Skip to main content

ধারে ও ভারে এক ব্যতিক্রমী সম্ভার ‘শরণ্ময়ী’


দুর্গা পূজা ও দুর্গোৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে সাহিত্য বিষয়ক স্মরণিকা প্রকাশের রেওয়াজ রয়েছে বহু স্থানে, বহু কাল ধরে। নিয়মিত ভাবে এই স্মরণিকা প্রকাশের ধারাকে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট আয়োজকরা। স্বভাবতই পূজার জাঁকজমক ও উৎসবের হই হুল্লোড়ের পাশাপাশি এক নান্দনিক সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে এই স্মরণিকা প্রকাশ করে ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে বহু কাল ধরে। বাংলা সাহিত্যের এই উত্তরপূর্বাঞ্চলও এর বাইরে নয়। বিভিন্ন পূজা সমিতি দ্বারা এই স্মরণিকা প্রকাশের ধারা এখানেও চলে আসছে বহু দিন ধরেই।
গুয়াহটি ভাস্কর নগর সর্বজনীন পূজা কমিটি দ্বারা নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে স্মরণিকা ‘শরণ্ময়ী’। ব্যতিক্রমী গ্রন্থনামের মতোই ‘শরণ্ময়ী’র সর্বশেষ সংখ্যাও (ত্রয়োদশ সংখ্যা ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২০২২) এবার প্রকাশিত হয়েছে এক ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে।
প্রথমেই যে ব্যাপারটি নজর কাড়ে তা হলো এঅপূর্ব প্রচ্ছদ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই প্রচ্ছদের সৌজন্যে কে বা কারা আছেন তাদের নাম খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। স্মরণিকার প্রথম পর্বেই পৃষ্ঠাজোড়া শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছে বিপুল চন্দ্র মুখার্জী এবং ধ্রুব মুস্তাফীকে। শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন যথাক্রমে মদনগোপাল গোস্বামী ও মাম্পি গুপ্ত। শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়েছে পরিচিত, অপরিচিত মানুষদের যাঁরা প্রয়াত হয়েছেন করোনার ভয়ংকর পরিস্থিতিতে।
সম্পাদকীয়তে করোনার ত্রস্ত দিনের শেষে ৫৩ বছরে পদার্পণ করা এই পূজা নিয়ে স্বস্তির পাশাপাশি উদবেগও প্রকাশ করা হয়েছে তড়িঘড়ি প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য মুদ্রণ প্রমাদ নিয়ে। তবে এ শঙ্কা নেহাতই অমূলক মনে হয়েছে। মুদ্রণ বা বানান ভুলের সংখ্যা নিতান্তই স্বল্প। এরপর নিয়মমাফিক রয়েছে পূজা কমিটির সভাপতি অসীম সরকার ও সম্পাদক কৃষ্ণ মণ্ডলের প্রতিবেদন।
ত্রিভাষিক এই পত্রিকায় ছয়টি ইংরেজি ও একটি হিন্দি রচনার বাইরে সবগুলিই বাংলা। প্রথমেই পূজার আবহে কিছু নবতম তথ্যের সংমিশ্রণে এক সুখপাঠ্য নিবন্ধ ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ লিখেছেন উমা ভৌমিক। একই আবহে নারীশক্তির আরাধনা ও নারীর সম্মান বিষয়ক প্রবন্ধ ‘জননী এসেছে দ্বারে’ লিখেছেন নন্দিতা ভট্টাচার্য গোস্বামী। ‘শক্তি ও উপাসনা’ প্রবন্ধে উক্ত স্বরূপ উন্মোচনে ব্রতী হয়েছেণ স্বামী অজাতানন্দ মহারাজ। গীতা ধরের নিবন্ধ ‘মহিমা তব উদভাসিত’ পরিব্রাজক স্বামীজির ভারত ভ্রমণের কিছু ঘটনাবলির উল্লেখে সজ্জিত। খগেনচন্দ্র দাস-এর নিবন্ধ ‘ধর্ম ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শারদীয় দুর্গোৎসব’ শিরোনামের সঙ্গে মানানসই এক উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ। ড. প্রশান্ত চক্রবর্তীর নিবন্ধ ‘দুর্গাপূজা : বঙ্গ ও অসমে উৎসমুখ’ তত্ত্ব ও তথ্যের এক উৎকৃষ্ট রচনা। এরপর রয়েছে ভারতের নানা প্রান্তের উৎসবাদির এক পর্যালোচনা। এই ইংরেজি নিবন্ধটি লিখেছেন অনীশা রায়। হৃদয়ছোঁয়া এক ইংরেজি অণুগল্প ‘A bond so pure’ লিখেছেন অনুজা লোপামুদ্রা বরা দাস। বনশ্রী সরকারের ইংরেজি নিবন্ধ ‘Maa Durga’s Agomoni’ একটি সংক্ষিপ্ত অথচ নান্দনিক প্রতিবেদন।
গল্প বিভাগে রয়েছে কুশল ভট্টাচার্যের ‘ঈশ্বর দর্শন’, কমলেন্দু বসুর ‘ভাগ্যের লিখন’, মধুমিতা সেনগুপ্ত-এর ‘মরীচিকা’, নরেশ আচার্যের ‘একটি অবাস্তব (?) চরিত্র’ এবং রাজ পুরকায়স্থের ‘বুধিয়া’। সবক’টি গল্পই পাঠযোগ্য এবং বুনোটে, বিষয়ে সুলিখিত। কবিতার বিভাগে রয়েছেন কবি দেবাশীষ দেশমুখ, অভিজিৎ সাহা, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, বর্ণালি ঘোষ, গৌতম দে, বাপ্পন দেবনাথ, ভোলা সরকার, অভিজিৎ দত্ত, কৃষ্ণা দাস ও তুষারকান্তি সাহা। সুনির্বাচিত প্রতিটি কবিতা। গল্প ও কবিতা নির্বাচনে সম্পাদকমণ্ডলীর যথাযথ চয়ন স্মরণিকার সাহিত্যগুণ বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে।
বিষয়ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত গদ্য লিখেছেন মদনগোপাল গোস্বামী, অসীম পাল, প্রভাত কুমার ঘোষ, সন্দীপ মজুমদার ও শুভম দাস। শ্রী বরুণ-এর সংক্ষিপ্ত ভ্রমণকাহিনিতে স্থানিক ইতিহাস তথা প্রাকৃতিক পরিবেশ অধিক বর্ণিত হলে ভালো হতো। ইংরেজি বিভাগে আবারও রয়েছে দীপাংক্ষি সহরিয়া ও ৯ বছরের বয়সের জাগ্রভ শীহন দাস-এর কবিতা এবং দেবজিৎ মজুমদারের একটি প্রতিবেদনমূলক প্রবন্ধ।
. দেবব্রত ঘোষের নিবন্ধ ‘বার্তাপ্রেরণ - যুগে যুগে’ ও বিভাস রায়-এর আত্মকথাধর্মী গল্প ‘দুঃসাহসী ও ডানপিটে’ বিশেষোল্লেখের দাবি রাখে। হিন্দি বিভাগে একমাত্র রচনা - আরতি সেনগুপ্তের অধ্যাত্মবাদের আলোকে রচিত - ‘আনমোল বাণী’। সব মিলিয়ে এক বিশাল আয়োজন নিঃসন্দেহে। রচনাসমূহের শেষের খালি জায়গায় মানানসই চিত্র ও উক্তি পত্রিকার মান বাড়িয়েছে নিশ্চিত। সূচিপত্রে পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ না থাকায় পড়তে অসুবিধে হতেই পারে। কাগজ ও ছাপাই-এর মান উন্নত। সুন্দর অলংকরণ-এর সৌজন্যে - অংশুমান বসু। মুদ্রণে ভবানী অফসেট, গুয়াহাটি। সম্পাদক মাম্পি গুপ্ত। এছাড়াও সম্পাদকমণ্ডলীতে রয়েছেন মদনগোপাল গোস্বামী, কমলেন্দু বসু, প্রাণজিৎ কর ও অসীম পাল। ডিটিপি - প্রদীপ শীল।
‘শরণ্ময়ী’ সম্পাদকমণ্ডলীর এক যত্নের ফসল এবং ধারে ও ভারে এক ব্যতিক্রমী সম্ভার - এতে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

মূল্য - অনুল্লেখিত
যোগাযোগ - ৯৮৬৪৩০৫২০৪

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়