Skip to main content

সুচয়িত সম্ভারে উৎকৃষ্ট আয়োজন - ‘ঈশান’


দীর্ঘ বিরতির পর নবোদ্যমে নব আঙ্গিকে এবং সাথে ধারাবাহিক পথ চলার নব প্রতিশ্রুতি নিয়ে গত ডিসেম্বরে শিলচর থেকে পুনঃপ্রকাশিত তথা উন্মোচিত হলঈশানপত্রিকার৩৪ বর্ষ ডিসেম্বর সংখ্যা ২০২২
৫২ পৃষ্ঠার আয়োজনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে গুণমানে সমৃদ্ধ এক গুচ্ছ রচনা। আকার কিংবা আয়তন দেখে মুখ ফিরিয়ে - বলা ভালো - চোখ ফিরিয়ে নিলে আত্মবঞ্চনার শিকার হবেন পাঠকবৃন্দ। স্বল্প পরিসরে এত উৎকৃষ্ট লেখালেখির সম্ভার সচরাচর ছোটপত্রিকায় নজরে আসে না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে ‘ঈশান’ ব্যতিক্রমী তকমা পাওয়ার যোগ্য। সম্পাদকের তীক্ষ্ণ নজরদারির সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয় বিষয় নির্বাচনে। বহুচর্চিত বিষয়ের উপর উপুর্যুপুরি প্রবন্ধ নিবন্ধ নিয়ে হয়তো তেমন উৎসাহী ছিলেন না সম্পাদক কিংবা সম্পাদকীয় দপ্তর। তবে বাদ পড়েনি কিছুই। কী নেই এবারের সংখ্যায় ? কবিতা, বিদেশি সাহিত্যের উপর নিবন্ধ, গ্রন্থ পর্যালোচনা, গল্প - আছে সবকিছুই। কিন্তু এসবকেই ছাপিয়ে গেছে তিন তিনটি ধারাবাহিক রচনা। একটি ছোট পত্রিকায় একসাথে তিনটি ধারাবাহিক রচনার সমাবেশ - নিশ্চিতই এক অভিনব এবং অভাবনীয় প্রয়াস। আর সেই ধারাবাহিকের স্রষ্টারা যদি হন বহু প্রশংসিত, বহু চর্চিত তাহলে পত্রিকার মান কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় তা সহজেই অনুমেয়। ধারাবাহিক রচনা সন্নিবিষ্ট হলে পাঠক মনেও পত্রিকার ধারাবাহিক প্রকাশ নিয়ে কোন সন্দেহের অবতারণা হয় না - যদিও পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশের  ব্যাপারে সম্পাদকীয়তে সম্পাদক লিখছেন - ‘এবার থেকে ঈশান মাসিক, মাসে একটা সংখ্যা নিয়মিত প্রকাশ হবে।’
সম্পাদকীয়তে ‘ঈশান’ এর উৎকৃষ্টতার মান বজায় রাখার অঙ্গীকার ধ্বনিত হয়েছে - ‘কোনো না হয়ে ওঠা গল্প কবিতাকে ঈশানের পাতায় তুলে ধরতে এই সম্পাদক অপারগ - লেখার ন্যূনতম মান যাতে বজায় থাকে তার আন্তরিক সহায়তাই চেয়েছি আমরা - কোনো মনান্তর নয় - চেয়েছি একসাথে চলতে।’ সম্পাদকের এই প্রচেষ্টা, এই প্রত্যয় বাহবাযোগ্য নিঃসন্দেহে। কারণ এই একটি জায়গায় সচরাচর ছোট পত্রিকার সম্পাদকরা অনেকেই অসহায়তার কবলে নিমজ্জিত হন। ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র বিড়ম্বনায় এক প্রকার আত্মসমর্পণে বাধ্য হতে হয় সম্পাদকদের। তবে এবারের সংখ্যা ‘ঈশান’-এ এ দায় থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন সম্পাদক। পরবর্তী সংখ্যা সমূহে এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতে পারবেন বলে আশা করা যেতেই পারে।
প্রথমেই সাহিত্যিক তপোধীর ভট্টাচার্যের ধারাবাহিক আত্মকথা - ‘মাঝি, বাইয়া যাও রে -‘। প্রথিতযশা এই লেখকের স্বভাবসিদ্ধ লিখনশৈলীতে লিখা তাঁর আত্মকথার সুসজ্জিত ‘নাও’টি যে তরতরিয়ে এগিয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আত্মকথার ছলে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা জীবন্ত হয়ে ওঠার যাবতীয় আয়োজন প্রথম পর্বেই বিদ্যমান। রূপকে, উপমায় জাতিসত্তার স্বকীয় বিশ্লেষণে এক দলিল হয়ে ওঠার সমূহ লক্ষণ ফুটে উঠেছে রচনায়।
ধারাবাহিক আত্মকথা আরোও একটি আছে। আরোও একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক রণবীর পুরকায়স্থের লিখা ‘কিত্তাপাতার কড়চা’। পাঠক মহলে ঔৎসুক্য বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য রচনার শেষ লাইনটিই যথেষ্ট। এখানে লেখক সরাসরি বিষয়ভাবনায়, যাপন কথার বিশ্লেষণে আত্মমগ্ন। এখানেও সমাজের সমকালীন চিন্তাভাবনা আসছে স্বভাবতই। মাঝে কিছু রচনাকে ডিঙিয়ে দু’টি রচনাকে একসাথে আলোচনার আওতায় নিয়ে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে দু’টি রচনার মধ্যে কিছু আত্মগত সাযুজ্যের উপস্থিতি। যেন একই রাগে, একই সুরে বাঁধা দু’টি ভিন্ন গান, স্বতন্ত্র রচনা। উভয়েই পত্রিকার সম্পদ।
শ্যামলী কর ভাওয়াল ‘বিদেশি সাহিত্য’ বিভাগে দ্বিশততম জন্ম বর্ষ উপলক্ষে তুলে এনেছেন কার্ল পিয়ের বোদল্যের-এর ‘লে ফ্লার দ্যু মাল’ নিয়ে এবং সমান্তরাল ভাবে বোদল্যের-এর জীবনচর্চা নিয়ে একটি অনবদ্য নিবন্ধ। পাঠকের দৃষ্টি এবং মস্তিষ্ক আকর্ষণে নিঃসন্দেহে সফল এক মূল্যবান রচনা।
কবিতার বিভাগ ‘ঘরে-বাইরে’। নামকরণের যৌক্তিকতা উল্লেখ করা হয়নি কোথাও। শুধু দু’জন কবির এক গুচ্ছ করে কবিতায় সেজে উঠেছে এবারের কবিতা বিভাগ। রাজীব ভট্টাচার্য এবং কৌশিক চক্রবর্তীর কবিতা পড়তে পড়তে এক সময় মনে হয় যেন এ বিভাগটি ছাপিয়ে গেছে অন্য সব বিভাগকে। প্রতিটি কবিতা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন উৎকৃষ্টতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আলাদা করে কবিতাগুলোকে আখ্যায়িত করার কোনও উপায় নেই। অমোঘ শব্দেরা যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসে বসে আছে ছত্রে ছত্রে আপন গরিমায় যথাস্থানে। এর বাইরে আর কিছু হতে পারে না।
উপত্যকা কিংবা এ অঞ্চলের গল্পবিশ্বে সম্ভবত সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নাম মিথিলেশ ভট্টাচার্য। এ সংখ্যা থেকে শুরু হলো তাঁর উপন্যাস - ‘আরেকটি প্রভাতের ইশারায়’। ক্রমে ক্রমে একটি ‘সাড়া জাগানো’ উপন্যাস হয়ে ওঠার যাবতীয় আয়োজন প্রথম পর্বেই বিদ্যমান। একটি গল্প কিংবা উপন্যাসজাতীয় গদ্যের যাত্রারম্ভের যে নৈপুণ্য তা অসাধারণ মুনশিয়ানায় লিপিবদ্ধ করেছেন উপন্যাসকার। চমকে দেওয়ার মতো উপক্রমণিকা। সমকালীন বিষয়সমূহের এক নির্মোহ চর্চার মাধ্যমে এগোবে উপন্যাস - এ নিশ্চিত।
পল্লব ভট্টাচার্যের গল্প ‘যারা একা হয়ে গিয়েছিল’ রূপকধর্মী মোড়কে কঠোর বাস্তবের পোস্টমর্টেম। সাহিত্যাকাশে সচরাচর উপেক্ষিত কিছু বাস্তব চিন্তার উল্লেখ গল্পটিকে ‘ব্যতিক্রমী’ করে তুলেছে।
সম্পাদক অমিতাভ সেনগুপ্ত স্রোতের বিপরীতে কলম ধরেছেন গ্রন্থ পর্যালোচনায়। গল্পকার স্বপ্না ভট্টাচার্যের ‘গল্প সংগ্রহ’ থেকে ‘বোধে ও বীক্ষণে’ এক একটি গল্পের অন্তরমহল থেকে উঠে আসা বার্তার চুলচেরা নির্যাস আহরণ করে পাঠকের পঠনে তুলে দিয়েছেন সযতনে। সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই পর্যালোচনাও নিঃসন্দেহে পত্রিকার এক সম্পদ।
সমাপনে ‘ঈশান’-এর চলার পথের সংক্ষিপ্ত হদিশ দিয়েছেন প্রণব হালদার - যাঁর হাত ধরে পত্রিকার নামকরণ। সব মিলিয়ে স্বল্প পরিসরে, সুচয়িত সম্ভারে ‘ঈশান’-এর এ এক বিশাল আয়োজন। কাগজ ও ছাপাই মাঝারি মানের হলেও স্পষ্ট। অক্ষর, শব্দ, বাক্য বিন্যাস যথাযথ। রূপাঙ্কিতা রায়চৌধুরীর প্রচ্ছদ যথেষ্ট অর্থবহ এবং আকর্ষণীয়। একাধিক বানান ভুল রয়ে গেছে চোরাগোপ্তা হয়ে। দু’একটি ছাপার ভুলও চোখে পড়ে।
একগুচ্ছ ধারাবাহিক নিয়ে পত্রিকার পথ চলা সহজ নয় মোটেও। এই বিষয়টি মাথায় রেখে ‘ঈশান’ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে ধারাবাহিকতায়, উৎকর্ষে - এটাই এ মুহূর্তে সবার কাম্য, ‘পথের দাবি’

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

 

‘ঈশান’
সম্পাদক - অমিতাভ সেনগুপ্ত
মূল্য - ৪০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২২৩০৪৩০

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়