সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সর্বভারতীয় সিলেটি ফোরাম নিবেদিত সিলেটি ভাষার পত্রিকা ‘জড়র টানে’র ষষ্ঠ সংখ্যা, ১৪৩০ বাংলা, এপ্রিল ২০২৩। এ কথা পুনরোচ্চারণে দ্বিধা নেই যে আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য রচনা সহজ তো নয়ই বরং এক অতি দুরূহ কাজ। এর কারণ বহু। প্রধানত এই আঞ্চলিক ভাষাসমূহ মানুষ জন্মের পর থেকে শুধু মুখেই বলে থাকে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ যদি সিলেটি ভাষার কথাই বলা যায় তাহলে এক্ষেত্রে কাজটা তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই কঠিন। কারণ সিলেটি ভাষার নিজস্ব লিপি ছিল বা থাকা সত্ত্বেও তা আর এখন ব্যবহৃত হয় না। ব্যবহার করলেও কেউ তা বুঝবে না। সুতরাং অখণ্ড বাংলার অন্তর্গত সিলেট অঞ্চলের এই কথ্য ভাষা লিখতে গিয়ে স্বভাবতই মান্য বাংলা হরফে লিখা হয়। সমস্যাটা এখানেই। যে ভাষায় শিক্ষা অর্থাৎ মান্য বাংলা, তার কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে প্রতি মুহূর্তে কলমের ব্যাকরণগত এবং শব্দগত স্খলন হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। এতসব জটিলতা কাটিয়ে আলোচ্য সংখ্যায় কলম ধরেছেন অনেকেই। প্রসবিত হয়েছে উৎকৃষ্ট সাহিত্য। কিন্তু ফাঁকফোকর গলে সেই চ্যুতি যে আসেনি একেবারেই তা কিন্তু নয়। তবে সংখ্যায় তা একেবারেই কম বলা যায়। এসবকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে সরাসরি প্রবেশ করা যেতে পারে পত্রিকার অন্দরে।
সাড়ে ছয় বাই সাড়ে আটের প্যাপারব্যাকে ৬০ পৃষ্ঠার এই পত্রিকায় বিভাগবিন্যাস ব্যতিরেকেই সন্নিবিষ্ট হয়েছে একের পর এক বৈচিত্র্যে ভরপুর রচনার সম্ভার। প্রথমেই বিন্যস্ত সম্পাদকীয়তে ফোরামের সদস্যদের এই সাহিত্য চর্চার গরজের কথা বলা হয়েছে বিশেষ করে। মূলত তাঁদেরই আগ্রহে এই ধারাবাহিক প্রয়াস।
লেখালেখির মঙ্গলাচরণ হয়েছে সুশান্ত মোহন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবলীর সংসার’ অণুগল্পটির মাধ্যমে। এই লেখকের বহু উৎকৃষ্ট লেখা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে পূর্ববর্তী সংখ্যাসমূহে বলেই হয়তো এবারের লেখাটি থেকে প্রত্যাশা ছিল আরোও খানিকটা। গল্পে ক্লাইম্যাক্স নেই যদিও বর্ণনা আছে, আছে বাস্তব। ভাষার উপযোগ দুর্দান্ত। গ্রামের হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ নিয়ে আত্মোপলব্ধির চমৎকার উপস্থাপনা মুক্ত গদ্যের ধাঁচে পূরবী চক্রবর্তীর ‘গ্রামের বিবির্তন’। গ্রামত্যাগ করা গ্রামবাসী প্রজন্মের উদ্দেশে গ্রামের আকুল আবেদন অনন্য ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন এই লেখক - ‘আজকেও যখন সবুজে ভরা প্রান্তর চৌখও পড়ে তখন মনটা মুচড় দিয়া উঠে আর মনওয় যেমন ওউ সবুজ প্রন্তরে দুই হাত মেলিয়া ডাকের আর চিৎকার দিয়া কর - আয়, আয় রে, একটু আমার কাছে আয়। দ্যাখ আইয়া কত আনন্দ পাইবে আমার কাছে আইলে। আমি তো আগের মতোউ আছি রে। পরিবর্তন তো সব তোমরার অইছে। অখনও সময় আছে, আয় আমার কাছে আয়, নায় একদিন আবার সব হারাইবে।’ যৌথ পরিবার নিয়ে মুক্তি ভট্টাচার্য দে’র বাস্তবধর্মী অণুগল্প ‘একান্নবর্তী’ সুখপাঠ্য হয়েছে। ‘অভিশপ্ত ১৮ই ডিসেম্বর’, মধুপা ভট্টাচার্যের এক অশ্রুসজল গদ্যাংশ। এর পর রয়েছে ‘মর্ত্যের শঙ্কর কন্যা মহারানী অহল্যা বাঈ’ এর জীবনের উপর মিষ্টি দেব-এর শ্রদ্ধার্ঘ্যমূলক উৎকৃষ্ট নিবন্ধ।
রামময় ভট্টাচার্য লিখেছেন তাঁর স্বভাবসুলভ দীর্ঘ রম্যরচনা ‘স্বর্গ পুরিত ভুতকাণ্ড’। হাস্যরসাত্মক এই বড়গল্পের পরতে পরতে আছে কৌতুকরস, আছে অভিনবত্ব। ক্ষয়িষ্ণু বর্তমানের উপর বিদ্রুপাত্মক বাক্যবাণ সমৃদ্ধ বিভিন্ন কারিগরি দিককেও সামলেছেন নিপুণ দক্ষতায়। সব মিলিয়ে এক সার্থক রম্যরচনা যা এই সংখ্যার শ্রেষ্ঠ সম্পদ রূপে পরিগণিত হয়েছে।
এরপর রয়েছে করবী ভট্টাচার্য বাগচীর ‘আরোহণ’ শিরোনামে খাণ্ডালা, লোনাভলা হয়ে গুহা ও মন্দিরের জন্য বিখ্যাত কারলা ভ্রমণের এক সংক্ষিপ্ত তথা বয়ানে, বুনোটে সুলিখিত এক ভ্রমণ কাহিনি। প্রসেনজিৎ দাস লিখেছেন ‘মারাঠী সাম্রাজ্য’। নাসিক যাত্রার তথা সেখানে সংক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরির এক অতি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ বৃত্তান্ত। পরবর্তীতে বিস্তৃত জানতে আগ্রহী হতেই পারেন পাঠক। সম্পাদক শমীক চৌধুরী এবার লেখালেখিতেও কলম ধরেছেন। এমনটা অবশ্য চাহিদাও ছিল। তাঁর কলম থেকে এসেছে খুবই পরিপাটি একটি রহস্য গল্প ‘অদ্ভুত’। কিংবা বলা ভালো ‘ভূতের গল্প’। গল্পের নায়ক বৃদ্ধ ‘দাদু’র উপর শারীরিক অত্যাচারের বর্ণনা বড়ই কষ্টকর। নন্দা দেব-এর পশ্চিম এশিয়া ভ্রমণ কাহিনি ঝড়ের বেগে শেষ হয়েছে। জাহাজ যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শেষে দুবাইয়ে স্থিতি। বোরখা পরে মসজিদ দর্শনের ব্যাপারটা ব্যতিক্রমী। আসলে এই কাহিনি যথেষ্ট বড় হতে পারত। তবে পরিসরের কথ ভেবেই হয়তো সংক্ষিপ্ত আকারে লিখা হয়েছে।
‘অদ্বিতীয় নেতাজী’কে নিয়ে সুপর্ণা চক্রবর্তী লিখেছেন নেতাজির দেশপ্রেমের উপর প্রাসঙ্গিক একটি নিবন্ধ। কবিতা বিভাগে রয়েছে অভিজিৎ চক্রবর্তীর শ্লেষাত্মক ‘আচ্ছে দিনের কবিতা’। হিমাংশু দাসের ছয়টি কবিতার কোলাজ এই বিভাগের সম্পদ নিঃসন্দেহে। এছাড়াও রয়েছে আশুতোষ রায়, জয়দীপ নাথ, পঙ্কজ কর, প্রদীপ দাস, জয়ন্ত চৌধুরী ও বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কবিতা। প্রতিটি কবিতাই সুপাঠ্য, সুলিখিত। রাজেশ দাসের ‘সিলেটি বিয়ার অধিবাসোর ধামাইল গান’ স্বরচিত নাকি সংগৃহীত বোঝা গেল না। তবে এই জাতীয় সংগৃহীত গান, গীত, ধামাইল গান তথা সিলেটি রেসিপি সংগ্রহ করে পরবর্তী সংখ্যাসমূহে সন্নিবিষ্ট করলে সংখ্যাটি নিশ্চিত দলিলসম হয়ে উঠবে। বগডুল সুপ্রিয়’র ভিন্নধর্মী কবিতা ব্যতিক্রমী এবং ইঙ্গিতবাহী।
শেষ পাতায় রয়েছে ফোরামের খবরাখবর। সব মিলিয়ে এক জমজমাট সম্ভার যদিও পরবর্তীতে অধিক সদস্যের যোগদানে অধিকতর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ভেতরের কাগজ ও মলাট উন্নত মানের, শ্রীদুর্গা প্রেসের ছাপাই স্পষ্ট। অমর রায়ের অক্ষর বিন্যাসও যথাযথ। আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের সৌজন্যে মানস ভট্টাচার্য। পরবর্তী সংখ্যাসমূহ প্রয়াত সদস্যদের উদ্দেশে উৎসর্গ করার ব্যাপারটাও ভেবে দেখা যেতে পারে।
সিলেটিতে বানানের ব্যাপারটা মুখ্য হতে পারে না যদিও উদ্ধৃতি কিংবা শিরোনামে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। উচ্চারণভিত্তিক বানান সর্বত্র প্রযোজ্য হতে পারে না। অন্যথা শব্দার্থে ভ্রম উৎপন্ন হতে পারে। এ নিয়ে খানিক সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে বইকী। মূল্য এবং যোগাযোগের হদিশ অনুল্লেখিত, টাইটেল ভার্সো পেজে সম্পাদকের নাম অনুল্লেখিত। তা সত্ত্বেও ‘জড়র টানে’ নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস এবং উপস্থাপন।
Comments
Post a Comment