Skip to main content

‘কাব্যশ্রী’ - কবিতার হাত ধরে কবিতা উৎসব


এ এক সত্যিকারের কবিতা উৎসব বইকী। দুই মলাটের ভেতর ৪৫ পৃষ্ঠায় যেখানে পাশাপাশি আপন আপন বৈভবে জ্বলজ্বল করছে ৫৭ জন কবির ৫৭ টি কবিতা - যার মধ্যে অধিকাংশ কবিই ডাকসাইটে, প্রথিতযশা। কী করে এতজন প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতা সংগ্রহ করে সন্নিবিষ্ট করা যায় দুই মলাটের অন্দরে সে এক ভাবনার বিষয় বটে। আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এখানে গ্রন্থিত হয়েছে দূরান্তেরও কিছু কবির কবিতা। কবিদের তালিকায় চোখ বোলালেই দুই সম্পাদকের এলেমের তারিফ করতে হয়; যদিও নিজেরা প্রতিষ্ঠিত কবি হওয়ার সূত্রে তাঁদের এই এলেম থাকাটাস্বাভাবিক।
কথা হচ্ছে বরাক উপত্যকার বদরপুর থেকে প্রকাশিত - সদ্য পেরিয়ে আসা বিশ্ব কবিতা দিবসের সন্ধ্যায় উন্মোচিত হওয়া ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কাব্যশ্রী’ নিয়ে। আলোচ্য সংখ্যাটি পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যা। একটি আদ্যন্ত কবিতাময়তা এই পত্রিকার ঘরে-বাইরে। নামলিপির ক্যাপশনে লিখা আছে - ‘কবিতার হাত ধরে’ - অর্থাৎ কবিতার হাত ধরে কাব্যশ্রী। পত্রিকার নামকরণের পেছনে এক গৌরবের ইতিহাস - একাধারে মন খারাপেরও। বরাক তথা সামগ্রিকভাবে কবিতা বিশ্বে কাব্যশ্রী বক্‌সী ভট্টাচার্য এক বহুচর্চিত নাম। বহির্বরাকে তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়েছিল কাব্যগুণের সূত্রে, নিজস্ব গতিময়তায়। সেই গতিই অকালে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর হালটি ধরেছেন তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা বর্ণশ্রী বক্‌সী এবং জামাতা রাজীব ঘোষ। তাঁদের যৌথ প্রয়াস ও সম্পাদনায় স্বর্গগত মায়ের নামাঙ্কিত ‘কাব্যশ্রী’ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ত্রৈমাসিক হিসেবে।
পত্রিকার অন্দরমহলে মণি মাণিক্য এতটাই সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে যে বহিরঙ্গে অযথা সময় কিংবা শ্রমকে ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। এমনকি সূচিপত্রও নেই। পাঠকের কাছে এর কোন চাহিদাও নেই। সরাসরি কবিতার কর্ষিত ক্ষেত্রে চষে বেড়ানোটাই যেখানে মুখ্য। এবং এই পঠনযাত্রায় পাঠক যে এক কাব্যময় বৈচিত্রে পাড়ি দেবেন তা বলাই বাহুল্য। প্রায় তিন কুড়ি কবির বিচিত্র কাব্যসম্ভারে সেজে উঠেছে এবারের সংখ্যা।
প্রথম পৃষ্ঠার সম্পাদকীয়তে বিশ্বকবির কবিতার সুরে সুরে কিছু কাব্যিক কথা - ‘মধু ঋতুর রঙিন আবহে আবারও ফিরে আসা, ফিরে আসা কবিতার হাত ধরে কাব্যমণির অনুরাগ বাসরে। জীবনের খরস্রোতে হারিয়ে যায় কত কিছু, শুধু নির্দিষ্ট মুহূর্তেরা বন্দি থাকে হাতের তালুতে। ...... কবিতার হাত ধরে আমরা জেগে উঠি, বেঁচে উঠি নতুন প্রভাতের ভৈরবী রাগিণীতে।’ ......
প্রতিটি কবিতা পড়লেই মনে হয় যেন কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ছি। কাব্যিক আবেশ প্রতিটি কবিতায়ই ভরপুর। তবু কিছু কবির কবিতা অন্তরকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় প্রবল ভাবে। বিশেষোল্লেখে যাঁদের কবিতা জায়গা করে নেয় অনায়াসে তার মধ্যে আছে - রাজীব ঘোষ, বর্ণশ্রী বকসী, সুশান্ত ভট্টাচার্য, মনোনীতা চক্রবর্তী, তীর্থঙ্কর মৈত্র, চন্দ্রিমা দত্ত, সুদীপ্ত মাজি, শকুন্তলা সান্যাল, রামকৃষ্ণ মহাপাত্র, জয়শ্রী ভট্টাচার্য, মমতা চক্রবর্তী, হিন্দোল ভট্টাচার্য, শঙ্খশুভ্র পাত্র, আদিমা মজুমদার, শর্মিলী দেব কানুনগো, বিদিশা সরকার, চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, মাহমুদ নোমান, চিরশ্রী দেবনাথ, রূপরাজ ভট্টাচার্য, সুপ্রদীপ দত্তরায় এবং কৃষ্ণা বসু।
বসন্তের অমোঘ প্রেমময় কিছু পংক্তি থেকে শুরু করে জীবনবোধ, কঠোর বাস্তব, প্রকৃতি, বর্ষা - সবকথার অনবদ্য সব কোলাজ কবিদের কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে আপন ছন্দে -
পারমিতা, এসো হায়দরাবাদে
তোমাকে ভালোবাসবো আবার
নতুন করে এই বসন্তে ......
পারমিতা, তোমাকে নিয়ে রামোজি ফিল্ম সিটিতে যাবো
তোমাকে নিয়ে গোলকুণ্ডা ফোর্টে যাবো
তোমাকে নিয়ে হুসেন সাগরে যাবো ...
পারমিতা, এসো হায়দরাবাদে
এই রাঙা বসন্তে
আমি অপেক্ষা করছি তোমার ...।
(কবিতা - পারমিতা এসো হায়দরাবাদে - সুশান্ত ভট্টাচার্য),
কিংবা -
যেমন করে বৃষ্টি নামায় শঙ্কা বিহীন মেঘ আকাশে
ছন্দ বাজায় গোত্র ছাড়া ‘মুষলধারী-জল’ নামা সে
তেমন করে শাঁখের ফুঁয়ে ঈশান কোণে বজ্র হানে
শব্দ-শরে আসর জমায় ধূপছায়া গাছ অভিমানে ......।
(কবিতা - বৃষ্টি নামে ভর দুপুরে - চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়)।
এছাড়াও আরো যাঁরা চমৎকার সব কবিতায় ধরে রেখেছেন সময় তাঁরা হলেন - তৈমুর খান, সুমিতাভ ঘোষাল, পার্বতী রায়, নরেশ মন্ডল, দেবাশীষ গুহ ঠাকুরতা, উমা মন্ডল, সঞ্জয় ঋষি, শৌভিক দত্ত, রঞ্জনা ভট্টাচার্য, সুধাংশুরঞ্জন সাহা, অমিত কাশ্যপ, রঞ্জিতা দত্ত, বীথি চট্টোপাধ্যায়, তমোজিৎ সাহা, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মল ভট্টাচার্য, শিখা রায়, অমৃতা খেটো, স্বাগতা সানি ঘোষ, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, আশিস মিশ্র, রাজীব ভট্টাচার্য, শিপ্রা পাল (লাভলী), পীযূষ বাগচি, শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, মন্দিরা ঘোষ, সুজিৎ দাস, পলাশ গঙ্গোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা রায়, হরপ্রসাদ কর্মকার, পারমিতা দাস, পীযূষ রাউত, ঋত্বিক ত্রিপাঠী, দুর্গাদাস মিদ্যা ও তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়।
প্রথম প্রচ্ছদের ছবির সৌজন্যে সুতপা দে। শেষ প্রচ্ছদে আছে একটি গ্রন্থ আলোচনা। সব মিলিয়ে ‘কাব্যশ্রী’তে কাব্য এবং শ্রী-যুক্ত কাব্যের ভরপুর সমাহার। সম্পাদকদ্বয়ের অক্লান্ত প্রয়াস ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ের এক সুচিন্তিত প্রকাশ। সমকালিক উৎকৃষ্ট কবিতার এক সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘কাব্যশ্রী’
সম্পাদক - বর্ণশ্রী বক্‌সী ও রাজীব ঘোষ
মূল্য - ৩০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৭৬১৯৩৩৬৬১, ৯৯৫৪৯২৯৩২১

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়