Skip to main content

অশোক বার্মার দলিলসম কাব্যসংকলন ‘জনপদের মহিলা কবিরা’


একটি কাব্য সংকলন, অথচ কোনও সম্পাদকীয় নেই; এমনটাই ভাবতে ভাবতে অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল সম্পাদকীয়। সচরাচর গ্রন্থের শ্রীগণেশেই থাকে সম্পাদকীয়। এখানে ব্যত্যয় ঘটেছে এই ধারার। সবার কবিতা পৃষ্ঠাবদ্ধ হওয়ার পর ‘আমার কথা’ শিরোনামে কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক অশোক বার্মা স্থান দিয়েছেন সম্পাদকীয়ের। গরজ ও নিবেদন একেই বলে। আজীবন সাহিত্যের এক একনিষ্ঠ পূজারি তথা অসম সরকারের সাহিত্য পেনশন প্রাপ্ত এই সম্পাদক এর আগেও সম্পাদনা করেছেন বহু সংকলনের। তবে এবারের আলোচ্য এই সংকলন ব্যতিক্রমী সংকলন হিসেবে পাঠক তথা সংগ্রাহক সমাজে যে সমাদৃত হবে তা একশো ভাগ নিশ্চিত।
এই সংকলন প্রকাশের গোড়ার কথা জানার অভিপ্রায়ে তাই চোখ বুলানো যাক সম্পাদকীয় রচনার নির্বাচিত কিছু অংশে। সম্পাদক লিখছেন - ‘তারা অসূর্যম্পশ্যা ছিল। ছিল সীমিত বৃত্তের ভিতর... ঘর এবং সংসার সামলানোই ছিল তাদের একমাত্র কাজ। কেউ কেউ তো বলেছেন, নারী সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ... আজ শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। মানসিক ঔদার্য সেই তুলনায় বাড়েনি। দৃষ্টিভঙ্গির, ভাবনা চিন্তার বিশেষ বদল হয়নি। .... তেজস্বিনী মহিলারা জীবন-যুদ্ধে অকুতোভয়ে এসবের প্রতিবাদ করছেন, লড়ছেন এবং নজির সৃষ্টি করছেন। ... সাহিত্য সমাজের দর্পন। দর্পনে প্রতিফলিত হয় সমাজচরিত্র। সেই চেহারা দেখে আঁতকে উঠতে হয়... নারীশক্তির স্ফুরণ কট্টরপন্থীদের ভাবনা চিন্তায় দারুণ আঘাত হানছে। ... এখানে বিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ থেকে এযাবৎ কৃতী মহিলাদের কবিতা নিয়ে করা হয়েছে এই সংকলন। বহু কবিদের কবিতা সংকলনে নানা কারণে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাদের অনুপস্থিতিতে সংকলন সর্বাঙ্গ ভাবে সৃষ্ট হয়নি ...’
সম্পাদকীয় সূত্র ধরেই এ কথা স্পষ্ট যে এই সংকলন বরাকের মহিলা কবিদের কবিতার একটি সংকলন, যেখানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে অশীতিপর কবি থেকে শুরু করে হাল আমলের কবিদের কবিতা। বয়ঃক্রম মেনে এই সংকলনে স্থান দেওয়া হয়েছে মোট ৮৯ জন কবির একাধিক কবিতা। এর মধ্যে ৭৪ জন বাংলা কবিতা রচয়িতার বাইরেও রয়েছেন ২ জন মৈতৈই ভাষার কবি, ১ জন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার কবি, ১ জন অসমিয়া ভাষার কবি এবং ১ জন হিন্দি ভাষার কবিদের বাংলা কবিতা। না, অনুবাদ কবিতা নয়, বাংলা ভাষায় কবিদের সৃষ্ট রচনা। অন্তত এমনটা অনুমান করাই যায়। শুধু একজন মৈতৈ ভাষার কবির কবিতার অনুবাদে সহযোগিতা করেছেন অন্য একজন। এ উদ্যোগ, এই শ্রমের কোনও বিশ্লেষণ হয় না। এ শুধু অনুধাবনের বিষয়। কবি পদ্মা দেবীর দু’টি কবিতা দিয়েই সংকলনের শুভারম্ভ। তাঁর জন্ম ১৯২২ সালে। এরপর আসছে কবি অনুরূপা বিশ্বাসের কবিতা, তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালে। জন্মসাল উল্লেখ থাকা শেষ কবি দীপ্তি দেব। তাঁর জন্ম ১৯৫৪ সালে। এরপরের কবিদের জন্মসালের উল্লেখ নেই।
‘আমার কথা’য় সম্পাদক উল্লেখ করেছেন বহু কবির থেকে কবিতা না পাওয়ার কথা। এ এক কঠিন বাস্তব। তা ছাড়া কিছু কবিরা পরিচিতির অভাবে অনিচ্ছাকৃতভাবেই বাদ পড়ে যান। এ কথাটিও উল্লেখ আছে সম্পাদকীয়তে। তাই সবাইকে নিয়ে আরোও একটি সংস্করণ করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূত্রে বলা যায় যে বরাক উপত্যকায় আজ নবীব প্রজন্মের একাধিক কবিরাও কবিতা লিখছেন গুণগত মানসম্পন্ন। এছাড়া প্রবীন বহু মহিলা কবিও থেকে গেছেন বাইরে। পরবর্তী সংস্করণে নিশ্চিতভাবেই তাঁরা স্থান লাভ করবেন বলে আশা করা যেতেই পারে।  
এ সংখ্যায় যাঁদের কবিতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে তাঁরা হলেন - পদ্মা দেবী, অনুরূপা বিশ্বাস, ছবি গুপ্তা, মায়া গুপ্তা, উমা ভট্টাচার্য, রুচিরা শ্যাম, সুমিত্রা দত্ত, সুদেষ্ণা ভট্টাচার্য, অঞ্জু এন্দো, দীপ্তি চক্রবর্তী, দীপালি (দত্ত) চৌধুরী, মহুয়া চৌধুরী, কস্তুরী হোমচৌধুরী, দীপ্তি দেব, স্মৃতি দত্ত, শ্যামলী কর, দীপালি চৌধুরী, সুস্মিতা মজুমদার, ঝুমুর পাণ্ডে, শেলী দাসচৌধুরী, অপর্ণা দেব, মিতা দাস পুরকায়স্থ, অনুপা বিশ্বাস, লাকি চৌধুরী, জ্যোৎস্না হোসেন চৌধুরী, লুৎফা আরা চৌধুরী, চন্দ্রিমা দত্ত, অনিতা দাস টেন্ডন, কৃষ্ণা চৌধুরী, নিবেদিতা চৌধুরী, আদিমা মজুমদার, ফরিদা পারভীন ‘রুমি’, ঋতা চন্দ, শুক্লা ভট্টাচার্য, স্বাগতা ভট্টাচার্য, লীনা নাথ, যূথিকা দাস, সীমা ঘোষ, দোলনচাঁপা দাসপাল, বর্ণশ্রী বক্সী, তনুশ্রী ঘোষ, জয়শ্রী ভট্টাচার্য, রূপশ্রী চক্রবর্তী, বনশ্রী চৌধুরী, পম্পা ভট্টাচার্য, শিপ্রা শর্না (মহন্ত), মমতা চক্রবর্তী, শ্রাবণী সরকার, বনানী চৌধুরী, মৃদুলা ভট্টাচার্য, চন্দ্রকলা ভট্টাচার্য, কুন্তলা দে, ডা. স্বাতীলেখা রায়, জাহানারা মজুমদার, হাস্‌না আরা শেলী, অরুন্ধতী গুপ্ত, সাহানা কলি চৌধুরী, শিখা রায়, দীপালি মজুমদার, দেবযানী ভট্টাচার্য, কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী ভট্টাচার্য, সোনালী ভট্টাচার্য, স্মৃতি দাস, বসুন্ধরা, প্রীতি দেশমুখ, জয়ন্তী পাল, মমতাজ বড়ভুইয়া, আছিয়া মজুমদার, জয়ন্তী দত্ত, পল্লবী নাথ, শিল্পী ভট্টাচার্য, অঞ্জলি বসু, শিপ্রা দে, সংহিতা দত্ত চৌধুরী (গুপ্ত) এবং সোনামোচা সিংহ, যমুনা লাইরেঞ্জন, মানসী সিনহা, অন্নপূর্ণা দেবী বার্মা, কুসুম কলিতা, সন্তোষী লোহার দাস, সংযোগিতা শিবা, সীমা সিং রায়, তৃষ্ণা কানু, মায়া রাণী যাদব, চন্দা বার্মা, সীমা স্বর্ণকার, বিচিত্রা চৌহান, সঙ্গীতা বার্মা ও সুনীতা মালা।
২৩৯টি কবিতার সমাহার এই সংকলনে বিচিত্র সব বিষয়, অনুভবকে কবিতার শরীরে জীবন্ত করেছেন কবিরা। এক থেকে পাঁচটি পর্যন্ত কবিতা ক্রমান্বয়ে সন্নিবিষ্ট হয়েছে প্রত্যেক কবির। কবি পরিচিতিতে সব কবির উল্লেখ করা হয়নি সম্ভবত প্রাপ্তির অভাবে।   
পেপারব্যাকে ২০২ পৃষ্ঠার এই সম্পাদনা গ্রন্থের অক্ষরবিন্যাস তথা সার্বিক ছাপাই যথাযথ বলা যায়। ছিমছাপ রেখাচিত্র সম্বলিত প্রচ্ছদের সৌজন্যে শিল্পী চন্দ্রিমা শ্যাম। বালার্ক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই সংকলনটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘উৎসাহ, প্রেরণা ও পরামর্শদাতা’ নমিতা নাগ ও জয়া দেবকে।
সব মিলিয়ে ‘জনপদের মহিলা কবিরা’ গ্রন্থটি অতি অবশ্যই এক সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হবে কবি, সাহিত্যিক ও পাঠকের দরবারে এমন প্রত্যয় রাখাই যায়।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

মূল্য - ৩০০ টাকা

যোগাযোগ - ৯৯৫৪৯৬১৭২৯

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়