বশুরের উপস্থিতি তার স্বাধীনতায় কিছু বাধা হবে বলে ভেবেই বোধহয় একটির পর একটি আঘাত দিয়ে যেতে কুণ্ঠিত হয়নি সামান্য অজুহাতেই ঘরে পার্টি চীয়ার করা, রেস্তোরাঁয় যাওয়া, ফাংশন দেখা, বাইরে ঘোরাঘুরি করা, ওহ্ এটাই তার ফেলে আসা জীবনের অংশ ভোগাসক্ত সেই বন্ধুমহলে ইচ্ছাকৃতভাবে শ্বশুরকে শুনিয়ে বলত -
- জানো ? পশ্চিমি দেশেই ভালো বুড়ো হলো, ব্যস্বৃদ্ধাবাস আমাদের এখানে জ্বর ছাড়লেও কাঁপ ছাড়ে না এই বুড়োটি মাস্টারি চাকরি করে জীবনে কিছুই করতে পারলো না, অথচ এখন ছেলের উপার্জনে অনাথ আশ্রমে দান করতে যায় কী যে আপদ না ?
হো হো করে সবাই হেসে উঠেছিল শুনেও না শোনার ভান ধরে শ্বশুরমশাই কোঠায় আপন মনে ঢুকে থাকেন বই পড়েন লিখেন এসব কথা যেন তাঁকে কোনোভাবে আক্রান্ত না করে, এমনভাবে তিনি স্বাভাবিক হয়ে থাকেন
সময়ও সর্বদা সমান যায় না কখনো সময় জীবনকে গভীর আঘাতে বহু কথা শিখিয়ে যায় হ্যাঁ, বেলিকেও শিখিয়েছিল সময়, যেদিন সিবিআই-এর অনুসন্ধানে তার পতি নিশান্ত চলিহাও অভিযুক্ত হয়েছিল নির্ধারিত বেতন, সুযোগসুবিধায় কর্মরত একজন সরকারি আধিকারিক কী করে বিশাল সম্পত্তি করতে পারে ? কী করে লাখ লাখ টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালান্স থাকতে পারে ? প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে নিশান্তের ফটো সহ অবৈধ ধন সম্পত্তির হিসাব নিশান্তকে পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়া দৃশ্য তাকে নিথর করে ফেলেছিল সেদিনই লজ্জা-অপমানে ম্রিয়মান বেলির অহঙ্কারের পাহাড় ঝরঝর করে খসতে শুরু হয়েছিল অনবরত বেষ্টন করে থাকা তার তথাকথিত বন্ধু-বান্ধবীরাও যেন বেলির সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলতে চাইছিল না শ্বশুর নির্লিপ্ত সন্ধ্যায় সদাই গীতা পাঠে নিমগ্ন থাকেন প্রাতঃভ্রমণ করেন নিশান্ত চলিহার অবৈধ টাকা, অবৈধ সম্পত্তি সম্পর্কীয় খবরবার্তা প্রচার, সম্প্রচারের ঢেউ না ফুরাতেই হঠাৎ সেদিন খবর বেরোল - সাহিত্য জগতে রাখা অনন্য অবদানের জন্য বিশিষ্ট লেখক, বিশিষ্ট সমাজকর্মী সুশান্ত চলিহাকে সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করা হয়েছে একদিকে বেলির পতি নিশান্ত চলিহার অপকর্মের প্রচার, অন্যদিকে সব সময় সাধারণ বেশে থাকা অসাধারণ কাজ করে রাজ্যে গৌরব বয়ে আনা সুশান্ত চলিহার কর্মরাজির সপ্রশংস সম্প্রচার ঘরে অগণন মানুষের স্রোত বেলির উপস্থিতি এখানে নগণ্য হয়ে পড়েছে এই মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই তাকে চেনে না, যতক্ষণ না শ্বশুর তাঁর পুত্রবধূ বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন না বেলির মনে পড়েছিল - গর্বে ফুলে থাকা কচ্ছপটির কথা বকের কৃপায় আকাশে উড়তে পেরে কচ্ছপ তার নিজের স্থিতি ভুলে গিয়েছিল অহঙ্কারে ফুলে সে একটি কাঠিতে কামড় মেরে বকের সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল হঠাৎ মুখ খুললেই যে সে ধপ করে মাটিতে পড়ে যেতে পারে, সেই দুর্দশার কথা তার মনে আসেনি উড়তে পেয়ে অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে পড়া কচ্ছপ যেমন করে মুখ খুলে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, তার শ্বশুরের সততা, নিষ্ঠা, কর্মরাজিকে তাচ্ছিল্য করেছিলউলঙ্গ ফকিরবলে অথচ আজ ? সেই শ্বশুরের সেই সততা, শিক্ষা তাকে ধরাশায়ী করে দিল তখন, যখন সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মানটি নিতে সুশান্ত চলিহাকে সম্মান জানিয়ে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে শ্বশুরমশাই মানপত্র, পুরস্কার, টাকার চেকটি ধরে আবেগে চোখের জল মুছে বলেছিলেন - ‘এই সম্মানের আসল অধিকারী আমার পুত্রবধূ - বেলি চলিহা বেলি, এসো তো, এসো আমার সাথে হাত পেতে ধরো এই সম্মান আমার কন্যাসম বেলির উপস্থিতি, সাহচর্যে আমি আমার কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা পেয়ে যাচ্ছিলাম সঙ্গে ……
কিছু সময় নীরবতা ঠিক সেই সময়ে দর্শকের আসনে বসে থাকা বেলির বুকে চলছিল অনুশোচনার ঝড় বেলির লজ্জা লাগছিল কী বলছেন শ্বশুরমশাই ? এ কেমন পন্থা ? অহঙ্কারীর অহঙ্কার নিমেষে দুএকটি শব্দে এভাবে উৎখাত করে দিতে পারা যায় কি ? সে সেই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিল শ্বশুরমশাই কেন এত লোকের শ্রদ্ধা, সম্মান পেয়ে আসছেন অমানুষকে মানুষ করতে পারা সম্মোহনী অস্ত্র তাঁর বিরল মমত্ববোধে নিহিত আছে শ্বশুরমশাই সেই মঞ্চে আবার একবার বেলিকে চমকে দিয়ে বলে উঠেছিলেন -
- এই মঞ্চেই আমি ঘোষণা করছি, আজ আমাকে পুরস্কার হিসাবে দেওয়া এই এক লাখ টাকার চেকটি অনাথ আশ্রমের জন্য অনুদান হিসাবে দিলাম
রাশি রাশি হাততালি শ্বশুরমশাইকে ঘিরে ধরেছিল বহু গুণমুগ্ধ, বহু সাংবাদিক সাংবাদিক গুণমুগ্ধের ভিড়ে বেলি শ্বশুরমশাইকে গাড়িতে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য যেতেই পারছিল না অথচ ওরা শ্বশুরমশাই-এর একদিনে লাভ করা গুণমুগ্ধ লোক নয় বাইরে সবাই জানে সমাজকর্মী, সাহিত্যিক সুশান্ত চলিহাকে একমাত্র পুত্র নিশান্ত ও পুত্রবধূ বেলিই জানে না সেই সুশান্ত চলিহা যে তার শ্বশুর সুশান্ত চলিহা প্রায়শ্চিত্তের আগুনে বেলির হৃদয় পুড়ে ছাই হতে ধরেছে কী পেল সে জীবনে ? ধন-দৌলত, প্রতিপত্তিয়ে এনে দেওয়া বন্ধু-বান্ধবী, পার্টি, আড্ডা - এসবের প্রতি তার ঘৃণা জন্মাচ্ছে এই মুহূর্তে তার কঠোর উক্তিকে অগ্রাহ্য করে নীরবে নিরালায় করে যাওয়া শ্বশুরের কর্ম, তাকে শিখিয়েছে আসল জীবনবোধ হ্যাঁ, আসল জীবনবোধ
- বেলি, আশ্রম পেয়ে গেছি গাড়ি এখানেই রাখো এইটুকু পথ আমি হেঁটে যাব তুমি গাড়িতে বসে থাকো
- শ্বশুরমশাই-এর সস্নেহ কথায়ই বেলি পথের ডানদিকে থাকা আশ্রমটি দেখল কোনদিনই তার এদিকে আসতে হয়নি আশ্রমটির সামনে এক শৃঙ্খলিত ফুলবাগান একটি বাঁশের গেট গেটের উপরে দুই হাত চওড়া মাঁচার মতো করে দেওয়া আছে সেখানে ফুটে আছে লাল, সাদা বোগেনভেলীয়া
- বাবা, আমিও যাব আপনার সঙ্গে
কথাটি মনেই রইল কিছু একটা আফসোসে শ্বশুরমশাইকে মুখ ফুটে বলতে পারল না কিন্তু শ্বশুরের সঙ্গে সঙ্গে বেলি যেতে থাকল শ্বশুরমশাই বেলির দিকে তাকালেন বাৎসল্য রসে সিক্ত একটি হাসি তাঁর ঠোঁটে ঢেউ খেলে গেল এত পরিতৃপ্ত এই মুখটি এমন প্রশান্ত বেলি যেন প্রথমবারের মতো শ্বশুরের মুখটি প্রত্যক্ষ করল শ্বশুরকে যেন আজ উজাড় করে দেবে তার সমস্ত শ্রদ্ধাভক্তি ঘরের বাইরে শ্বশুরমশাই নিঃসঙ্গ নন এত দিন ঘরের ভিতরে পলে পলে পেয়ে আসা একাকীত্ব, যে কথা শ্বশুরমশাই কখনো ব্যক্ত করেননি, সেই একাকীত্বের জায়গায় বেলি মানসিক সাহচর্যে শ্বশুরের মনপ্রাণ ভরিয়ে রাখবে বেলির বুঝতে বাকি থাকল না মুখে যে পুত্রবধূর গুণাগুণ শ্বশুরমশাই ব্যক্ত করেছিলেন, তা তাঁর কল্পনায় দেখতে থাকা পুত্রবধূ কিন্তু শতাধিক লোককে বেলি সম্বন্ধে যে অভিব্যক্তিতে ধারণা দিলেন, তেমন পুত্রবধূ সত্যিকার রূপে হতে বেলি মনে মনে সংকল্প নিল হঠাৎ বেলি সব সংকোচ দূরে সরিয়ে শ্বশুরের হাতটি ধরে নিল
- বাবা দেখবেন, স্টেপকটি বড় উঁচু আমার কাঁধে ভর দিন তো
শ্বশুর আবার একবার বিমুগ্ধ নেত্রে বেলির দিকে তাকিয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন বেলি হাসলো ছোট থাকতে বাবার হাত ধরে এটা দেখা, ওটা দেখা, ওটি কী এভাবে প্রশ্ন করে করে উৎফুল্লিত হওয়া বেলি আজ প্রথম বারের জন্য শ্বশুরের হাতখানিতে তার মৃত পিতার হাতের স্পর্শ যেন অনুভব করল আশ্রমটির চারপাশে বেলি একবার চোখ বুলালো
- বাবা, দেখুন তো বোগেনভেলীয়া গাছটিতে কত সুন্দর ফুল ফুটেছে
অপ্রত্যাশিত অচেনা আনন্দে বেলির মুখ দিয়ে মনে ভাবা কথাটি বেরিয়ে এল শ্বশুরমশাই সপ্রশংস ভঙ্গিতে বললেন - ‘হ্যাঁ, বড় জমকালো হয়ে ফুটেছে              

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়