Skip to main content

আশুতোষ দাস-এর পূর্ণস্বাদের উপন্যাস - ‘মালিনী বিলের আখ্যান’


আখ্যান অর্থে আমরা পাই কাহিনি, ইতিহাস অর্থাৎ ইতিহাস অবলম্বনে লিখা কাহিনি কাহিনি বা গল্পে লেখক তাঁর কল্পনায় রচে চলেন রচনার বিষয়বস্তু অবাধ তাঁর বিচরণ পাঠক বা অন্য কারো কাছে তাঁর কোন দায়বদ্ধতা নেই অন্যদিকে ইতিহাস ভিন্ন ধারার বিষয়বস্তু এখানে কারো হাত দেওয়ার অধিকার নেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ সত্য ঘটনার বয়ান মাত্র যদিও কোন কোন ইতিহাসবিদ নিজ বা গোষ্ঠীগত স্বার্থপূরণে মিথ্যাকেই ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়ার মতো নিন্দ্যনীয় প্রয়াস সময়ে সময়ে করে থাকেন বলে প্রমাণিত হয় কিন্তু তা নিতান্তই বিচ্ছিন্ন এবং গর্হিত বলে বিবেচিত হয় কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার অবলম্বনে কালজয়ী কাহিনি কিংবা উপন্যাস অর্থাৎ আখ্যানের সৃষ্টি হয়ে চলেছে কালাবধি ইতিহাসকে অক্ষত রেখে কাহিনির বিন্যাস নিতান্তই সহজ কাজ নয়। ইতিহাসের রক্তমাংসের চরিত্রকে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় স্থাপন করা তথা আবহ সৃষ্টি করাই এই পর্যায়ের ঔপন্যাসিকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উদাহরণ স্বরূপ ‘বউঠাকুরাণীর হাট’, ‘রাজর্ষি’, ‘রাজসিংহ’ ইত্যাদি সহ অদ্যাবধি অসংখ্য বাংলা উপন্যাসের পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় একের পর এক ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস কিংবা আখ্যান সৃষ্টি হয়ে চলেছে নিয়ত। বস্তুত একে এক গবেষণাধর্মী কল্পসাহিত্য হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়।
এ অঞ্চলের, বিশেষ করে বরাক উপত্যকার উপন্যাসের চালচিত্র অনুসন্ধান করলেও ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত কিছু উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। বরাকের প্রথম মৌলিক সামাজিক উপন্যাস বলে চর্চিত ‘নারীশক্তি বা অশ্রুমালিনী’তেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক উল্লেখ বিদ্যমান। হারাণচন্দ্র রাহার ‘রণচণ্ডী’ উপন্যাসের পটভূমি হেড়ম্ব রাজ্য। কুলদেবী রণচণ্ডীর উদ্ভব সম্পর্কিত একটি ভিন্ন স্বাদের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসে। মোগলের সঙ্গে সংগ্রামে রাজা উপেন্দ্রনারায়ণ নিহত হলে যুবরাজ শত্রুদমন কীভাবে হৃতরাজ্য উদ্ধার করলেন সেই কাহিনি। এখানে তীর্থস্থান সিদ্ধেশ্বর ও ভুবন পাহাড়, তার দুর্গম পাহাড়ি পথ, বনবাসী কুকিদের সামাজিক রীতিনীতিরও আছে বর্ণনা। এরপর লাবণ্যকুমার চক্রবর্তীর ‘মহারাণী ইন্দুপ্রভা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রও ছিলেন মণিপুর রাজকন্যা হেড়ম্বমিহিষী ইন্দুপ্রভা। প্রেক্ষাপট খাসপুর। পরবর্তী বিভিন্ন উপন্যাসেও সামাজিক চিত্রপটের পাশাপাশি কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও উঠে এসেছে একাধিক ঔপন্যাসিকের লেখায়। এই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন কবি, সাহিত্যিক, চিত্রনাট্যকার আশুতোষ দাস-এর উপন্যাস ‘মালিনী বিলের আখ্যান’।
মোট ১৬৮ পৃষ্ঠার একটি অসাধারণ উপন্যাস - যেখানে কাহিনি, ইতিহাস এবং কথকতা একসাথে চলে পাশাপাশি। উপন্যাসে রাজনীতি থেকে শুরু করে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রেম ভালোবাসা সব কিছু এসেছে পালাক্রমে। এই উপন্যাসের পটভূমিও সেই হেড়ম্ব রাজ্য। কুলদেবী রণচণ্ডী, বালক রাজা সুরদর্প নারায়ণ, রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা দেবী এবং কবি-পুরোহিত ভুবনেশ্বর বাচস্পতির সমান্তরাল ভাবে বরবক্র বা বরাক নদীর প্রসঙ্গ এসেছে বার বার। নদীর বুকে যেন লেখা থাকে ইতিহাসের গল্পগাথা। মনে করিয়ে দেয় অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস...’কে।
আলোচ্য উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায় অসামান্য এক বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ঔপন্যাসিক আশুতোষ দাস - ‘...... বরবক্র নদী যেন বলছে কোনও ভেদভাব রণচণ্ডী দেবী পছন্দ করেন না। ... দেবী সবার। সবার ঘরে তিনি খুশি ছড়িয়ে দিতে চান... আজও মালিনী বিলের হাওয়ায় কান পাতলে সেই কথা বুঝি শোনা যায়। ভালোবাসায় কোনও জাত নেই, বর্ণ নেই।’ - নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে এসে শেষটায় যেন এক অনাবিল মোহাবেশ ছড়িয়ে পড়ে পাঠক হৃদয়ে। 
রাজমাতা চন্দ্রপ্রভা দেবীর সময়কার বিভিন্ন ঘটনাবলি নিয়ে একের পর এক শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনারাজির নিপুণ বর্ণনায় চূড়ান্ত রকমের পঠনস্পৃহা জেগে ওঠে পাঠক মনেএকটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে, নির্দিষ্ট সময়ে সব ঘটনা একের পর এক যথাসময়ে ফিরে এসেছে অনবদ্য বুনোটে। কোথাও খেই হারায়নি উপন্যাসে। পার্শবর্তী রাজ্য ত্রিপুরের মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের কাছাড় ভ্রমণ এবং বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার চমৎকার ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায় উপন্যাসে। দেবী রণচণ্ডী সম্পর্কিত অলৌকিক কিছু ঘটনা, ভুবনেশ্বর বাচস্পতি কৃত অনুবাদ গ্রন্থ ‘নারদি রসামৃত’ গ্রন্থ এবং সেখান থেকে বিভিন্ন প্রসঙ্গে পৃষ্ঠাসংখ্যা সহ উদ্ধৃতির উল্লেখ, বাঁশকান্দি অঞ্চলে কবিরাজ খন্ডলের বসতি স্থাপন, ভুবন পাহাড়ের বর্ণনা, বিদ্রোহীদের উত্থান, রাজপরিবারের অন্দরমহলের কর্মকাণ্ড, রাজকার্য পরিচালনার বর্ণনা এবং সমসাময়িক ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
এত সব ঘটনার পাশাপাশি পণ্ডিত ভুবনেশ্বর বাচস্পতির স্নেহধন্য তথা রণচণ্ডী দেবীর মন্দিরের সেবায়েত সুরেশ্বর এবং তথাকথিত অন্ত্যজাত শ্রেণির মালিনীর নীরব প্রেমের কাহিনি এবং তার পরিণামকে কেন্দ্র করেই গোটা উপন্যাসটি এগিয়েছে তরতর করে। প্রতিটি ঘটনার সপক্ষে উপযুক্ত ঐতিহাসিক উল্লেখ এই উপন্যাসের বিশেষত্ব। বিভিন্ন সহায়ক গ্রন্থ থেকে পৃষ্ঠাসংখ্যা সহ এর উল্লেখ পড়লে মনে হবে যেন এক নিছক সত্য কাহিনিইতিহাসের পাতা থেকে সত্য কাহিনিকেই তুলে এনে সবিস্তারে তাকে এক সূত্রে গেঁথে রাখার এই প্রয়াস তাই একশোভাগ সফল। চমকপ্রদ সব ঘটনা এবং পাশাপাশি প্রেক্ষাপটের যাথার্থ্য উপন্যাসটিকে করে তুলেছে সার্থক।
এত বিশাল এক কর্মকাণ্ডে, গোটা উপন্যাসে বানান ভুল প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু বেশ কয়েকটি জায়গায় ‘আধিভৌতিক’ শব্দটি ‘আদি ভৌতিক’ হয়ে গেছে। এর বাইরে কোথাও কোনো বিচ্যুতি নেই। এটিও এই উপন্যাসের এক সম্পদ। ঝকঝকে ছাপাই, রাজর্ষি দাসের প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ এবং যথাযথ বর্ণ ও অক্ষরবিন্যাসে বিন্যস্ত এই উপন্যাসটির প্রকাশক শিলচরের নতুন দিগন্ত প্রকাশনী। উপন্যাসকার এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর পরিজনদের। কবি-সম্পাদক-প্রকাশক মিতা দাসপুরকায়স্থ গ্রন্থটির চমৎকার একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। প্রাককথনে ঔপন্যাসিক আশুতোষ দাস গোটা উপন্যাসের মূল থীমটিকেই তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে যাবতীয় তথ্যাদি সহ।
সব মিলিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস অবশ্যই এবং কাহিনির সুখপাঠ্যতা এবং ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে উৎসাহী পাঠকের কাছে এক অতি মূল্যবান গ্রন্থ হয়েই পরিচিত হয়ে থাকবে - ‘মালিনী বিলের আখ্যান’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘মালিনী বিলের আখ্যান’
আশুতোষ দাস
মূল্য - ৩০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৭০৬৩০৭৩৫২

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...