Skip to main content

সময়ের প্রেক্ষাপটে চিত্রিত স্মৃতি দাস-এর গল্প সংকলন ‘ভোঁ-কাট্টা’

হাতে এল কবি, গল্পকার স্মৃতি দাস-এর সদ্য প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘ভোঁ-কাট্টা’। বইটি হাতে নিতেই তার আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের জন্য অন্তরে এক ভালো লাগার জন্ম নেয়। সাথে একরাশ ঔৎসুক্য। পাতা ওলটানোর তাগিদ। এক এক করে মোট ১৯ টি গল্পের সমাহার এই সংকলন। এর মধ্যে অধিকাংশই অণুগল্প থেকে কিছুটা বড় আকারের এবং একটি গল্প ‘দিয়ার বৌভাত’ বড় গল্প। কিছু গল্পকে আবার অণুগল্পই বলা চলে। গল্প অর্থে সেরকম মার মার কাট কাট ক্লাইম্যাক্স হয়তো নেই তবু কিছু নেহাতই সাদামাঠা ঘটনাবলি কিংবা কোনও ঘটনা অবিহনেই কিছু অনুভূতি, কিছু কথার বাখানে কোনও বার্তা ছাড়াই এক একটি গল্প সেজে উঠেছে - বলা যায় খানিকটা ব্যতিক্রমী ধাঁচেই।
‘লীলাবতী’, ‘ফেক পোস্ট’, ‘অনমনীয়’ এবং ‘ভীমরুলের বাসা’কে সে অর্থে হয়তো গল্প বলাই যাবে না। আবার শেষ গল্প ‘ছাঁচ’ হয়ে রইল একটি অসমাপ্ত গল্প। ‘শেষ না হয়েও হইল শেষ’। এর বিপরীতে আবার ‘ছোটলোকের বড়লোক হওয়ার সিঁড়ি’, ‘সায়ন্তিকার চাওয়া পাওয়া’ এবং ‘সৎ মা’ যথেষ্ট ভালো গল্প এবং পাঠক মনে উদ্রেক করে যথার্থ পঠনসুখ। অলৌকিক গল্প ‘শিশুর কান্না’ একটি চমৎকার গল্প। তবে শেষটা ভিন্নতর হতেই পারত। বলা ভালো সুযোগ ছিল ভিন্ন আঙ্গিকে সমাপনের। তবে গল্পকার এখানে পাঠককে সুযোগ করে দিয়েছেন আপন অনুভবে গল্পের সারমর্ম অনুধাবন করার। এখানে গল্পকারের মুনশিয়ানা ফুটে ওঠে নিশ্চিত।
সব মিলিয়ে স্মৃতি দাস-এর গল্পে আধুনিক গদ্যের আভাস স্পষ্ট। আকর্ষণীয় শিরোনামে সবক’টি গল্প পাঠকের অনুসন্ধিৎসা আদায়ে সফল একশো ভাগ। সরল সহজ ছাঁচে এগিয়েছে গল্পসমূহ। কোথাও কোনো রূপক নেই, উপমা নেই, ব্যঞ্জনা নেই, জটিলতা নেই। নেই ভাষার কারিকুরি, সাহিত্যের মারকাটারি শব্দ ঝংকার। ঘটনাবলির বর্ণনায় কোনও অতিশয়োক্তি নেই, শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে বিষয়কে দীর্ঘ করার কোনো অছিলাও নেই। সেজন্যই হয়ত গল্পের সমাপ্তিরেখাও টানতে হয়েছে শীঘ্র। ৭০ পৃষ্ঠার গ্রন্থে উনিশটি গল্প নিজেদের মধ্যে তাই জায়গা নিয়েছে মাত্র ৬২ পৃষ্ঠা।
গল্পগুলোতে পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থার একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। বরাক ব্রহ্মপুত্রের ভৌগোলিক ক্ষেত্রে অবস্থিত সমাজ ব্যবস্থার কিছু খণ্ডচিত্র অঙ্কিত হয়েছে একাধিক গল্পে। কিছু সমস্যাও উঠে এসেছে স্বভাবতই যদিও তার সমাধান সূত্র কিংবা যৌক্তিকতা একান্তই গল্পকারের অভিজ্ঞতাপ্রসূত এবং অনির্ণায়ক। চরিত্রসমূহও উঠে এসেছে বহুলাংশে বাস্তব চরিত্রের ছায়াসঙ্গী হয়ে। কল্পনাবিলাসিতার কোনও চেষ্টা সেভাবে দেখা যায়নি গল্পকারের লেখায়। সপাট উচ্চারণে জীবন্ত চরিত্রসমূহেরই উপস্থাপনা হয়েছে সর্বত্র। 
বানান ভুলের আধিক্য রয়েছে গ্রন্থ জুড়ে। বিশেষ করে ‘কি’ ও ‘কী’ এবং ‘র’ ও ‘ড়’-এর পারস্পরিক স্থানচ্যুতি চোখে পড়ার মতো। কিছু বানান রয়ে গেছে পুরোনো এবং নতুন উভয় রূপেই। ছাপার ভুল নেই বললেই চলে। ছাপাই ও বাঁধাই-এর মান যথেষ্ট উন্নত। অক্ষর, শব্দ বিন্যাসও যথাযথ।
গল্পকারের কোনও ‘আত্মকথন’ নেই গ্রন্থে। গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘না ফেরার দেশে’ থাকা মা-কে। প্রচ্ছদ সৌজন্যে ‘সৃজন’। শিলচরের পান্থজন প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের মুদ্রণে শিলচর সানগ্রাফিক্‌স। দ্বিতীয় ব্লার্বে গল্পকারের পরিচিতি থাকলেও প্রকাশকের তরফে প্রথম ব্লার্ব খালি রেখে দেওয়া হয়েছে। যা কিছুটা হলেও দৃষ্টিকটু হয়েছে নিঃসন্দেহে।  
পরিশেষে স্মৃতি দাস-এর এই গল্প সংকলন নিয়ে যা বলা যায় সেই কাজটি গভীর আত্মপ্রত্যয় ও নিষ্ঠায় ‘ভূমিকা’তে ব্যক্ত করেছেন শ্রী দেবাঞ্জন মুখার্জি - ‘... গল্পগুলোতে চরিত্রের ভিড় না থাকলেও যেসব মানুষের চিত্র ও চরিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে তারা মূলত নাগরিক নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ... গল্পের পটভূমি বিস্তৃত না হলেও চরিত্রের শ্রেণি বৈচিত্র্য যথেষ্ট। মধ্যবিত্ত জীবনের মূল্যবোধের সংকট চমৎকার ভাবে চিত্রিত। সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষের ভাবনাও যে ক্রমশ জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে, স্মৃতি দাসের গল্পে তার প্রমাণ মেলে।’

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘ভোঁ-কাট্টা’
স্মৃতি দাস
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫০৯১৯৭৮

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়