Skip to main content

তুষারকান্তি সাহার সুখপাঠ্য উপন্যাস - ‘জীবনের আশেপাশে’


জীবনের আশেপাশে, জীবনের চতুঃসীমানায় গড়ে ওঠে - এগিয়ে চলে আরোও বহু জীবন। চলতে চলতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জুড়ে একত্রিত হয়ে পড়ে এমনি একাধিক জীবনও। বিচিত্র তার পরিসীমা, বিচিত্র তার এগিয়ে চলা। সব কথা লিখা থাকে না মহাকালের খাতায়, সব জীবন সমক্ষে আসে না। অথচ প্রতিটি জীবনের অন্দরমহলে লুকিয়ে থাকে এক একটি স্বতন্ত্র জীবনবোধ, এক একটি কথামালার পাহাড়। মানব ইতিহাসে এই বোধ নামক অনুভূতিটি আছে বলেই মানুষ জীবশ্রেষ্ঠ। অনুভবে, অনুভূতিতে দীর্ঘ জীবনের এই চলার পথ আপন আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। প্রতিটি জীবনেই তাই লুকিয়ে থাকে বলার মতো কথা, লিপিবদ্ধ হয়ে থাকার মতো কথামালা, কাহিনি। প্রতিটি জীবনই আদতে এক একটি উপন্যাস।
কবি, সাহিত্যিক তুষারকান্তি সাহা বাংলা ও উত্তর পূর্বের এক অতি পরিচিত মুখ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা দীর্ঘ হলেও উপন্যাস সম্ভবত এটাই একমাত্র - যদিও পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারে এবং বিস্তৃতির বিচারেও একে ঠিক উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে কিনা তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। ‘জীবনের আশেপাশে’ গ্রন্থটি হয়ত উপন্যাসিকা হিসেবেই বিচার্য তবু যেহেতু লেখক নিজে এটিকে উপন্যাস বলে আখ্যায়িত করেছেন তাই আলোচনায় একে উপন্যাস হিসেবেই ধরে নেওয়া গেল।
৯২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে উপন্যাসের বিস্তার ৮৪ পৃষ্ঠা জুড়ে। ঘটনা পরিঘটনার পরিক্রমাকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে এলে একে এক সামাজিক উপন্যাস হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যায়। ‘প্রসঙ্গত’ শিরোনামে ভূমিকায় লেখক নিজেই লিখছেন - ‘সত্তর থেকে নব্বই - এই দুই দশকের সময়কালে কলকাতার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে জড়িয়ে এই উপন্যাসের গতি-প্রকৃতি।’ কাহিনির নায়ক অনুপম। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগেই বাবার মৃত্যুর পর সংসারের যাবতীয় দায় দায়িত্বের বোঝা বয়ে বয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এক মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান। মাত্র আট বছর বয়সে মা’কে হারিয়ে আগেই সহায়হীন হয়ে পড়া উচ্চমেধার অনুপম নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে বাজি রেখে ভাই বোন দু’টির জন্য প্রাণপাত করতে থাকে। ভাই ভবতোষকে ডাক্তারি পড়ানোর আদেশ করেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী বাবা। সেই লক্ষ্যে হাড়ভাঙা খাটুনি করে অনুপম নিজেকে তিলে তিলে অপ্রাসঙ্গিক করে জীবন খাতার পাতাগুলো উল্টে যেতে থাকে এক এক করে। এক সময় মেধাবী ভাইটি লক্ষ্যপ্রাপ্ত হয়ে নিজের আলাদা সংসার গড়ে তোলে। বোনকে পাত্রস্থ করে নিজের দিকে যখন ফিরে তাকানোর চেষ্টা করে কৃতী সাহিত্যিক অনুপম তখন অনুভব হয় - অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ভালোবাসার পাত্রী সাথী রায় নিজের সংসারের হাল টেনে টেনে আর অনুপমের জন্য অপেক্ষা করে করে নীরবে পেরিয়ে এসেছে জীবন পথের অনেকখানি দূরত্ব। শেষটায় কি এক হলো দু’টি হৃদয় ?
প্রতিটি ঘটনা প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই এগিয়েছে তরতরিয়ে। এখানেই তুষারকান্তির মুনশিয়ানা। একবার পড়া শুরু করে দিলে শেষ অবধি না পড়ে ফেলে রাখার উপায় নেই। যথাযথ বিন্যাসে একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ খুব শক্ত করে ধরে রাখতে সফল লেখক। কোথাও খেই হারানোর মতো ঘটনা ঘটেনি। কাহিনির চাহিদায় এক একটি মোড়ে এসেছে তখনকার রাজনৈতিক সমাজ ব্যাবস্থার কিছু উল্লেখ এবং বিশ্লেষণ। বিশেষ করে বাংলা তথা কোলকাতার বাম রাজনীতির যোগাত্মক ও বিয়োগাত্মক উভয় দিশার এক সঠিক মূল্যায়ন করেছেন লেখক অত্যন্ত সুনিপুণ ভাবে। এবং প্রতিটি বর্ণনা ঠিক ততটাই লিপিবদ্ধ হয়েছে যতটা পাঠকের মনস্তত্ত্বে সঠিক মাত্রার বলে মনে হয়। কোথাও খামতি নেই, বাহুল্যও নেই কোথাও। নেই কোনও জটিলতা। সহজ, সরল বাখানে এগিয়েছে কাহিনি। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে লেখক তুষারকান্তি একশো ভাগ সফল। তৎকালীন সময়কালকে যথার্থ রূপে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন লেখক যা একটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে আরেকটি অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব বলেই মানা হয়ে থাকে। গ্রন্থটির অধ্যায়বিন্যাস বিশেষোল্লেখের দাবি রাখে। বিশেষোল্লেখের দাবি রাখে প্রতিটি চরিত্রের যথাযথ উপস্থাপনও। এক একটি চরিত্র লেখকের নিপুণ নির্মাণকৌশলে হয়ে উঠেছে জীবন্ত। চরিত্রসমূহের ত্যাগ, শালীনতা, সংস্কৃতিমনষ্কতাও উপন্যাসের এক ব্যতিক্রমী সম্পদ। ঘটনাসমূহের অঙ্গ হিসেবে  কিছু টুকরো টুকরো ঘটনারাজি এসেছে কাহিনির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেগুলো উপন্যাসটিকে করেছে রসসিক্ত এবং উপন্যাসের বুনোটকে করেছে পোক্ত। অর্থাৎ একটি উপন্যাসের প্রতিটি উপাদানই জ্বলন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে এখানে।
আরোও খানিকটা বিস্তৃতি লাভ করতে পারত অনায়াসে। এবং তাহলে পৃষ্ঠাসংখ্যার নিরিখেও এটি এক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হয়ে উঠত নিঃসন্দেহে। স্পষ্ট ছাপাই ও বাঁধাইয়ে, বিন্যস্ত শব্দ ও বাক্য বিন্যাসে, নির্ভুল বানানে, কমল ঘোষের প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদে ‘জীবনের আশেপাশে’ এক সুখপাঠ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘মানিক দাস ও তাপসী দাস’কে। অক্ষর বিন্যাস - সুলতা বাগচী, মুদ্রক - সিটি অফসেট, গুয়াহাটি।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘জীবনের আশেপাশে’
তুষারকান্তি সাহা
মূল্য - ১৩০ টাকা, যোগাযোগ - ৯৮৬৪০৬৬৯৯৪

Comments

  1. ভালো লেগেছে পড়ে বইটা এবং এই আলোচনাটিও

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়