Skip to main content

আপন ঐতিহ্যের তথ্যভিত্তিক ঐতিহাসিক দলিল ‘মনু-বরাকের প্রাচীন জনপ্রবাহ’


মনু-বরাক সূত্র অনুযায়ী ত্রিপুরা রাজ্যের দীর্ঘতম নদী মনু, যার গতিপথ উত্তর ত্রিপুরা জিলা হয়ে এবং আসামের বরাক উপত্যকার সর্ববৃহৎ নদী বরাক যার একটি অংশ কুশিয়ারা বাংলাদেশের সিলেটের মনুমুখে মিলিত হয়েছে এই দুটি নদী তাই মনু-বরাক অর্থে উত্তর ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলকে প্রতিপাদ্য হিসেবে ধরে নিয়ে আলোচ্য গ্রন্থটির নাম মনু-বরাকের প্রাচীন জনপ্রবাহযদিও মূলতঃ স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের বৃহত্তর সিলেটের জনপ্রবাহ, ইতিহাস, লোক পরম্পরা, মানব সম্পদ, সামাজিক বাতাবরণের উপর এক গভীর অধ্যয়নসঞ্জাত এবং গবেষণাকৃত রচনার সম্ভার এই গ্রন্থ অর্থাৎ এক সুচিন্তিত গ্রন্থনাম 
লেখক ত্রিপুরার বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক মন্টু দাস গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট নয়টি অধ্যায় দুটি অধ্যায় ইতিহাসাশ্রিত হলেও বাকি সাতটি অধ্যায় পুরোপুরি গবেষণামূলক আগরতলার উইমেন্স কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ড. নারায়ণ ভট্টাচার্য ভূমিকা হিসেবে গ্রন্থটির প্রসঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সারধর্মী পরিচয় তুলে ধরেছেন তাঁর কথায় ‘…ত্রিপুরায় ইতিহাস গবেষণার একটি ধারা অনেকদিন আগে থেকেই ক্ষীণভাবে প্রবাহিত এবং ধীরে ধীরে সেই ইতিহাসচর্চার প্রবাহ গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে শ্রীযুক্ত মন্টু দাস ও তাঁর রচিতমনু-বরাকের প্রাচীন জনপ্রবাহইতিহাসকে সুসজ্জিত ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে একটি প্রোজ্জ্বল এবং সফল উদ্যোগএখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচয়, সরব ইতিহাসের প্রতিভাশালী কবিদের কথা, সংস্কৃতিচর্চার স্বরূপ উচ্চারিত হয়েছে লেখকের তথ্য, যুক্তি ও মৌলিক সিদ্ধান্তে……
৮৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের ৭৪ পৃষ্ঠা জুড়ে আছে নিবন্ধাদি রচনা সম্ভার লেখকের কথায় গ্রন্থ বিষয়ক কোনও বক্তব্য আমরা পাই না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনেই ব্যয় হয়েছে লেখকের কথা গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়টিই হচ্ছে গ্রন্থের মূল নিবন্ধ - ‘মনু-বরাকের প্রাচীন জনপ্রবাহ : একটি সমীক্ষাসুদূর অতীত থেকে শুরু করে আলোচ্য ভূখণ্ডের বিস্তৃত জনবিন্যাস এবং জীবনধারা নিয়ে রচিত হয়েছে এই মূল্যবান নিবন্ধপূর্ব ভারতের বরাক উপত্যকা, অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের অবিভক্ত শ্রীহট্ট অঞ্চলের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অন্বেষণে যা বেরিয়ে আসে তা হল অস্ট্রিক, ভোট-ব্রহ্ম ও আলপাইন সংমিশ্রণ সেই সাথে খানিকটা ভূমধ্যসাগরীয় রক্ত-প্রবাহ যে মিশে নাই সেটা হলফ করে বলা যায় নাসেখান থেকে শুরু করে লেখক শ্রীহট্টে উদ্ধারকৃত তাম্রপত্রসমূহের বিস্তৃত অনুসন্ধানমূলক ইতিহাসকে খুঁড়ে এনে, গুজরাট আদি স্থান থেকে আসা জনপ্রবাহের বিস্তৃত উল্লেখ সহ মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম থেকে খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়কালকে যেন এক ঐতিহাসিক রচনার আদলে লিপিবদ্ধ করেছেন অপূর্ব লিখনশৈলীতে
পরবর্তী অধ্যায়থাক গান : এক বিলুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক ধারা সাংস্কৃতিক ভূমিখণ্ড শ্রীহট্টের একটি অতি সুন্দর ও শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অবয়বের নামথাক গানবাথাকের গান নৃত্য গীতে অবয়বপ্রাপ্ত তথা বৈষ্ণবীয় ভাবনাসঞ্জাত এই সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা এক সময় সুরমা-বরাক উপত্যকা জুড়ে প্রবল গতিতে প্রবাহিত ছিল এই ধারার গানের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্বরূপ উন্মোচন করতে একশোভাগ সফল হয়েছেন গবেষক-নিবন্ধকার গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়মনসা পাঁচালির কবি রাধামাধব দত্ত সিলেটি ধামাইল গানের স্রষ্টা রাধারমণ দত্তের পিতা রাধামাধব ছিলেন মনসামঙ্গল কাব্যধারার এক শক্তিশালী কবি তাঁর জীবন ও তাঁর সাংস্কৃতিক পরিচয় তথ্যাদির সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে, তাঁর সৃষ্টি সম্বন্ধে যথোপযুক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই নিবন্ধটিও একটি অবশ্যপাঠ্য নিবন্ধ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে পরবর্তী অধ্যায়মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ : জীবন ও সৃষ্টি উত্তর-পূর্ব ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস চর্চার সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ - যাঁর হাত ধরে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার প্রথাগত সূত্রপাত হয়েছিল, যা কিনা কালের যাত্রায় অবিনশ্বর কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত - তাঁর জীবন ও কর্মের বিস্তৃত বিবরণ এই নিবন্ধ নিবন্ধ পাঠে বহু অজানা তথ্য উঠে আসবে পাঠকের সামনে এতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয় পঞ্চম অধ্যায়ভাটেরা তাম্রশাসন : শ্রীহট্ট রাজ্য ও দেবরাজ বংশ ইতিহাস থেকে ছেঁকে আনা এই নিবন্ধটিকে গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধ বললেও অত্যুক্তি হয় না ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মৌলভী বাজার জেলার ভাটেরা গ্রামে উদ্ধারকৃত তাম্রপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী খ্রিস্টিয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে শ্রীহট্ট নামক একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাজ্যের অস্তিত্বের কথা জানা যায় তারই সূত্র ধরে গ্রন্থিত এই নিবন্ধটি এই অঞ্চলের পাঠকের কাছে অজানাকে জানার এক অমূল্য সুযোগ করে দিয়েছে পরবর্তী নিবন্ধেহরিবংশের কবি ভবানন্দকে নিয়ে লেখক সন্নিবিষ্ট করেছেন কবির জীবন ও কৃতি ভবানন্দের জীবনের শ্রেষ্ঠতম কৃতি হচ্ছে মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে খ্যাত বাংলা মৌলিক কাব্যগ্রন্থহরিবংশ কবির নানাবিধ সৃষ্টির গবেষণাকৃত তথ্যের এক সংগ্রহযোগ্য দলিল এই নিবন্ধটি
পরবর্তী দুটি নিবন্ধশত বর্ষের আলোকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধএবংবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা : কিছু স্মৃতি ও ইতিহাসবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবুর রহমানের উপর লিখিত ঐতিহাসিক তথা স্বলব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখা দুটি নিবন্ধই টানটান বর্ণনা ও সাহিত্যরসে সুপাঠ্য গ্রন্থের শেষ নিবন্ধশিতালংসা : এক মিলনপন্থী কবিসত্তা বরাক উপত্যকার সুসন্তান শিতালংসার জীবন ও কবিসত্তা নিয়ে একের পর এক উদ্ধৃতি, গান আদির সমন্বয়ে এক উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ
বস্তুত গ্রন্থের প্রতিটি নিবন্ধই তথ্যাদির উপর লিখিত একাধিক পরস্পরবিরোধী তথ্যের উপস্থিতিতে গ্রন্থকার নিজস্ব ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে এসেছেন এবং এর ফলে প্রতিটি রচনাই হয়ে উঠেছে ইতিহাসভিত্তিক এক একটি মহা মুল্যবান রচনা এখানেই প্রাবন্ধিক মন্টু দাসের কৃতিত্ব পাকা বাঁধাইয়ের সুস্পষ্ট ছাপা ও অক্ষরবিন্যাসসমৃদ্ধ গ্রন্থটির প্রচ্ছদশিল্পী অহীন্দ্র দাস গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক অধ্যাপক ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্যকে গুটিকয় বানান ও ছাপার বিসঙ্গতির বাইরে আগরতলার মৌমিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আলোচ্য গ্রন্থটিকে এক সংগ্রহযোগ্য দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় নির্দ্বিধায়

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২২০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০৫৩৯৬৬৩৯

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...