Skip to main content

মাটি, মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার কাব্যগ্রন্থ ‘ধুলোডাঙার চাষা’


ধারাপাত থেকে মেলে ধরা ডানা
ধারা বুনেই এগিয়ে যায়
ডগা বেয়ে সিঁড়ি ধাপ
বুকের ভেতর মা মাটি
এবং
অদৃশ্য খনিজস্রোত।
 
আকাশ মাটির সাথে জুড়ে আছে গাছ
শূন্য ঘরের অঙ্কুরিত সুর
বহু দূর থেকে উড়ে আসে পাখি
বাতাস এলে বেশি দোল খেতে নেই
 
গাছে পোকা এলেই
বদলে যায় ফসলের সমীকরণ।
(কবিতা - কবিশস্য)
এভাবেই শুরু হয় কবিতার পথ চলা। অন্তরের অন্দরমহল থেকে ভেসে আসা উৎকণ্ঠা, গরজ আর বাঙময় কাব্যধারার সুরেলা নহবত। কবি অভীককুমার দে’র ৪০ টি কবিতার সংকলন ‘ধুলোডাঙার চাষা’। গ্রন্থসংখ্যা কিংবা কবিতার সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না কবিকে। অভীক মানেই কাব্যের বহমান জগতে এক অবিচল প্রবহমানতার নাম। কবি আদ্যোপান্ত কবিতার চাদরে ঢাকা এক জীবন্ত পথিক। তাঁর মুখের কথায়, তাঁর কলমের ডগায় কবিতার জন্ম হয় স্বতঃস্ফুর্ত ধারায়। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে ব্যঞ্জনায়, কাব্যময়তায়।
এখানে দু’কুড়ি কবিতার কাটাছেঁড়ায় যে সারসত্যটি বেরিয়ে আসে তা হল কবি মনের অভ্যন্তরে জমে থাকা এক কঠিন, অশুভ সময়ের ভ্রান্ত, বেপথু সমাজের ভুল পথে পা বাড়ানোর বিরুদ্ধে এক বুক উৎকণ্ঠা। এবং তার বিরুদ্ধে সজাগতার আহ্বান। অথচ কী অপূর্ব ব্যঞ্জনায়, রূপকে তা তুলে ধরেছেন কাব্যরসের অনাবিল মোড়কে তা কবিতাগুলো পাঠ না করলে বোঝার উপায় নেই। ভিটেহীনের কান্না, শঙ্কিত চাষার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুধারা কবিকে বিচলিত করে তোলে। তাই সৃষ্টি হয় প্রতিবাদী কবিতা। কবি লিখেন - ‘আজ কবিতা শোনাব না।’ কবির বুকের মাঠ নিঃস্ব হতে থাকে পলে পলে -
আমাদের কষ্টের চাষাবাদ,
জমির দিকে নীরবে তাকিয়ে আছি
চাষির মতো...
 
মাটি আর
আগের মতো উর্বর নয়,
প্রতি মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পঙ্গপাল
ফসলের সবুজ ডগায়
স্বপ্নের সোনা রং চুষে খায়।
 
আমরা কিছুই করতে পারি না
দূর থেকে দেখি
নিঃস্ব মাঠের বুক।
(কবিতা - বুকের মাঠ)
তবে সব কবিতাই কিন্তু গ্রন্থনামের সঙ্গে মিলিয়ে ধুলো, মাঠ কিংবা চাষাবাদ নিয়ে নয়। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে কবিতারা। নদীর প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। আসলে কবিকে, কবিমনকে মোহের বাঁধনে বেঁধে রাখে এমন সাধ্য কার আছে ? ঘোরের কবি অভীকও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিচলিত বাস্তবের ক্ষয়িষ্ণু চলমানতায় কবিমনও হয় বিচলিত। তাই জন্ম হয় একাধিক প্রতিবাদী কবিতা - সিস্টেমের বিরুদ্ধে।
গ্রন্থনামের কবিতা ‘ধুলোডাঙার চাষা’তে রূপকে ব্যঞ্জনায় এমনি কিছু সংলাপ বেরিয়ে আসে কবির লেখনী থেকে ...
ভোটফসল পেকে যাবার পর
তোমার হাসিতে আমার হাসি মিশে যায়,
তারপর চোখে চোখ, মুখোমুখি,
উভয়ের হাতে কাঁচি,
আমি ঘাস কাটি, তুমি ফিতা কাটো। ...
ধুলোডাঙায় দেউলে বাতাস
ক্লান্ত দুপুর ঘুমের নেশা,
ভোটগাছের ডালে ঘুঘুপাখি ডাকে।
নদীচোখের পুরোনো ধারায় চোখ ভিজে গেলে
পথে হাঁটি। তুমি নোনা স্বাদের সোহাগ বাটো। ...
আবার কবির চোখে একদিকে যেমন অবক্ষয়ের চিত্র ধরা দেয় স্পষ্ট হয়ে তেমনি নতুন প্রত্যয়ও ধরা দেয় পাশাপাশি। ‘যোদ্ধা’ কবিতায় তাই কবি লিখেন -
পরিবর্তনের সময়
গাছেদের ভেতরে এমনই
ঝড় ওঠে...
বাতাসের মতো প্রিয় বন্ধুও হামলে পড়ে
সারশূন্য পাতার ঘাড়ে...
কোন এক সময় আবার চিত্র বদলে যায়
আকাশের চোখে জল দেখলেই
কোরক থেকে বেরিয়ে আসে
যোদ্ধা।
আসলে কবি অভীককুমার দে নিজেই এক যোদ্ধা। অশুভ থেকে শুভযাত্রার পথে কবিতাকে হাতিয়ার করে, প্রকৃতি আর কাব্যধারার অরূপরতনকে সঙ্গে নিয়ে যে যোদ্ধা জানে শুধু এগিয়ে যেতে, ধরাকে কাব্যসুখে সিক্ত করতে।
পাকা বাঁধাইয়ের ৫১ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন ‘শ্রদ্ধেয় শ্যামল ভট্টাচার্যকে’। কবিতারই মতো নিটোল, নির্মোহ প্রচ্ছদের সৌজন্যে অনিমেষ মাহাতো। সংখ্যায় নগণ্য হলেও কিছু কবিতায় থেকে গেছে কিছু বানান/ছাপার ভুল। পৃষ্ঠাসংখ্যা ছাপা হয়েছে এতটাই ছোট ফন্টে যে দেখতে হলে আতসকাঁচের দরকার হয়। আগরতলার নীহারিকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের প্রথম ব্লার্বে আছে গ্রন্থ ও কবির সম্যক পরিচয় - ‘... কৃষকের লাঙলের ফলায় মাটি গর্ভে ধারণ করে বীজ। বীজ থেকে ভাবী ফসলের সম্ভাবনায় পৃথিবী গেয়ে যায় আগামীর গান। মাটি ও মানুষের এক অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রমের কথাকেই লিপিবদ্ধ করেছেন কবি অভীককুমার দে...।’ সব মিলিয়ে আরোও একটি সুখপাঠ্য কাব্যগ্রন্থ - ‘ধুলোডাঙার চাষা’।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

 

মূল্য - ১৪০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৬২২৩৯৬১৬

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়