Skip to main content

সুপাঠ্য এবং সহজপাঠ্য গল্প সংকলন ‘পুতুলঘর’


আমাদের সাহিত্য ভুবনে কবিতার যত বই প্রকাশিত হয় তার অনেক কম বই প্রকাশিত হতে দেখা যায় গল্পের উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ সংকলন আরোও কম একই ধারায় চিহ্নায়িত করা যায় পাঠককুলকেও কবিতার তুলনায় গল্প উপন্যাসের পাঠক সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য বলেও অভিহিত করা যায় নিঃসন্দেহে সেই হিসেবে গল্পকারদের গল্প লিখনের এই শ্রমসাধ্য প্রয়াস তার যথাযথ মূল্য পায় না কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁদের চাইতে পাঠকেরই কিন্তু আখেরে ক্ষতি কারণ দেখা যায় যে তুলনামূলকভাবে গল্পকারদের সুদূরপ্রসারী চিন্তাপ্রসূত গল্পগুলি সাধারণ পাঠকের মনকে দোলায়িত করতে সক্ষম কবিতার চাইতেও বেশি
মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম-এর সদ্যপ্রকাশিত গল্প সংকলনপুতুলঘরএমনই একটি গ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে অনতিদীর্ঘ ১৭ টি গল্প যা নিশ্চিতভাবে পাঠকের মনোজগতে ভাবনার আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম গুয়াহাটির ভিকি কনিউনিকেশন অ্যান্ড অয়াসোসিয়েটস থেকে প্রকাশিত ৮৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির ৭৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ১৭ টি ছোটগল্প। প্রতিটি গল্পই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পারিপার্শ্বিক সমাজের বিচিত্র সব ঘটনাক্রম ও চিন্তাধারার নির্মোহ বিশ্লেষণের ফসল। পাঠক কিংবা সমাজের সাধারণ মানুষের চোখে নিতান্তই রোজকার দৃশ্যপটের ভেতরেও যে লুকিয়ে রয়েছে কত অব্যক্ত অনুভব, কত অদেখা অন্তর্নিহিত অনুভূতি তা ধারণারও অতীত। এখানেই গল্পকারের মুনশিয়ানা এবং পাঠশেষে পাঠকের অনবদ্য পাওনা।
‘আত্মকথন’-এ এমনই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন গল্পকার - ‘......আহ্নিক গতিতে অনেক আবর্ত ঘটে যায়। সময়ের সাথে পাঞ্জা লড়ে জীবন এগোয়, এগোয় স্বপ্নের ময়ূরপঙ্খি। ...যাপন বেলায় অসংখ্য জীবনচরিত ঘুরে ফেরে আমাদের আশেপাশে এবং তারাই গল্পগুলির কুশীলব। সামাজিক অবক্ষয়, মানসিক বৈকল্য, জীবনযুদ্ধ, প্রেম-অপ্রেম ইত্যাদি নিয়ে অতি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের কথকতা রয়েছে গল্পগুলোতে।......’ প্রথম ব্লার্বেও এমন কথাই হয়েছে লিপিবদ্ধ।
গ্রন্থের প্রথম গল্প - ‘উত্তরহীন অবস্থিতি’অশরীরীর গোলকধাঁধায় আবর্তিত তিন বান্ধবীর দিনযাপনের সংক্ষিপ্ত যাপনের গল্প। এই গল্পটি কিন্তু অনায়াসে খানিকটা বিস্তৃত হতে পারত। এমন চাহিদা থেকেই যায় শেষটায়। দ্বিতীয় গল্প - ‘কৃষ্ণগহ্বর’। এক অনাথ কিশোরের পরিচর্যাহীন জীবনের এক মর্মন্তুদ কাহিনি। তাদের নিয়েও গল্পকারের ভাবনায় উঠে আসে স্বগত বয়ান - ‘... খরস্রোতা নদীগুলোতে বর্ষার মরশুমে ঘোলাজলের ঢল নামে। সোঁ সোঁ বাতাস, নদীর গর্জন আর ঘনঘোর অন্ধকার মিলেমিশে সন্ধ্যাকালেই গভীর রাতের নীরবতা বয়ে আনে। ... এভাবেই একে একে তারকারা খসে পড়ে কৃষ্ণগহ্বরে। ধরাছোঁয়ার বাইরে জমা পড়ে মহাজাগতিক হিসাবের খাতায়।’
তৃতীয় গল্প - ‘আখড়ার যাপনকথা’। গল্পের ছলে বোষ্টম-বোষ্টুমির আখড়ার সেকাল ও একাল। ক্লাইম্যাক্স নেই তবু অতীত সততই কথা কয়। সরল ছন্দে এগোয় গল্প। চতুর্থ গল্প ‘মনোরমার বসন্ত’। হোলি উৎসবের মুখরিত আবহে গল্পের নায়িকার রঙিন অতীতকে পুনরাবলোকনের সুখপাঠ্য অথচ বেদনাবিধুর গল্প। গল্পের বুনোটে অসামান্য দক্ষতা পরিলক্ষিত হয় এই গল্পে। এর পরের গল্প ‘অনুরাধার সন্ধানে’। একটি ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি। এখানে জমজমাট বুনোট থাকা সত্ত্বেও শেষটায় ঠিক গল্প হয়ে ওঠেনি মনে হল। পাঠক মনে একটা টুইস্ট কাঙ্ক্ষিত হয়ে রয়। পরবর্তী গল্প ‘সিজোফ্রেনিয়া’। গ্রন্থের অন্যতম সেরা গল্প। ব্যতিক্রমী বিষয়ের উপর অতি মাত্রায় সুসজ্জিত বয়ানে লিখিত একটি অনবদ্য গল্প।
সপ্তম গল্প গ্রন্থনাম অনুসারে - ‘পুতুলঘর’। পরিবার পরিজনের জন্য নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেওয়া মঙ্গলকারী নায়িকার স্বপ্নভঙ্গের এক নিদারুণ কাহিনি। গ্রন্থনাম সার্থক হয়েছে যদিও এই গল্পটি কিন্তু অনায়াসে একটি বড় গল্প হতে পারত। শেষটায় খানিক তাড়াহুড়ো লক্ষ করা গেছে। অষ্টম গল্প ‘সম্পাদক সমীপেষু’। একজন লেখকের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে থাকা নেপথ্য কাহিনি এবং সংগ্রাম। অনবদ্য বুনোট যদিও বিস্তৃতির সুযোগ ছিল এখানেও। নবম গল্প ‘সাইকেল’। কোভিড কালের টুকরো টুকরো কথার কথামালা। দশম গল্প ‘মিনতির শাড়ি’। মানুষের নিত্যদিনের ইঁদুর দৌড়ের সুলিখিত গল্প।
মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম-এর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অখ্যাত চরিত্রদের নায়ক-নায়িকা হিসেবে উপস্থাপন এবং গল্পের অসাধারণ বুনোটএই গ্রন্থেও তা লক্ষ করা যায় একশো ভাগ। প্রতিটি গল্পের চমকপ্রদ শুরুটাই ধরে রাখে পাঠককে। কোনও অপ্রাসঙ্গিক ভুমিকা বিবর্জিত গল্পে সরাসরি প্রবেশ ঘটে চরিত্রদের। এবং বলতে গেলে পাঠককে বাধ্য করে এক পঠনে গল্পের শেষে পৌঁছে যেতে। গ্রন্থের পরবর্তী গল্প হচ্ছে ‘কালোর আলো’। কালো মেয়ের চিরন্তন দুঃখশোকের মধ্যেও এক অসাধারণ উত্তরণের গল্প। পরের গল্প ‘পিতৃপরিচয়’। সম্পর্কের সূত্র ধরে এক নারীর জীবনের টানাপোড়েন ও সিদ্ধান্তে অবিচল থাকার এক সুখপাঠ্য গল্প। পাঠক মনে জন্ম দেয় দৃঢ় প্রত্যয়ের। পরবর্তী গল্প ‘ব্যালান্স শীট’। সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরে বসবাসরত এক বৃদ্ধার জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে সামাজিক অব্যবস্থার ক্ষয়িত রূপ ফুটে ওঠে গল্পে। পাওয়া না পাওয়ার দোলাচলে নির্ণীত হয় জীবনের ব্যালান্স শীট। চতুর্দশ গল্প ‘অপত্য স্নেহ’। মাতৃস্নেহ ও মানবিকতার প্রেক্ষাপটে এক চমৎকার গল্প। ব্যতিক্রমী প্লট। পরের গল্প ‘কাগজের নৌকো’। মানুষের জীবনধারার এক ব্যতিক্রমী ক্যানভাস। বিচিত্র ধারার এই গল্পেরও বুনোট অনবদ্য। এর পরের গল্প ‘কাঠের চেয়ার’। ব্যতিক্রমী প্লট এখানেও। বাধ্যবাধকতার জেরে, সমাজ উন্নয়নের তাগিদে অনাকাঙ্ক্ষিত উগ্রপন্থার ভেতরে উপস্থিত কিছু উজ্জ্বল দিক পরিস্ফুট হয়েছে গল্পে। শেষ গল্প ‘কনে দেখা রোদ’। আলো নয় যথার্থই উজ্জ্বল আলো অর্থে ‘রোদ’ শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। আজকালকের মেয়েদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার আবহে লিখা অন্যতম সেরা একটি গল্প যা কিনা প্রথম গল্পেরই মতো আনন্দাশ্রুতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাঠকের দু’চোখ। সব মিলিয়ে ‘পুতুলঘর’ পাঠকের দরবারে এক সুপাঠ্য এবং সহজপাঠ্য গল্প সংকলন।
গ্রন্থের বাঁধাই যথাযথ হলেও ছাপাই স্পষ্ট নয়। তাছাড়া পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে মার্জিন-এর সমতা রক্ষিত হয়নি। সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে আধুনিক বানান। তবে প্রথমদিককার কিছু গল্পে বেশ ক’টি বানান ভুল রয়ে গেছে। এ অঞ্চলে প্রকাশনার ক্ষেত্রটির অপারগতাই এক্ষেত্রে বহুলাংশে দায়ী।
গ্রন্থটি লেখিকা উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘অকালপ্রয়াত ছোড়দা ধূর্জটি চক্রবর্তীর স্মৃতির উদ্দেশে’। নয়নজ্যোতি শর্মার প্রচ্ছদ যথাযথ এবং নয়নশোভন।

- ওমপ্রকাশ

‘পুতুলঘর’
মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৩৯২৬০৬

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়