Skip to main content

বিপাশা থেকে গঙ্গা - এক বর্ণিল স্বপ্নসফর




কবিগুরুর ভাষায় - ‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি
কবিগুরুর মতোই আমরা বাঙালিরা - এবং বোধ করি আপামর বিশ্বজনেরাও অন্তর থেকে সুদূরের পিয়াসি সবাই কিন্তু এইসুদূরশব্দটিই শুধু তারতম্য ঘটায় ব্যক্তিবিশেষে কারো সুদূর ঘরের কাছের ‘আরশিনগর’ তো কারো কাছে গোটা বিশ্বই আরশিনগর।  ইচ্ছে থাকলেও উপায় হয়ে ওঠে না সব সময়। আমরা অ্যাভারেজ বাঙালিদের কাছে এ দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ানোটাই যথেষ্ট। কয়েক বছর পর পরই বাই ওঠে বাইরে বেরনোর। ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’ তখন।
যৌবনে শঙ্কু মহারাজের বেশ ক’টি ভ্রমণ কাহিনি পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। তার মধ্যে যে গ্রন্থটি আমাকে সবচাইতে বেশি আকর্ষণ করেছিল সেটি ছিল ‘লীলাভূমি লাহুল’। লাহুল ও স্পিতি উপত্যকার নৈসর্গিক বৃত্তান্ত আমাকে অভিভূত করেছিল। সেই থেকে বলতে গেলে উন্মুখ হয়ে রয়েছিলাম একবার যাব বলে। কিন্তু ওই যে লিখেছি - উপায় আর হয়ে ওঠেনি এত কাল ধরে। ইতিমধ্যে ঘোরা হয়ে গেছে বহু বার - ‘অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’। কিন্তু হিমাচলের অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করার আর ফুরসৎ হয়ে ওঠেনি। এবার আবার যখন বাইরে যাওয়ার বাই উঠল তখন আর কালবিলম্ব না করে ইছেপূরণের ভ্রমণসারণি তৈরি করে ফেললাম। সস্ত্রীক সকন্যা আমি এবং চারজনের নিকটাত্মীয় আরেকটি পরিবার। সব মিলিয়ে সাত জন। চারজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং তিনটি সন্তান দল।
এ দেশে আপনি যেখানেই ঘুরতে যান সেখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে অবধারিত হয়ে আসবে কিছু মন্দির। সে আপনি যতই প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন না কেন। এছাড়াও আছে। ঘুরতে যাওয়ার ফাঁকে তীর্থ ভ্রমণের স্বাদ মিটিয়ে নিতে নারী জাতির যেন এক স্বভাবসিদ্ধ বাসনা। সুতরাং শিমলা মানালি যাওয়ার কথা উঠতেই বায়না এল - ফেরার পথে একদিনের জন্য হরিদ্বার যেতে হবে। অর্থাৎ ঢুঁ মেরে আসতে হবে উত্তরাখণ্ডেও। এমনিতেও দিল্লিতে একদিনের ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা ছিল। বিশেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপত্য বাচ্চাদের দেখানোর একটা নীতিগত তাগিদ তো ছিলই। তাই আরোও এক দিন যুক্ত হলো হরিদ্বারের জন্য। সব মিলিয়ে চারটি জায়গা। শিমলা এক দিন, মানালি দু’দিন, দিল্লি এক দিন এবং হরিদ্বার এক দিন। এতেই ঘুরে আসতে লাগবে দশ দিন। যাই হোক একটি ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্যাকেজ ট্যুরে বেরিয়ে পড়লাম এক সকালে গুয়াহাটি থেকে। হরিদ্বার ছিল প্যাকেজের বাইরে।
শারদীয় দুর্গাপুজার সপ্তমীর সকাল ছ’টায় আমাদের যাত্রা হল শুরু। সকাল ন’টায় ছিল গুয়াহাটি থেকে দিল্লির বিমান। সাত জনের টিকিট, তিনটে সিট জানালার ধারে। তিনটি বাচ্চা একসাথে এক দিকে বসল। বাকি আমরা চার জনের মধ্যে তিন জনেরই ইচ্ছে আমাকে একটি জানালার পাশের সিটে বসানোর। তাহলে নাকি আমি নামক মেশিনটি থেকে সকালের সংবাদপত্রের মতো বেরিয়ে আসবে কবিতা। কবিতার ব্যাপারটা বাদ দিলেও এতে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। আকাশের গায়ে মেঘের খেলা দেখার মতো নৈসর্গিক আর কী হতে পারে ? সুতরাং... অগত্যা... জাঁকিয়ে বসে তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। বিমান উপরে উঠতেই ঘোষণা ভেসে এল - এবার ইলেকট্রনিক উপকরণ ব্যবহার করা যাবে। আঙুল আমার নিশপিশ করছিল প্রথম থেকেই। তাই মোবাইল খুলে নোটপ্যাডে ...। নীচে মেঘের যেন বসতবাড়ি। কোথাও বৃষ্টি ঝরাচ্ছে তো কোথাও রোদের তীব্রতায় ফিরিয়ে নিচ্ছে জলকণা। সফরসঙ্গীদের নিরাশ করা উচিত হবে না, তাই ...... আকাশ কবিতা -
মেঘের দেশে কবিতারা সব
ঘুমোয় বারোমাস।
যখন পাহাড় ডাকে, নদী ডাকে আয় আয়
জেগে ওঠে তারা - আহ্বান রবে
বৃষ্টি হয়ে খুশি নিয়ে সাথে
ঢলে পড়ে সব জলদকবিতা যত
বলে দুঃখসুখের যাপন কথা
চলে গায়ে গায়ে ঢলাঢলি পথ চলা।
আকাশ কবিতা মাটির পৃথিবী জুড়ে
ছড়ায় মেঘের নিসৃত বারতা
শোনায় মেঘমুলুকের ঘুমঘোর ইতিকথা।
 
যখন মেঘ বলে আয় ফিরে ফিরে আয়
অসার যাপন দিন কবিতাহীন
কাটে না বেলা দিনভর ভেসে ভেসে
অলস আকাশে আকাশে,
রবির কিরণে উড়ে উড়ে দিনশেষে
কবিতারা যায় ফিরে
আপন আবাসে - মেঘের মান্দাসে।
দিল্লি বিমানবন্দরে যথাসময়ে নেমে লটবহর নিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় এক ঘণ্টা। বাইরে অপেক্ষায় ছিল কোম্পানির গাড়ি। এখান থেকেই আমাদের প্যাকেজ শুরু। দুপুর প্রায় একটা নাগাদ আমাদের সাত জনের বসার মতো ইনোভা গাড়ি শুরু করল তার শিমলা অভিমুখে যাত্রা। দিল্লির সীমানা ছাড়িয়ে মুরথলে রাস্তার পাশে বিশাল বিশাল সব ধাবার সারি। এখানেই সেরে নেওয়া হলো দুপুরের আহার। এরপর কারনালে গিয়ে আমাদের ড্রাইভার পরিবর্তন হয়ে গেল। গাড়িতে উঠে বসল সফরের মূল ড্রাইভার কাম গাইড - লাভলী সিং। গাড়ি যতটা না চালায় তার চাইতে বেশি চালায় মোবাইল। বুঝলাম বলে কোনো লাভ নেই। সেই থেকে শুরু এই জ্বালাতন। মোবাইলে কথা বলছে, গান চালাচ্ছে, গান পরিবর্তন করছে, অন্যান্য ট্যুরের ব্যাপারে অনবরত পরিকল্পনা করছে রাজ্যের যত লোকের সঙ্গে আর নিজের আরোও গাড়ির ড্রাইভারদের সঙ্গে। তবে ড্রাইভিংএ খুব দক্ষ, ভরসা করার মতো। এমনিতেও খোলামেলা, হাসিমুখ। দিল্লি হরিয়ানা পেরিয়ে চন্ডিগড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল পঞ্চকুলা হয়ে। অথচ কথা ছিল সপ্তমীর বিকেলে পুজো দেখব আমার বন্ধু কৌশিকের সঙ্গে চন্ডিগড়ে। কিন্তু ড্রাইভারের নানা সমস্যায় আর সেটা সম্ভব হলো না। দু’তরফেই  প্রচণ্ড নিরাশা। কী আর করা যাবে ? দীর্ঘ যাত্রা শেষে রাত প্রায় এগারোটায় গিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম শিমলা - হিমাচল প্রদেশের অন্যতম রাজধানী শহর। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল হোটেল উড ইন-এ। শহরের ভিড়বাট্টা থেকে খানিকটা দূরে প্রকৃতির কোলে ছবির মতো সাজানো হোটেল। রাতেও দেখে ভালো লেগে গেল। হোটেল বয়গুলো খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বেরিয়ে এসে জিনিসপত্র পৌঁছে দিল আমাদের নির্ধারিত রুমে। আগে থেকে ফোন করে রাতের খাবার রাখতে বলে দেওয়ায় আর কোনো সমস্যা হল না।
পরদিন শিমলা লোক্যাল ট্যুর সুতরাং সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই ঘন পাইনের ফাঁক দিয়ে সূর্যের প্রথম আলো এসে যেন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল আমাদের। অসাধারণ এক ল্যান্ডস্কেপ। ইচ্ছে করলে এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যায় দীর্ঘ সময়। কিন্তু সে তো আর হবার নয়। তাই হোটেলেই চা-জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রথম গন্তব্যকুফরির উদ্দেশে আমি আগেও শিমলা গেছি - এবং কুফরিও সেখানে ঘোড়ায় চড়ে উপরে ওঠার প্রাণান্তকর অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার তাই আগেভাগেই সেই বৃত্তান্ত সঙ্গীদের শুনিয়ে রাখায় কেউই আর সে সাহস করলেন না আমাদের ইনোভা গাড়ি চলল কুফরির উদ্দেশে - যেখান থেকে ঘোড়সওয়ারির শুরু এদিকে গতকাল থেকেই মনের মধ্যে পুজো দেখার আকুতি। চন্ডিগড়ে পুজো দেখার ইচ্ছে তো পূর্ণ হল না। দুর্গাপূজা চলছে অথচ কোথাও প্রতিমা দর্শন হবে না এটা যেন মন থেকে মেনে নিতে পারছি না কেউই ষোলো আনা খাঁটি বাঙালি মন কী করে এটা মেনে নিতে পারে ? কুফরি যাওয়ার পথে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি মুগ্ধ নয়নে, হঠাৎ চোখে পড়ল দুর্গা মন্দিরের সাইনবোর্ড সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে বলে রাখলাম ফেরার পথে ঠিক এখানে, এই মন্দিরে থামতে হবে সায় দিল লাভলি। এবার কুফরি পৌঁছে ঘোড়া-পয়েন্টে যেতেই দেখা গেল অসংখ্য ভ্রমণকারীর ভিড় সারি সারি ঘোড়া চলছে সওয়ারি নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতার জেরে আমি সওয়ারিদের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি আর খানিক ক্ষণ বাদেই এদের মুখ থেকে উবে যাবে সমস্ত হাসি আর জায়গা করে নেবে শংকা আর অসহায় প্রতিচ্ছবি। স্থানীয় ঘোড়া ব্যাপারীরা ঘিরে ধরল আমাদের আমরা যাব না বলে দিলাম তখন ওরা জানাল যে গাড়ি করেও সেখানে যাওয়া যায় - যেখানে, পাহাড়ের উপরে আছে নানা রকম বিনোদনের উপকরণ এটা আমি শুনেছিলাম আগেই। এ কথায় সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল সঙ্গে সঙ্গে একটা গাড়ি করে আমাদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিল লোকগুলো আমরা অন্য একটি গাড়ি করে চলে গেলাম যেখান থেকে উপরে উঠার খোলা জীপগাড়িগুলো ছাড়ে মিনিট পাঁচেকের চড়াই খোলা জীপের পিছনে দাঁড়িয়ে বেশ একটা এডভেঞ্চার হলো যেন প্রচণ্ড এবড়খেবড়ো সেই চড়াই। উপভোগ করলাম বলা চলে। উপরে ওঠে প্রথমেই গেলাম জিপ-লাইন পয়েন্টে যেখান থেকে গ্লাইডিং-এর ব্যবস্থা আছে একই পাহাড়ের খাদ পেরিয়ে এপার ওপার। সঙ্গে থাকা বাচ্চা দুটো সেই ট্রলি চড়ে পেরিয়ে গেল পাহাড়ের এক দিক থেকে আরেক দিকে রোমাঞ্চকর সে অভিজ্ঞতা আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিওতে ধরে রাখলাম তাদের সেই বিচিত্র যাত্রা। অপর বাচ্চাটি সাহস করতে পারল না আমার খুব ইচ্ছে করছিল সেটি চড়ার কিন্তু সহধর্মিণী আগে থেকেই মানা করে দিয়েছেন আমার স্বভাব তাঁর বিলক্ষণ জানা আছে, তাই আমিও এ বয়সে এসে আর তাঁর কথা অমান্য করার সাহস পেলাম না একটা আপশোশ থেকে গেল ওখান থেকে বেরিয়ে আপেল বাগান এক মনোরম দৃশ্য গাছে গাছে ঝুলে আছে টসটসে সব আপেল বাচ্চাগুলোর ছবি তোলার আর শেষই হচ্ছিল না সেখানেই বিক্রি হচ্ছে আপেল অত্যন্ত কম দামে সুতরাং আপেলভোজন হলো পেট ভরে অনেকটা সময় ব্যয় হলো সেখানে এবার ফেরার পথে সেই দুর্গা মন্দিরের সামনে এসে গাড়ি থামতেই হুড়মুড় করে নেমে এসে সোজা ছুট লাগালাম মন্দিরে দুর্গাপূজা দেখব বলে কিন্তু মন্দিরে গিয়ে দেখা গেল ওটা প্রতিষ্ঠিত দুর্গা মন্দির এবং প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহেই পূজা হয় দেবীর ভুবনমোহিনী রূপে সবাই আকৃষ্ট বরাভয়দায়িনীর সারা মুখ জুড়ে যেন মিষ্টি মধুর হাসির ছটা খানিক প্রসন্ন হল মন। বাইরে প্রসাদ বিতরণ চলছে উদ্যোক্তাদের আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে সবাই বসে পড়ল পাত পেড়ে আমার মনের মধ্যে সাবেকি দুর্গা কাঠাম দেখার আকুলতা মনকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারছি না মাকে প্রণাম করে প্রসাদ শেষে ফের উঠে বসলাম গাড়িতে ঘড়িতে তখন প্রায় দুটো বাজে ড্রাইভার বলছিল আরেকটি মনোরম জায়গায় নিয়ে যাবে কিন্তু আমাদের শরীর তখন সামান্য বিশ্রাম চাইছিল বিকেলে আবার যেতে হবে শিমলার বিখ্যাত ম্যাল- আমি জানতাম ম্যালের পাশেই রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন এবং কালীবাড়ি আমার বিশ্বাস সেখানে অবশ্যই দেখতে পাব কাঙ্ক্ষিত দুর্গামূর্তি সুতরাং অন্য কোথাও যাব না বলে ড্রাইভারকে বলা হলো হোটেলে নিয়ে যেতে ইতিমধ্যে অন্য একটি হোটেলে দুপুরের আহার সেরে নেওয়া হল দুপুরের বাকি সময়টা বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটেয় আবার বেরিয়ে পড়লাম ম্যালের উদ্দেশে
পরপর দুটি লিফট চড়ে উপরে উঠতে হয় বেশ জমপেশ ব্যাপার গোটা ম্যাল জুড়ে দোকানের সারি আকর্ষণীয় সব বিপণি ওদিকে গীর্জার পাশে ভিউ পয়েন্ট আমি আগেও এসেছি এখানে বন্ধুবর্গ সহযোগে। ভীষণ মনে পড়ছিল সেই সফরের কথা। সেই দলের একটি বন্ধু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। মনের মধ্যে এক বিষণ্ণতা এসে যেন দানা বাঁধছিল। এদিকে আসন্ন সন্ধ্যার মায়াবী আলোয় পর্যটকের ভিড়ে ঠাসা প্রশস্ত জায়গাটি তখন জমজমাট আমার মন পড়ে আছে দুর্গাপূজার টানে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সোজা হেঁটে যেতে থাকলাম কালীবাড়ির উদ্দেশে গলি মতো রাস্তা পেরিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ এখানে কোনো ধরণের যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ গলির দুই পাশে ফুটপাথ ধরে অজস্র পসরা আর আলোর রোশনাই সেসব পেরিয়ে কালীবাড়ির কাছাকাছি আসতেই কানে এল ঢাকের আওয়াজ আমার অন্তরাত্মা নেচে উঠল আনন্দে তাড়াতাড়ি পথ পেরিয়ে কালীবাড়ি চত্বরে পা রেখেই এক স্বর্গীয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল মন মন্দিরে কালীমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অজস্র মানুষ আরতি চলছে আরতি দেখে পাশেই দূর্গা মণ্ডপে মায়ের পূজা চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের মূর্তি সেই চিরাচরিত মূর্তি বালকবেলা থেকে আজ অবধি যে সনাতন রূপ দেখে এসেছি বরাবর। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে সার্থক করলাম চোখ - অন্তর প্রধান পুরোহিত (কিংবা মহারাজ হবেন হয়ত) - জিজ্ঞেস করলাম - এখানে কি একটাই পুজো ? বললেন - হ্যাঁ একটাই বহু কষ্টে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল তবে কি একদিন শিমলার একমাত্র দুর্গাপূজাও বন্ধ হয়ে যাবে ? অথচ হিন্দু দেবী শ্যামলার নাম থেকেই তো এই শহরের নাম হিমাচল প্রদেশের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিমাচলই সম্ভবত দেশের একমাত্র রাজ্য যার দুটি রাজধানী শীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ধরমশালাতে শীতে এখানে তাপমাত্রা প্রায় পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছে যায় এবং তুষারপাতও প্রত্যক্ষ করা যায় আমরা যেহেতু অক্টোবরে বেড়াতে গেছি তাই বরফ দেখা তো দূরের কথা কোথাও কোথাও গরমের অনুভব হয়েছে আমাদের অবশ্য রাতের সময় তাপমাত্রা অনেকটাই নীচে নেমে গিয়েছিল
যাই হোক প্রসাদ হাতে মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে গিন্নি ও বাকি সফরসঙ্গীরা সামান্য কিছু কেনাকাটা করলেন আমার এসবে কোনোদিনই আগ্রহ নেই তাই ঝলমলে পথের পাশের বেঞ্চে বসে উপভোগ করলাম এবারের মতো - এবং নিশ্চিতই শেষবারের মতো শিমলার মায়াবী রাতের দৃশ্যাবলি রাতে হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় নটা এসে পুরো টিমের রোজকার সান্ধ্য আড্ডা এবং রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত প্রায় একটা পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে সকাল ছটায় বেরোতে হবে মানালির উদ্দেশে। স্বপ্নের কুলু - মানালি।
###
টায় বেরনোর কথা থাকলেও এত ভোরে ওঠে সব কিছু সামলেসুমলে বেরোতে গিয়ে প্রায় আধঘণ্টাখানেক দেরি হলো তখনও ভোর কুয়াশার চাদরে আবৃত হয়েই মালপত্র সব তুলে দেওয়া হল ইনোভার ক্যারিয়ারে সবাই উঠে পড়লাম গাড়িতে শিমলা শহর ভেদ করে রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল কুলু-মানালির উদ্দেশে খুব শখ ছিল শিমলার পাহাড়ি পথে রেল ভ্রমণের। কিন্তু সম্ভব হল না। শঙ্কু মহারাজেরলীলাভূমি লাহুলআমার মনমন্দিরে জায়গা করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক চলার পর সকালের চা-জলখাবার খেতে কোনও এক অখ্যাত জায়গায় থামল গাড়ি রাস্তার এক পাশে দুটি ভোজনালয় অপর দিকে সুউচ্চ পাহাড় হিমাচলের পাহাড়গুলোর উচ্চতা বিশাল হিমালয়ের ভিন্ন ভিন্ন রেঞ্জের পাহাড়ের ভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় সহজেই ঘণ্টাখানেকের প্রাতঃরাশ পর্বের পর তাই দেখতে দেখতেই গোতে থাকলাম গন্তব্যের উদ্দেশে হিমাচলের মান্ডি জেলার সদর মান্ডি অনেকটাই বড় তার কাছ থেকেই চলে গেছে ধরমশালা যাওয়ার রাস্তা দুপুরে আবারও এক অখ্যাত জায়গায় সারা হল মধ্যাহ্নভোজন অনেকক্ষণ ধরেই আমাদের পাশে পাশে চলছে বেদব্যাসের নামাঙ্কিত হ্রদ ব্যাসকুণ্ড থেকে প্রবাহিত বিয়াস বা বিপাশা নদী বলতে গেলে পুরো রাস্তাই এই বিপাশার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে চলছিলাম আমরা কোথাও ক্ষীনতনু, কোথাও চওড়া বুকে ধরে রেখেছে অগাধ জলরাশি এ নদী প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গিয়ে মিশেছে পঞ্জাবের শতদ্রুতে প্রকৃতির কী বিচিত্র লীলা দেখতে পেলাম দীর্ঘ একটি টানেলের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এই টানেলটি তৈরি হয়ে গেলে যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য কমে যাবে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটারের মতো। বিকেল প্রায় চারটেয় গিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আমার স্বপ্নের কুলুতে রাস্তার পাশে বিপাশার পাড়ে বিশাল উপত্যকা জুড়ে ঘন জনবসতি পুরো একটা ছবির মতো লাগছে আমি আচ্ছন্ন যৌবনের সেই গ্রন্থের পাতায় পাতায় বর্ণিত সৌন্দর্যের আবেশে এবার যেন সব কিছু চোখের সামনে এক স্বপ্নপূরণের আনন্দে মন মেজাজ একেবারে ফুরফুরে একটি শাল ফ্যাক্টরির সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের গাড়ি সবাই ঢুকলেন কেনাকাটার উদ্দেশে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেই চলেছি চারপাশ আমার মোবাইলের চার্জ ততক্ষণে শেষ অপরূপ প্রাকৃতিক কিছু দৃশ্যের ছবি তোলা আর সম্ভব হলো না অগত্যা ফ্যাক্টরির লাগোয়া, পথের পাশে চায়ের দোকান থেকে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে বসে রইলাম স্বপ্নপুরীতে এক অনির্বচনীয় তৃপ্তি
কেনাকাটা হল না কিছুই দরদামে নাকি পোষাল না অগত্যা আবার গাড়িতে উঠে বসা কুলু থেকে মানালি বড় জোর আধঘণ্টার জার্নি সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে আমরা পৌঁছে গেলাম মানালি বিশেষ কিছু দেখা গেল না নির্ধারিত হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকে চাঙ্গা হতে হতে এসে গেল সান্ধ্য চা সারা দিনের ধকলে সেদিন আর বিশেষ আড্ডা হল না রাত নটায় রাতের আহার সেরে বিছানায় গিয়ে এলিয়ে দিলাম শরীর কাল আরেক এডভেঞ্চার যাত্রা
###
মানালি থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূর বারালাছা লা পাস্ সংক্ষেপে শুধুই বারালাছা হিমালয়ের জন্সকার রেঞ্জের অন্তর্গত পর্বতশ্রেণি। রোতাং পাসে বরফ পড়ার কোনো খবর নেই তাই ওখানেই যাওয়ার পরিকল্পনা হল সেই হিসেবে সকাল ছটায় উঠে আবার শুরু যাত্রা মানালি থেকেই ভাড়ায় নেওয়া হল বরফের দেশে ঘোরাঘুরির সাজসরঞ্জাম জ্যাকেট, জুতো, মোজা, হাতমোজা, টুপি ইত্যাদি সবার ভেতরে এক রোমাঞ্চ হোটেল থেকে বেরিয়েই দেখেছি সকালের সূর্যালোকে স্বর্ণালি পর্বতচূড়া বরফের উপর আলোর বিকিরণে যেন স্বর্ণিম আভা ছিটকে বেরোচ্ছে বলতে গেলে প্রায় হৈ হৈ চিৎকার জুড়ে দিয়েছে সবাই কনকনে ঠাণ্ডায় ভাড়া সামগ্রীর দোকানের অপর পাশে অবস্থিত চায়ের দোকানের প্রাতঃকালীন চা যেন শরীরে ঢেলে দিয়েছে ফুরফুরে আমেজ শুরু হলো আরেক দীর্ঘ পথ চলা - সাথে আছে বিপাশা আর একের পর এক পাহাড় যার চূড়ায় শ্বেত শুভ্র বরফের প্রলেপ দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ সাদা মাখনের ভাণ্ড উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে পাহাড়চূড়ায় দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলামঅটল টানেল পাহাড়ের বুক চিরে দীর্ঘ ১০ কিলোমিটারের উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সুড়ঙ্গ অসাধারণ অনুভূতি বাচ্চারা গাড়ি থামিয়ে নেমে গিয়ে ছবি তুলল টানেলের সামনে দাঁড়িয়ে টানেল পেরিয়ে একের পর এক পাহাড় পেরিয়ে চলতেই থাকল বাহন দুপুর প্রায় ১২ টায় গিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম টান্ডি বারালাছার আগের শেষ জনপদ কিছু দোকানপাট - মূলত খাবারদাবারের, পেট্রল পাম্প আদি এখানেই সারা হল সকালের প্রাতঃরাশ গরম গরম ম্যাগি আর ওমলেট ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়ছে লাহুল-স্পিতি উপত্যকায় পৌঁছেই আবার মননে শঙ্কু মহারাজ কত কত বছরের লালিত স্বপ্নপূরণ এখানেই দর্শন হল চন্দ্রা ও ভাগার সঙ্গম স্থল উৎপন্ন হলো হিমাচলের সর্ববৃহৎ নদী চন্দ্রভাগার পঞ্চনদীর দেশ পঞ্জাবের অন্যতম প্রধান নদীও বটে জম্মু অঞ্চল হয়ে এ নদী শেষ পর্যন্ত সিন্ধুতে মিলিত হয়েছে বিপাশা এবং চন্দ্রভাগা উভয় নদীই বেদে উল্লেখিত এই নদীর উপরেই হিমাচলের দীর্ঘতম সেতু আমরা পেরিয়ে ছুটে চললাম বারালাছার দিকে যত এগোচ্ছি ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে, পাহাড়গুলো প্রকাণ্ড হয়ে উঠছে আঁকাবাঁকা রাস্তা কোথাও মসৃণ কোথাও বিপদজনক প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চ উপরে উঠছি আর ক্রমশ বরফের সান্নিধ্যে পৌঁছাচ্ছি শেষ পর্যন্ত দুপুর একটায় গিয়ে পৌঁছে গেলাম সেই লক্ষ্যে যেখানে আমাদের আগেই পৌঁছে গেছেন আরো অনেক পর্যটক গাড়ি থেকে নামতেই এক ঝটকা মাথা ঘুরিয়ে প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম সামান্য শ্বাসকষ্ট বুঝতে পারছি অক্সিজেন লেভেল কম থাকার জন্যই এমনটা হচ্ছে নিজেকে সামলে নিলাম শীঘ্রই এর পর দেখছি গাড়ি থেকে এক জন এক জন করে নামছে আর একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কারো কম, কারো বেশি দলের সবচাইতে বয়স্ক দুজন আর যেতেই পারলেন না গাড়ি থেকে নেমে সঙ্গে সঙ্গে আবার গাড়িতে উঠে বসে রইলেন জানিয়ে দিলেন - আমরা যাচ্ছি না জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন তাঁরা আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলাম তাঁরা কিছুটা ধাতস্থ হতে আমরা পা বাড়ালাম পাহাড় জুড়ে বরফের চাদরে নিজেদের সঁপে দেব বলে কিন্তু এ কী ? সহজে হাঁটতে পারছি না কেন ? একটু জোরে হাঁটলেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আবার ধীরেসুস্থে এগোলে কোনও সমস্যা নেই অগত্যা ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম সামনেই একের পর এক শুভ্রবসনা পাহাড় যেন মৌনী মহাদেব - গভীর তপস্যায় মগ্ন তাঁর পায়ের নীচে পর্যটকের সারি একটি বাচ্চাকে দেখলাম কষ্টে মা গো, বাবা গো বলে কাঁদছে কেউ কেউ সটান শুয়ে আছেন পাথরের উপর অক্সিজেনজনিত সমস্যায় কম বেশি সবাই আক্রান্ত এসব দেখেও একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে আমরা পাঁচ জন এগোতে থাকলাম সামনের দিকে ধীরে ধীরে অনেকটা উপরে উঠে গেলাম চারদিকে বরফ শুধু বরফ এরই আহ্বানে তো এখানে আসা মন প্রাণ চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল বাচ্চারা ইতিমধ্যে যথেষ্ট সহজ হয়ে গেছে ওরা আরো কিছু উপরে উঠে দস্তুরমতো খেলা শুরু করে দিয়েছে বরফ নিয়ে ইগলু বানাচ্ছে, বরফ ছুঁড়ছে এ ওর দিকে ওদের আনন্দ দেখে আমরাও সার্থক হয়ে গেলাম প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে থেকে ধীরে ধীরে আবার ফিরে এলাম গাড়িতে ফেরার পথে দেখলাম এক সদ্য বিবাহিত যুবক তাঁর নবীন স্ত্রীকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে আসছেন একাধারে দুঃখ এবং মজার এক দৃশ্য ড্রাইভারকেও কিছুটা আক্রান্ত বলে মনে হল তবে গাড়ি চালাতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয় শুরু হল ফেরত যাত্রা যত নীচে নেমে এসেছি ততই ধীরে ধীরে সবাই সুস্থ বোধ করতে লাগলাম কোনও এক অনামা জায়গায় এসে বিকেল প্রায় পাঁচটায় সারা হল দুপুরের আহার মানালি থেকে বারালাছা রাস্তাটি যেমন সুন্দর তেমনি রোমাঞ্চকরও বিশাল বিশাল পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কেটে কেটে তৈরি হয়েছে রাস্তা শক্ত পাথরের পাহাড় কোথাও রাস্তার উপরে বেরিয়ে এসেছে পাহাড়ের কেটে ফেলা খিলান আকৃতির অংশ খসে পড়লে চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার বাইরে কিছু করার নেই উপরে তাকালে পিলে চমকে যায় নদীর ওপারে এক একটি গ্রাম কী করে ওরা জীবন নির্বাহ করে তা ভাবলে অবাক হতে হয় কত বিচিত্র আমাদের এই দেশ, এই পৃথিবী
রাত প্রায় নটায় এসে আবার থিতু হলাম মানালির সিলভার মুন হোটেলে, যেখানে আমরা উঠেছি কাল মানালি লোক্যাল ট্যুর
###
বেদপ্রাচীন মনু। বিভিন্ন শাস্ত্র, সংহিতা, মহাভারত আদিতে উল্লেখিত মনুর আলয় থেকেই মানালি নামের উৎপত্তি। সুতরাং সেখানে ধর্মীয় নানা স্থাপত্য থাকার সম্ভাবনা স্বভাবতই স্বাভাবিক। প্রায় চারশো বছর পুরোনো কাঠের মন্দির। না, কোনও দেবদেবীর নয়। মানালির সবচাইতে উল্লেখযোগ্য মন্দিরটি হলো মহাভারত খ্যাত ভীমের পত্নী হিড়িম্বার নামে। পাশেই আবার পুত্র ঘটোৎকচের জন্যও বরাদ্দ আছে আলাদা সংরক্ষিত বৃক্ষতল বেদি। কথিত যে এখানেই নাকি ছিল তাঁর আবাস। আমরা মানালি স্থানীয় ঘোরাঘুরির প্রথম পর্যায়ে কিন্তু সেখানে যাইনি। প্রথমেই সটান গিয়ে হাজির হয়েছিলাম বশিষ্ঠ মন্দির। বশিষ্ঠ মুনির অপরূপ কাষ্ঠনির্মিত বিগ্রহ ও মন্দিরে আছে শীতল ও উষ্ণ জলের কুণ্ড। কথিত যে এখানেই নাকি দল বেঁধে দেবতারা আসতেন - এবং আজও আসেন স্নান করতে। তাই এই কুণ্ডের জল খুবই পবিত্র এবং রোগনিবারক বলে বলা হয়ে থাকে। পর্যটকের ভিড় লেগেই আছে। পথের দুই পাশে অগণিত দোকানপাট। অনেক দোকানদারকেই শোনা গেল বাংলায় কথা বলে খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয় পায়ে হেঁটে। তাই বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গেল এখানেই। এখান থেকেই হিড়িম্বা মন্দিরের বিশাল চত্বরে। মন্দিরে আর ঢুকিনি। দেবতার রুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই হয়ত। তাছাড়া হিড়িম্বাও তো ছিলেন আমাদের প্রতিবেশীই। তাই বাইরে থেকেই মনোরম কিছু সময় কাটালাম এখানে। বিশাল বিশাল পাইনের গাছ এখানের সম্পদ। পাশেই আছে বন-বিহার। সময়াভাবে ভিতরে প্রবেশ করিনি আমরা।
হিড়িম্বা মন্দির থেকে চলে আসি বিখ্যাত ক্লাব হাউস। এখানে বিশাল চত্বর জুড়ে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বিনোদনের সম্ভার। আকর্ষণীয় বিপণি, খেলাধুলার জায়গা এবং ঘুরে বেড়ানোর উপযুক্ত প্রাকৃতিক শোভাসম্পন্ন স্থান। সেখানে আমরা বেশি সময় কাটাইনি কারণ ইতিমধ্যে দুপুরের খাবারের সময় চলেই যাচ্ছিল। তাই সোজা চলে এলাম ম্যাল-এ। প্রথমেই ভোজন পর্ব সেরে নেওয়া হল। বিশেষ আকর্ষণ ছিল মানালির বিখ্যাত এবং সুস্বাদু ‘ট্রাউট মাছ’। খুবই ব্যায়সাপেক্ষ এই পদ। এরপর ম্যালে কিছু কেনাকাটা সেরে রাত আটটার মধ্যে হোটেলে। সময়ের অভাবে মনাস্ট্রি এবং সোলাং ভ্যালিতে আর যাওয়াই হল না। তবে আগের দিন বারালাছা যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে দেখা হয়ে গিয়েছিল সোলাং ভ্যালির অপরূপ সবুজিমা আর প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য। আজ কুলু-মানালি ভ্রমণের শেষ দিন। রাতে তাই জম্পেশ আড্ডা হল যদিও সবারই ভেতরে তাড়া ছিল শুতে যাবার। কারণ কাল ভোর পাঁচটায় উঠে ধরতে হবে ফেরার পথ - দিল্লি অভিমুখে। শঙ্কু মহারাজের সময় দুর্গম ছিল সব স্থান। এখন অনেকটাই সুগম। রাস্তা ঘাটের উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট। সবাই বললেন যে গত পাঁচ বছরে সর্বত্র উন্নয়নের জোয়ার বইছে অঞ্চল জুড়ে। পাহাড়ের সফর এখানেই শেষ হল। বিপাশা আর চন্দ্রভাগা থেকে এবার গঙ্গাভিমুখী হওয়ার সময়।
###
বিশাল ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লি। নতুন ও পুরাতনের সমৃদ্ধ সংমিশ্রণ। কত ইতিহাস, কত পরিবর্তনের গাথা। নতুন প্রজন্মের কাছে দিল্লিকে চেনার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। আমি আগেও বহু বার গেছি। কিন্তু মূলত বাচ্চাদের দেখার জন্য এক দিন আমরা দিল্লিতে থাকব বলেই মনস্থির করে গেছি। সেই অনুযায়ী ভোর সাড়ে পাঁচটায় মানালি থেকে বেরিয়ে দিল্লি পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত সাড়ে এগারোটা। পথে নতুন প্রাপ্তি হরিয়ানার কারনাল শহরে প্রায় দু’ঘণ্টার বিরতি। আমাদের ড্রাইভার বদল হবে সেখানে। এই ক’দিনের ড্রাইভার লাভলির ঘর কারনালের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে। গ্রাম হলেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রশস্ত পিচ ঢালা রাস্তায় গাড়ি চলে মসৃণ চালে। হরিয়ানা কৃষি এবং শিল্প উভয় ক্ষেত্রে এক উন্নত রাজ্য। এর কিছু ঝলক আমরা দেখতে পেলাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির কাছে কৃষিজ উৎপাদনের সম্ভার। ধান গমের মাড়াই ক্ষেত্র, মিল। সেখান থেকে নতুন ড্রাইভারের দক্ষ চালনায় গাড়ি কারনাল শহরের বুক চিরে এগিয়ে চলল দিল্লির রাস্তায়। বিশাল শহর কারনাল। ততক্ষণে রাত নেমেছে। নিয়ন বাতির ঝলমলে আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। দিল্লিতে টেলিফোনে হোটেল বুক করা ছিল যদিও সে রাতেই ফোন করে জানা গেল যে বিশেষ কারণে আমাদের বুকিং কনফার্ম হয়নি। অগত্যা সবাইকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আমরা দুইজন পুরুষ মানুষ নতুন করে হোটেল বুক করলাম। পাহাড়গঞ্জে হোটেলের অভাব নেই যদিও পরিচ্ছন্নতার অভাব অধিকাংশ হোটেলেই। তাই খানিকটা সময় লাগল। পাহাড়গঞ্জে হোটেল নেওয়ার পেছনে যে কারণটি মুখ্য ছিল তা হলো এত দিন পর একটু বাঙালি খাবারের লোভ। রাত একটায় হোটেলে পৌঁছে রেডিমেড খাবার খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে দিল্লি ঘোরাঘুরির জন্য একটি গাড়ি আগেই বুক করে রাখা ছিল। সেই অনুযায়ী সকালে ঠিকঠাক হয়ে একসাথে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে ওঠার উদ্দেশে হোটেল থেকে বেরোতেই সবার চক্ষু চড়কগাছ। একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। রাস্তাঘাট জলমগ্ন প্রায়। মন খারাপ হয়ে গেল সবারই।
এভাবেই জলখাবার খেয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই। লক্ষ্য কুতুব মিনার, ইন্ডিয়া গেট, লোটাস টেম্পল্‌, লালকেল্লা এবং অক্ষরধাম মন্দির, অন্তরে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার প্রার্থনা। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয় আরকি। সারা দিনেও আর থামল না বৃষ্টি। সেই যে বৃষ্টিতে ভেজা শুরু হলো তার চূড়ান্ত হলো অক্ষরধাম মন্দিরে। সেখানে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। তখন তুমুল বৃষ্টিপাত চলছে। থামার কোনো লক্ষণই নেই। তা বলে এতটা কাছে এসে ফিরে যাবারও ইচ্ছে নেই কারো। অগত্যা আপাদমস্তক বৃষ্টিভেজা হয়েই পৌঁছে গেলাম অভ্যন্তরে - নানা রকম তালাশের বেড়াজাল পেরিয়ে। এতটা বৃষ্টিভেজা সেই কৈশোর বেলার পর আর হইনি। ভাগ্যিস এই বয়সে এসেও শরীর যে খারাপ হয়নি। স্থাপত্য এবং সৌন্দর্যের অবাক করা সংমিশ্রণ হল এই মন্দির। চোখ ফেরানো দায়। মোবাইল বা ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ তাই ছবি তোলা গেল না। সেখান থেকে ফিরে এসে সোজা হোটেলে। পথে দূর থেকে ইন্ডিয়া গেটে নেতাজির মূর্তি দেখা। ভগবানের বিগ্রহের মতোই দেখলাম সবার হাত কপালে ঠেকেছে। আমাদের প্রাণের দেবতা নেতাজি।
হোটেলে এসে ভেজা দেহটাকে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে নিতে অনেকটাই সময় লাগল। রাত ন’টার মধ্যে আবার বেরোতে হবে স্টেশনের উদ্দেশে। পুরোনো দিল্লি স্টেশন থেকে রাত সাড়ে দশটায় হরিদ্বারের ট্রেন। সাতটা বাজতেই তাই সবাই মিলে বাঙালি খাবারের হোটেলে গিয়ে উপস্থিত। আহা কত দিন পর পেট পুরে একটু ডাল ভাত খাওয়া হলো। সাথে আলু ভাজা আর ছোট মাছের ঝোল। মনে হচ্ছিল এক যুগ পরে যেন একটু খেতে পারলাম। সাধে কি আর বলে ভেতো বাঙালি কিংবা মেছো বাঙালি ? বৃষ্টি থামেনি তখনও। এরই মধ্যে আবার সব লটবহর নিয়ে বেরোতে হল। স্টেশনে পৌঁছে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে যেন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা গেল।
###
হরিদ্বার। কিংবদন্তি অনুযায়ী এখানেই দেবী গঙ্গা ভগবান শিবের জটা থেকে মুক্তি পেয়ে পৃথিবীতে নেমেছিলেন। তাই গঙ্গাদ্বার কিংবা হরদ্বার। এরপর বৈষ্ণবীয় উচ্চারণের গড্ডলিকা প্রবাহে হরিদ্বার। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে সপ্তপুরী নামে পরিচিত সাতটি পবিত্র স্থান যেখানে অমৃতের বিন্দু পড়েছিল তার মধ্যে অন্যতম। গঙ্গাকে এখানে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে ভিন্ন ধারায় বইয়ে দিয়ে আধ্যাত্মিক তথা সামাজিক মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ছয়টায় আমরা বৃষ্টিহীন পরিবেশে হরিদ্বার স্টেশনে নেমে অটো করে চলে আসি গঙ্গাপাড়ের একটি পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই আমাদের দু’টি রুম দেওয়া হয়। একটিতে চার জন এবং একটিতে তিন জন। রুমে ঢুকেই সোজা সবাই মিলে ব্যালকনিতে। পাশাপাশি রুম দু’টোর ব্যালকনিও পাশাপাশি। সামনেই প্রবাহিত গঙ্গা। অপরূপ এক দৃশ্য। কিন্তু চোখটা টনটন করে উঠল যখন দেখা গেল গঙ্গার নানা জায়গায় বর্জ্য পদার্থের স্তুপ। এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আবার দেখা গেল এসব পেরিয়েই কেউ কেউ হেঁটে চলে যাচ্ছেন নদীর জলে, ডুব দিচ্ছেন পরম ভক্তিভরে। বিচিত্র এই দেশের ভক্তিপ্রাণা লোকজন।
যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঘোরাঘুরির উদ্দেশে। কারণ এখানেও আমরা মাত্র একটি দিনই থাকব। পরদিন সকালেই ফেরার ট্রেন। প্রথমেই পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠার ট্রলি করে যাওয়ার আনন্দ নিতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মনসা দেবী মন্দিরের উদ্দেশে। কিন্তু ট্রলি বা রোপওয়ের টিকিট ঘরের সামনে যেতেই চোখে পড়ল বিশাল লাইন। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো যে টিকিট কাটার পর অন্তত দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে উপরে যাওয়ার জন্য। এতটা সময় আমাদের হাতে নেই। তাই ফিরে এসে উঠে বসলাম আগেই বলে রাখা একটি গাড়ির সিটে। উদ্দেশ্য স্থানীয় কিছু বিশেষ মন্দির দর্শন। প্রথমেই গেলাম দক্ষ মন্দির। ঢোকার মুখেই সতীর মন্দির। এখানেই নাকি অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষযজ্ঞ। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলুকুলু গঙ্গা। ঠিক কুলুকুলুও বলা চলে না, গঙ্গা এখানে খরস্রোতা। বাঁধানো ঘাটে বসে চোখ জুড়িয়ে নিলাম খানিক ক্ষণ। উঠে এসে সবাই প্রবেশ করলেন যজ্ঞকুণ্ড দর্শনের লক্ষ্যে দক্ষ মন্দিরের গর্ভগৃহে। আমরা দু’এক জন রইলাম বাইরে। এই চত্বরে আছে একটি রুদ্রাক্ষের গাছ। তেমন বড় হয়নি যদিও দেখা গেল শাখায় লেগে আছে রুদ্রাক্ষ ফল ও বীজ। হরিদ্বারে রুদ্রাক্ষের বিশাল ব্যবসা। সেখান থেকে বেরিয়ে এবার চলে এলাম বিল্বকেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। বলতে গেলে গভীর বনানীর মধ্যে অবস্থিত এই মন্দির। অপূর্ব এক মোহময় শান্ত পরিবেশ। জুতো খুলে ঢুকতে হয় বলে আমি আর ভেতরে গেলাম না। কিন্তু যাঁরা গেলেন তাঁরা অনেকটা সময় কাটিয়ে প্রসাদ খেয়ে তৃপ্ত হয়ে আমাদের জন্যও হাতে করে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বহু সময় পর। স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত আছে যে এখানেই একটি বেল গাছের নীচে মাতা পার্বতী বর হিসেবে ভগবান শিবকে পেতে ৩০০০ বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন এবং ভগবান শিব তুষ্ট হয়ে তাঁর ননোষ্কামনা পূর্ণ করেছিলেন। এখন বেলগাছের জায়গায় আছে একটি বহু পুরোনো নিম গাছ। বিল্বকেশ্বর মন্দির থেকে বেরোতে অনেকটাই বেলা হয়ে এল। পেটে তখন ইঁদুর দৌড়চ্ছে। হরিদ্বার আসব আর দাদা-বৌদির হোটেলের সুস্বাদু নিরামিষ আহার খাব না তা হয় না। সুতরাং পরবর্তী গন্তব্য ভোজনালয়। এখানে আমরা গাড়ি ছেড়ে দিলাম। কারণ এখান থেকে আমাদের থাকার হোটেল পায়ে হাঁটা পথ। ভাতের সঙ্গে ঘি সহযোগে গরম গরম বেগুন ভাজা আর ধোকার ডালনা এই হোটেলের সব চাইতে আকর্ষণীয় পদ। এ নিয়ে যাত্রা শুরুর আগেই আমাদের মধ্যে জবর আলোচনা চলছিল। এবার রসনা তৃপ্ত করে সারা হলো ভোজন পর্ব।
খেয়েদেয়ে হোটেলে পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয় হয়। মনের মধ্যে হাজার বাতির আহ্বান। গঙ্গার ঘাটের হর কী পৌরী (শিবের চরণস্থান)র সেই বিখ্যাত সান্ধ্য আরতি। যে একবার দেখেছে তার বার বার দেখেও আশ মেটে না। আমাদের হোটেল থেকে বড় জোর ১০০ মিটার। সুতরাং তড়িঘড়ি দে ছুট। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। দর্শনস্থানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে পা ফেলা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দলের যারা দেখতে গেলেন তারা বহু কষ্টে এক ঝলকই শুধু দেখতে পেলেন।
রাতের খাবারদাবার চুকে যাওয়ার পর হোটেলের ব্যালকনিতে বসে রাতের নিয়ন আলোতে গঙ্গার অপরূপ রূপ দর্শনের মুহূর্তটি জীবনেও ভুলব না। উঠে রুমের ভেতর আসতে ইচ্ছা করছিল না। সনাতন ভারতের আধ্যাত্মিক চেতনার সাময়িক উন্মেষ অন্তরাত্মাকে যেন শোধন করে দেয় এমনই মনোরম সেই মুহূর্ত। মনে হচ্ছিল আরো একটি দিন থাকতে পারলে……। কিন্তু তা হবার নয়। কাল ফেরার দিন।
###
সকাল সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে উঠতেই মোবাইলে ভেসে এল রেল দপ্তরের নোটিশ। আমাদের ট্রেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেট। মাথায় যেন বজ্রপাত হল। এত লেট হলে তো দিল্লিতে গিয়ে যোগাযোগকারী আমাদের ফেরার ট্রেন ধরতেই পারব না। এতগুলো লটবহর এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে নিয়ে যেতেই তো ঘণ্টাদুয়েক লেগে যাবে। নিজামুদ্দিন স্টেশন থেকে নয়াদিল্লি স্টেশনে যাওয়ার কথা আমাদের। গুয়াহাটিগামী রাজধানী নয়াদিল্লি স্টেশন থেকেই ছাড়ে। অগত্যা গত দিনের গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন করে একটি আর্টিগা গাড়ি বুক করা হলো। সড়ক পথে এমনিতেই সময় অনেকটা কম লাগে। তাই এবার একটু সহজ হয়ে আমরা হোটেলের বিল মিটিয়ে মা গঙ্গাকে প্রণাম করে রওয়ানা হলাম দিল্লির উদ্দেশে।
উত্তর ভারতের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকে আমার তিন অভিন্নহৃদয় সহপাঠী বন্ধু। বিদ্যালয় স্তরের সহপাঠী। আমাদের একটি হোয়াটস্‌এপ গ্রুপও আছে। সেখানে নিয়মিত স্ট্যাটাস আপডেট করতে হয়। আমার প্রতিটি মুহূর্তের স্ট্যাটাসও সেখানে দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। এই খবর পাওয়া মাত্রই মীরাটে অবস্থানরত বন্ধু বিশ্ববিজয় তা লুফে নিল। আমাদের গাড়িটি নাকি মীরাট হয়ে অর্থাৎ মীরাটের পাশ দিয়েই যাবে। সুতরাং - ‘আমি আসছি বাইপাসে’। আর যায় কোথা ? প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সপরিবারে এসে দাঁড়িয়ে রইল পথের পাশে। দীর্ঘ ৪০ বছর বাদে আবার হল দেখা। এ না হলে বন্ধু। বিশ্ববিজয় একটি সুগার প্রডাকশন কোম্পানির ডিজিএম। ওর অফিস থেকে বাইপাসের দূরত্ব ছিল আরোও বেশি। প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আমার আসার খবর পেয়েই রওয়ানা দিয়ে আমি পৌঁছানোর আগেই এসে দাঁড়িয়ে থেকেছিল নির্ধারিত জায়গায়। কথামালার সাথে সাথে হল জম্পেশ চা-আড্ডা। অন্তর পূর্ণ হলো বন্ধুকৃত্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের এই যাওয়া আসা এসব কিছুই কে যেন নিয়ন্ত্রণ করেন অলক্ষ্যে থেকে। নাহলে আজকের দিনে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাকি দুই বন্ধু থেকে গেল ছোঁয়ার বাইরে। পরবর্তীতে নিশ্চয়ই হবে দেখা - যদি সেই অলক্ষ্যে থাকা নিয়ন্ত্রকের অনুমতি থাকে।
যথা সময়ে নয়াদিল্লি স্টেশনে পৌঁছে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে নির্ধারিত প্ল্যাটফর্মে গিয়ে খাবারদাবার সেরে সময় মতো উঠে বসলাম ট্রেনে।
শুরু হল ঘরফেরত যাত্রা। এবার দেড় দিনের ট্রেনযাত্রা শেষে ঘরে ফেরার পালা। শেষ হলো ঠাসা ভ্রমণসূচির এক কল্পমানস সফর। প্রতিটি সফরে হৃদয়পুরে সঞ্চিত হয় স্মৃতিকথার পাহাড়। ভবিষ্যতের এক অমূল্য সম্পদ। আমরা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছি জীবনের অধিকাংশ পথ। আবার এদিকটায় আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই স্মৃতির ভাঁড়ারে এই সফর জমা হয়ে রইবে বর্ণিল এক সফর হিসেবেই আর পরবর্তী প্রজন্মের এই বাচ্চাকাচ্চাগুলো হয়ত সঞ্চয় করে রাখবে ভবিষ্যতের একাধিক সফরের সমৃদ্ধ মুখবন্ধ।

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়