Skip to main content

অতিক্রান্ত কালের ক্যানভাসে ‘দেশভাগের নতুন কবিতা’


উপমহাদেশের গত একশো বছরের ইতিহাসে সব থেকে বড় ঘটনা দেশভাগ। পর্যায়ক্রমে একটি দেশের তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার এই ঘটনার কার্যকারণ যেমন বহুধাবিভক্ত তেমনি এর প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশ ও অগণিত দেশবাসীর জীবনে নেমে আসা পরিবর্তনের ফল সংগত কারণেই ভোগ করতে হয় একাধিক প্রজন্মকে। মননে, শিল্পে, সাহিত্যে তাই প্রত্যক্ষে এর রেশ চলতে থাকে পরবর্তী আরোও একশো বছর এবং পরোক্ষে হয়ত অনন্ত কালাবধি।
দেশভাগের উপর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের ধারা স্বভাবতই বয়ে চলেছে আজও। এই ধারায় নতুন সংযোজন কবি আশিস হীরা সম্পাদিত কাব্য সংকলন ‘দেশভাগের নতুন কবিতা’। মোট ১২২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের ১১২ পৃষ্ঠা জুড়ে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ১০৬টি ‘নতুন’ (অপ্রকাশিত) কবিতা। শতাধিক সমকালিক কবির নতুন করে লিখা কবিতার সম্ভার এই সংকলন। প্রথম ব্লার্বে সম্পাদকের ভাষ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে সংকলন প্রকাশের উদ্দেশ্য - ‘সাতচল্লিশ পরবর্তী সাত দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। খণ্ডিত দেশকে সামনে রেখে বাংলা কথাসাহিত্য যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে তার তুলনায় কাব্যসাহিত্যের প্রকাশ ঢের কম। এই অভাব সামান্য হলেও পূরণের লক্ষ্যে শতকবির শত কলমের দেশভাগের এই কবিতা সংকলন।’
রাজনীতিবিদদের কথা ছেড়ে দিলে দেশভাগ মূলত ‘আম জনতা’র জীবনের উপর আচমকা নেমে আসা এক পরিবির্তিত প্রেক্ষাপট। দেশভাগের সম্পূর্ণ বিষয়টিকে সহজ কথায় দুই ভাগে বিন্যস্ত করা যায়। দেশভাগ প্রক্রিয়া, যা সম্পূর্ণই এক রাজনৈতিক ‘খেলা’ এবং স্বেচ্ছা বা বাধ্যতামূলক দেশান্তর, যা মানুষের জীবনযাত্রায় যোগ করেছিল এক অবর্ণনীয় পরিবর্তন। দেশভাগের উপর আজ অবধি লিখা হয়েছে এবং হচ্ছে অগণন রচনা। এর বেশির ভাগ রচনাতেই নানা ভাবে প্রকাশিত হয়েছে দেশভাগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং দেশান্তরীর দুঃখ কষ্টের ছবি। পক্ষান্তরে বাধ্যতামূলক দেশান্তরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বহর অনেকটাই কম।
আলোচ্য গ্রন্থে সম্পাদক আশিস হীরা তুলে এনেছেন সেইসব কবিদের, যাঁরা কলম ধরেছেন দেশভাগের ভিন্ন ভিন্ন অনুভবকে কবিতায় ফুটিয়ে তোলার জন্য। এবং স্বভাবতই শতাধিক কবিতার মধ্যে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রতিবাদও এসেছে সরবে বা নীরবে, সরাসরি বা রূপকে, ব্যঞ্জনায়। এ নিয়ে এবং সংকলন নিয়েও ‘দেশ বিভাজনঃ মনের ভাঙন’ শিরোনামে ভূমিকায় সম্পাদকীয় বয়ানের কিয়দংশ এখানে প্রাসঙ্গিক - ‘আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আগুনের গল্প লিখা দুষ্কর, তার তাপ মিইয়ে এলে তবেই যেন সে গল্প হয়ে ওঠে। তদ্রুপ দেশভাগের অভিঘাত সাহিত্যের অঙ্গনে এসেছে ভাগাভাগির বেশ কিছুকাল পরে। এ সংকলনের সকল কবিই সমকালের। তাঁরা নানা বয়সের। দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কারোরই নেই বললে ধারণা। তবু এক গভীর যন্ত্রণার চারণ লক্ষিত হয় তাঁদের মধ্যে। কারণ তাঁরা বিখণ্ডনে বলি হওয়া মানুষদের দেখেছেন, বলা ভালো আজও দেখে চলেছেন। ...... সুতরাং উত্তরকালে দাঁড়িয়ে অতিক্রান্ত কালের ক্যানভাসে নানা কৌণিক দৃষ্টিতে সংকলনের কবিতাগুলি উপস্থাপিত।’
নানা আঙ্গিকের ভিন্ন ভিন্ন কবিতায় স্বভাবতই উঠে এসেছে দেশভাগের স্থান, কাল, ঘটনা সম্বলিত নানা অনুষঙ্গ। কোথাও আনন্দ-বেদনার স্মৃতি তো কোথাও কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছে তীব্র, তীক্ষ্ণ। ৪ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে আদ্যক্ষর অনুযায়ী কবিনাম তথা কবিতার শিরোনাম সহ বিস্তৃত সূচিপত্র। পরিসরের স্বল্পতায় সবার নামোল্লেখ নিতান্তই অসম্ভব। গ্রন্থশেষে আছে সম্পাদকেরও একটি কবিতা। বিভিন্ন অঞ্চলের নবীন প্রবীণ কবিরা রয়েছেন সংকলনে। গল্পকার আদিমা মজুমদারও কলম ধরেছেন কবিতায়। বেদনা ও প্রতিবাদের পাশাপাশি দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু জীবনের কষ্টযাপনের কথাও এসেছে মুক্তি সরকারের মতো বহু কবিদের কবিতায়।
যদিও অধিকাংশ কবিতায় ভিন্ন আঙ্গিকে সরাসরি উঠে এসেছে দেশভাগের নানা অনুষঙ্গ এবং যদিও বিষয়ভিত্তিক কবিতায় অনাকাঙ্ক্ষিত, তবু কিছু কবিতার অন্তরে মিশে রয়েছে কাব্যময়তার ছোঁয়াও। পঠনশেষে মনে দাগ রেখে যায় বহু কবির কবিতা যার মধ্যে রয়েছেন কবি জয়ন্ত মণ্ডল, বিষ্ণু বালা, বিকাশ সরকার, সত্যবান বিশ্বাস, সসীমকুমার বাড়ৈ, সুব্রত রায়চৌধুরী প্রমুখ কবিরা। সম্পাদক আশিস হীরার কবিতায় উঠে এসেছে দেশভাগের কষ্টস্মৃতি এক ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে। গ্রন্থ জুড়ে একাধিক কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি দাগ কাটে পাঠকমনে -
কত প্রাণ চিৎকার করে বলেছিল
বাঁচতে দাও; দেশ ভাগ, দেশ ত্যাগ নয়। ...
(ভিটেমাটি ছাড়া - অশোককুমার রায়)
 
মাঝেমধ্যে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তবু -
যদিও মাঝখানে কাঁটাতার
এক মৌলবাদী প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে...।
(খুলনা স্টেশন - কুমারেশ চক্রবর্তী)
 
অখণ্ড আকাশের মাঝ বরাবর
সীমান্ত পাঁচিল;
কাঁটাতারে গেঁথে আছে লাশ
ওপারে বসতবাড়ি এপারে দীর্ঘশ্বাস। ...
(আত্মখনন - টুলু সেন)
 
বিপুল বিশ্বে শিকড়বিহীন আমি ভাসমান ফানুস
দেশহীন নামহীন নিষ্ফল আমি এক না-মানুষ।
(আমি এক না-মানুষ - রমেন্দ্রনাথ অধিকারী)
 
... চিন্তামণি ? তিনি বানিয়ে চলেছেন এক অবিনাশী আখা
বানিয়ে চলেছেন এক ক্ষুধাপৃথিবী, সসপ্যানে সেদ্ধ হচ্ছে প্রাণ
মনে পড়ে গোয়ালন্দে ভেসে যাওয়া তাঁর বাবার সাম্পান ...।
(চিন্তামণি - বিকাশ সরকার)
 
দেশভাগের উপর প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদে নদী-নৌকোর উপস্থিতি প্রাসঙ্গিক এবং অবশ্যম্ভাবী। মলয় মণ্ডলের আলোকচিত্রসম্বলিত প্রচ্ছদও তাই মানানসই। গ্রন্থটি সম্পাদক উৎসর্গ করেছেন ‘মানসী’কে। অক্ষর, শব্দবিন্যাস যথাযথ হলেও ভেতরের পৃষ্ঠার ছাপার ছাপ এসেছে উলটো পৃষ্ঠায়। কলকাতার গাঙচিল-এর অণিমা বিশ্বাস প্রকাশিত গ্রন্থে কয়েকটির বাইরে বানান ভুল নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে এমন একটি বৃহৎ সংকলন প্রকাশের দায়বদ্ধতা ও গরজ পুরোটাই উঠে আসে অনুভবে। সম্পাদক আশিস হীরার শ্রম সর্বাংশেই সার্থক।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘দেশভাগের নতুন কবিতা’
সম্পাদক - আশিস হীরা
মূল্য - ৩০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩২৯৯২৫৩০

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...