Skip to main content

আটপৌরে অবয়বে নান্দনিক - ‘সম্পর্ক’

‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। জীব ও জড়ের প্রকৃত সৌন্দর্য বাহ্যিক আড়ম্বর অবিহনেই প্রগাঢ় রূপে পরিস্ফুট হয়। সম্প্রতি বিত্তবান মানুষের বিলাসী জীবনযাপনে বাহ্যিক প্রসাধনের বিশ্বময় বাজার ও প্রতিযোগিতা। তবে এতে করে কতটা বর্ধিত হয় দৈহিক সৌন্দর্য তা বলার ক্ষমতা রাখে একমাত্র দ্রষ্টার চোখ। কিন্তু বলাবলির সূত্র ধরে কিংবা লেখালেখির দৌলতে এটাই প্রতীয়মান যে বিধাতার প্রদেয় সৌন্দর্য বিনা প্রসাধনেই অধিক শোভন।

‘সম্পর্ক’ - বাংলা সাহিত্য সভা, অসম-এর লংকা শাখার মুখপত্র তথা সাহিত্য পত্রিকা। সম্প্রতি গত মার্চে প্রকাশিত হয়েছে এর প্রথম সংখ্যা। অবয়বের দিকে ছিমছাম আটপৌরে হলেও ভাবনাচিন্তায়, বিষয় বৈচিত্র্যে অভিনব নিঃসন্দেহে। মোট ৪৪ পৃষ্ঠার সাদাকালো এই পত্রিকা আলোচনার টেবিলে উঠে আসে উপর্যুক্ত গুণাবলির সূত্র ধরেই। ভেতরের পৃষ্ঠাগুলি ওলটালেই ধরা পড়ে সম্পাদকীয় গরজ ও যত্নের ছাপ। এ অঞ্চলের সাহিত্য চর্চার হাল হকিকত নিয়ে যত্নবান সম্পাদক তাঁর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের শুরুতেই অনেকটা খোলামেলা - ‘গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চল জুড়ে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রটি এখনও সর্বসমক্ষে পুরোপুরি উঠে আসতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে কিছুটা প্রয়াস চালানো হয়েছিল যদিও, অসমের বাইরের উপর নির্ভর করতে গিয়ে সে প্রয়াস রীতিমতো ফলদায়ক হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ত্রিপুরা ও অসমের বরাকভ্যালি কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও ব্রহ্মপুত্র ভ্যালির বাংলা সাহিত্য চর্চা এ যাবৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতরেই সীমাবদ্ধ...।’ খানিক কটু, খানিক অপ্রিয় হলেও এই বক্তব্যের মধ্যে নিহিত আছে বাস্তবতা এবং সারসত্য। সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের বাকি অংশটুকু বাংলা সাহিত্য সভা, অসম ও ভাষা সাহিত্যের বর্তমান নিয়েই।

গোটা পত্রিকায় সন্নিবিষ্ট রয়েছে ১টি প্রবন্ধ, ১টি সাক্ষাৎকার, দু’টি ‘রিপোর্টাজ’, ৪টি গল্প - তার মধ্যে একটি অনূদিত অণুগল্প, ১১টি কবিতা, একটি স্মৃতিকথা ও পরিবেশ চিন্তা বিষয়ক একটি অণু নিবন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে আয়তনে সীমিত। তবে আয়োজনে নয়। প্রতিটি রচনাই সুচয়িত, সুচিন্তিত, প্রাসঙ্গিক এবং পঠনসুখবিজড়িত।

সাহিত্যিক রতীশ দাসের প্রবন্ধ ‘বাংলা সাহিত্য সভা, অসম সম্পর্কে কিছু চিন্তা-ভাবনা’ অত্যন্ত সুচিন্তিত কিছু ভাবনা, সার্বিক উত্তরণের পথে কিছু প্রস্তাবনার বয়ানে অভিনব ও ব্যতিক্রমী। ‘একটি সাহিত্যমূলক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রধান কাজ হওয়া উচিত লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটি কালি ও কলমের মতো অবিচ্ছেদ্য ‘সম্পর্ক’ গড়ে তোলা।’ আঞ্চলিক পর্যায়ে ভাষা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে করণীয় বহু কথাই উঠে এসেছে লেখকের কলমে।

কবিতা বিভাগে সন্নিবিষ্ট সবগুলি কবিতাই সুচয়িত, সুলিখিত। উল্লেখযোগ্য কবি রতীশ দাস অনূদিত দু’টি কবিতা। প্রথমটি কবি কমলেশ্বর কলিতার ‘বৈশাখ’ শিরোনামে ৬ লাইনের মুগ্ধতাজড়িত অসমিয়া কবিতা। দ্বিতীয়টি বিশিষ্ট মণিপুরি কবি লাইরেনলাকপম শ্রুতিকুমারের কবিতা ‘রায়’। এই পর্বে এ ছাড়াও যাঁদের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁরা হলেন বিশ্বজিৎ দেব, অপূর্ব দেব, রমা মজুমদার, অজামিল, রতীশ দাস, নিত্যানন্দ দাস, বিশ্বজিৎ দেবনাথ, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ও কল্পনা দে।

‘দুই আকাশের মুখোমুখি’ শীর্ষক সাক্ষাৎকার পর্বে সম্পাদক মুখোমুখি হয়েছেন দুই ভাষা সাহিত্যিক শ্রুতিকুমার ও রতীশ দাসের। তিনজনের আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসা নানা রঙের কথোপকথনে অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে সাক্ষাৎকারটি। আঞ্চলিক সাহিত্য সৃষ্টির পথে গরজ আর প্রতিকূলতার বাস্তবিক চিত্র বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে কথোপকথনে।

‘রিপোর্টাজ’ অর্থাৎ প্রতিবেদন। এখানে কল্যাণব্রত ভরদ্বাজের দু’টি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বহু তথ্য। বলা বাহুল্য ‘সুযোগ পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়া’র অভ্যাসে মত্ত প্রতিবেদকের দু’টি রচনাই অঞ্চলভত্তিক। ‘জনজাতীয় সমাজের নানা প্রচলিত গল্প, জনশ্রুতি, জনজাতীয় সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির অজানা দিক কুড়িয়ে আনার চেষ্টা’র ফসল ‘সবুজ প্রশান্ত গ্রাম কান্দুরা’ ও ‘লউ চেকর’ (পাতায় পাতায় বার্তালাপ)। উভয় প্রতিবেদনই অত্যন্ত মূল্যবান। পড়তে পড়তে পাঠক হারিয়ে যাবেন প্রত্যন্ত গ্রাম আর বনমর্মরধ্বনিত অরণ্যের গভীর অন্তরে।

মনোজ কান্তি ধরের গল্প ‘প্রথম প্রেম’-এ লেখক অসাধারণ একটি প্লট তুলে এনেছেন। গল্প এগিয়েছেও তরতরিয়ে তবে শেষটায় খানিক ধন্দে আবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পাঠকের। প্রেম ভালোবাসার আবহে ‘সূর্যমুখী’ গল্পের লেখক মেঘালী দাস। লিখনশৈলীতে সুখপাঠ্য হয়েছে। সুব্রত দত্ত লিখেছেন গল্প ‘নেশা’। বাস্তব প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এমন সরস গল্প লিখা মোটেও সহজ কাজ নয়। তবে গল্পটির শিরোনাম ‘হাতিদাদা’ও হতে পারত। নেপালি সাহিত্যিক ডম্বর দাহাল এর অণুগল্প ‘দেবতা’র যথাযথ অনুবাদ করেছেন নাহিম মজুমদার।

হরিপদ চন্দের স্মৃতিকথা ‘হাল ছাড়ার পথে’ সত্যিকার অর্থেই স্মৃতির সরণি বেয়ে নিয়ে যাবে পাঠককে। সব শেষে মোহিত চন্দ পরিবেশ চিন্তা নিয়ে লিখেছেন ‘বাবুই পাখি’। ভালো বুনোট তবে আরোও বিস্তৃত হতে পারত।

ছাপার কাজ যথাযথ। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজনেই গভীর দায়বদ্ধতার ছাপ স্পষ্ট। এমনকি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও তা বজায় রাখা হয়েছে। পরবর্তী সংখ্যাসমূহে রঙিন প্রচ্ছদ সহ বর্ধিত কলেবর আশা করা যেতেই পারে।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

 

‘সম্পর্ক’
সম্পাদক - মনোজকান্তি ধর             
মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২৫৩৮১৪২

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...