সারা শরীরে
আঁতুড় ঘরের আগুনের দাগ,
ধাত্রীমা জন্মের পর
নাড়ী কেটে
আগুন সেঁকে পুড়িয়েছেন নাভি,
নাড়ীর সাথে
আগুনের যোগ আজন্ম,
আজন্ম আগুন ক’জনই বা ধরে রাখে,
যারা ধরে রাখে
সারা শরীরে ছড়ায় -
তারা অবাঞ্ছিত আগুনে পোড়ে না।
গ্রন্থনামের শিরোনামেই আছে গ্রন্থের প্রথম কবিতা - যা পুরোটাই তুলে দেওয়া হল। পুরোটাই - কারণ এই প্রথম কবিতাটিই যেন আলোচ্য গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি কবিতার সুনির্দিষ্ট পরিচায়ক। এভাবেই স্বল্প কথায় কবি জারিত করেছেন গভীর চিন্তাপ্রসূত কিছু অমোঘ পঙক্তি। স্পষ্টতই চিহ্নায়িত করা যায় কবিতাগুলোর দুটি ভাগ। প্রথমাংশ - ঘটনা, অনুষঙ্গ বা রূপক এবং শেষাংশ - তার ভাব, বিশ্লেষণ, সমাধান, সিদ্ধান্ত।
কবি নিবারণ নাথের কাব্যগ্রন্থ - ‘দাগ’। ৬৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থের ৫৬ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৬৮টি কবিতা। প্রতি পৃষ্ঠায় এক বা একাধিক সম্পূর্ণ কবিতা। চার পঙক্তির কবিতাও যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পৃষ্ঠাজোড়া কবিতা। নান্দনিক বর্ণ সংস্থাপনের কথাটি প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো। ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ শিরোনামে গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন - বিশিষ্ট সাহিত্যিক হৃষিকেশ নাথ। গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের এক সম্পূর্ণ পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল শব্দবিন্যাসে। নাটক এবং গীতিকবিতা লিখায় গ্রন্থকারের পারদর্শিতার বিষয়ে বিশদ জানা যায় এই ‘ভূমিকা’ থেকে। গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট কিছু কবিতার বিশেষ বিশেষ পংক্তি নিয়েও কাটাছেঁড়া করেছেন ভূমিকাকার।
গ্রন্থ জুড়ে যেন কোথাও এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ের কথা উঠে এসেছে কবির কবিতায়। কবির ভাবনায় তাই ‘খাস জমি জুড়ে কেবল নিঃশ্বাসের চাষ, ফসল নেই। স্বভূমে চেনা ছন্দে এখন ঢাকের বোল বাজে’। এই রহস্যময় সময়ের ঘটমান ঘটনাবলির পরিমাপ যেখানে খালি চোখে করা যায় না সেখানেই যেন কবিতার মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। কবিতায় তাই বার বার উঠে এসেছে প্রবহমান সময়ের কথা, প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপের কথা। চলমানতার প্রতীক নদীর অনুষঙ্গ স্বভাবতই এসেছে একাধিক কবিতায়। নদীর চলমানতা যেন কবিকে ভাববিহ্বল করে তোলে প্রায়শ। যেমন, কবিতা - নদী সভ্যতা, অনুভব, দহন, ভাঙন, অভিন্ন হৃদয়, জীবিকা, প্রত্ন, সাঁতার, জ্যোৎস্না রাতে চন্দ্রতালে, আঘাত ফিরিয়ে দাও, স্বরলিপি, ক্যাকটাস সময়, একলা সময় ইত্যাদি। একই আবহে হাওয়ায় হাওয়ায় প্রবহমান পাখির অনুষঙ্গও এসেছে বারকয়েক। উল্লেখ্য, কবিতা - ফলন, চড়ুই পাখি, শীত বসন্ত, ভাঙন, হাওয়া, সময় - ১, পাখিরা বিপন্ন হলে, চুপ থাকলেও, সে যায়, সুখ শয্যা ইত্যাদি। অনুষঙ্গে একাধিক বার এসেছে আগুনও। যে আগুন কখনও পুড়িয়ে দেয় মলিনতা, কখনও ভস্ম করে দেয় স্বাধীনতা।
‘সময় - ৩’ শীর্ষক কবিতার পর ‘সময়
- ১’ এসেছে গ্রন্থে। তবে সময় - ২ আসেনি। তবু সময় এসেছে গোটা গ্রন্থ জুড়ে। সময়েরই
দর্পণ বলা যায় আলোচ্য গ্রন্থটি। কিছু কবিতা, কিছু পঙক্তি পাঠক মনে উদ্রেক করে
বিস্ময়। কবি সমকালকে ধরে রেখেছেন বিচিত্র সব চিত্রকল্পে -
পাড়ার নবীন কিশোর/ সময়ের চিত্রপট এঁকে/ সীমাহীন উল্লাসে সোনা রোদে হাঁটে/ মাটির দিকে তাকানোর জো নেই/
... পাড়ার নবীন কিশোর/ সে নিজে জানে না/ তার মা বাপ/ কত হৃদয় দিয়ে/ চারুকারু ধরে রেখেছেন/ মাটির বুকে। (কবিতা - চিত্রপট)
মা রোজই/ একখানা আয়না ভাঙতেন/ অতি সংগোপনে/ ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা পাপ/ তাই বাবা রোজই/ একখানা আয়না কিনে আনতেন/
... বড় হয়ে বুঝতে পারলাম/ আয়নায় কেবল নিজেরই মুখ/ অবিকল দেখা যায়। (কবিতা - আয়না)
আগুন দহন জানে/ সময়ের সাথে হাতে হাত রেখে/ জুম পোড়ে/ পোড়া গন্ধে/ শুভ্র নীল আকাশে/ জুমিয়ারা চাঁদ দেখে। (কবিতা - জুম)
শেষে সার কথার এক কবিতার অংশবিশেষ - ... এই বাড়িতে থাকেন এক ডাক্তার/ রোগীরা এলে/ তার চোখ ও পেট দেখেন/ পরামর্শ দেন/ দু’বেলা ভাত খেতে/ ও ভারতীয় গণতন্ত্র চর্চা করতে/ রোগীরা বাড়িতে যেতে যেতে ভাবেন/ ভাত ও গণচন্ত্র/ গণতন্ত্র ও ভাত/ চারিদিকে কেবল/ খাণ্ডব বনের আগুন/ গণচন্ত্র ও ভাতের পোড়া গন্ধ। (কবিতা - ভাত ও গণতন্ত্র)।
এভাবেই একের পর এক প্রতীকী কবিতার ভিড়ে ঋদ্ধ হয়েছে কাব্যগ্রন্থ। যা পড়তে হয়, না পড়লে অবরুদ্ধ থেকে যায় অন্দর-মহল।
পাকা বাঁধাইয়ে ও স্পষ্ট ছাপা তথা অক্ষর বিন্যাসে বিন্যস্ত এই গ্রন্থের চমৎকার প্রচ্ছদের সৌজন্যে মিলনকান্তি দত্ত। আগরতলার তিনকাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি কবি নিবারণ নাথ উৎসর্গ করেছেন তাঁর বাবা প্রয়াত কৃষ্ণ নাথ ও মা প্রয়াত প্রমীলা দেবীকে। নগণ্য সংখ্যক বানান ভুল এবং ‘কবিকথা’র অভাবের বাইরে পাঠক মনে গভীর দাগ রেখে যাওয়া সব ঘোর লাগা কবিতার এক অনবদ্য সংকলন - ‘দাগ’।
আঁতুড় ঘরের আগুনের দাগ,
নাড়ী কেটে
আগুন সেঁকে পুড়িয়েছেন নাভি,
আগুনের যোগ আজন্ম,
সারা শরীরে ছড়ায় -
গ্রন্থনামের শিরোনামেই আছে গ্রন্থের প্রথম কবিতা - যা পুরোটাই তুলে দেওয়া হল। পুরোটাই - কারণ এই প্রথম কবিতাটিই যেন আলোচ্য গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি কবিতার সুনির্দিষ্ট পরিচায়ক। এভাবেই স্বল্প কথায় কবি জারিত করেছেন গভীর চিন্তাপ্রসূত কিছু অমোঘ পঙক্তি। স্পষ্টতই চিহ্নায়িত করা যায় কবিতাগুলোর দুটি ভাগ। প্রথমাংশ - ঘটনা, অনুষঙ্গ বা রূপক এবং শেষাংশ - তার ভাব, বিশ্লেষণ, সমাধান, সিদ্ধান্ত।
কবি নিবারণ নাথের কাব্যগ্রন্থ - ‘দাগ’। ৬৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থের ৫৬ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৬৮টি কবিতা। প্রতি পৃষ্ঠায় এক বা একাধিক সম্পূর্ণ কবিতা। চার পঙক্তির কবিতাও যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পৃষ্ঠাজোড়া কবিতা। নান্দনিক বর্ণ সংস্থাপনের কথাটি প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো। ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ শিরোনামে গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন - বিশিষ্ট সাহিত্যিক হৃষিকেশ নাথ। গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের এক সম্পূর্ণ পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল শব্দবিন্যাসে। নাটক এবং গীতিকবিতা লিখায় গ্রন্থকারের পারদর্শিতার বিষয়ে বিশদ জানা যায় এই ‘ভূমিকা’ থেকে। গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট কিছু কবিতার বিশেষ বিশেষ পংক্তি নিয়েও কাটাছেঁড়া করেছেন ভূমিকাকার।
গ্রন্থ জুড়ে যেন কোথাও এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ের কথা উঠে এসেছে কবির কবিতায়। কবির ভাবনায় তাই ‘খাস জমি জুড়ে কেবল নিঃশ্বাসের চাষ, ফসল নেই। স্বভূমে চেনা ছন্দে এখন ঢাকের বোল বাজে’। এই রহস্যময় সময়ের ঘটমান ঘটনাবলির পরিমাপ যেখানে খালি চোখে করা যায় না সেখানেই যেন কবিতার মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। কবিতায় তাই বার বার উঠে এসেছে প্রবহমান সময়ের কথা, প্রকৃতির পরিবর্তিত রূপের কথা। চলমানতার প্রতীক নদীর অনুষঙ্গ স্বভাবতই এসেছে একাধিক কবিতায়। নদীর চলমানতা যেন কবিকে ভাববিহ্বল করে তোলে প্রায়শ। যেমন, কবিতা - নদী সভ্যতা, অনুভব, দহন, ভাঙন, অভিন্ন হৃদয়, জীবিকা, প্রত্ন, সাঁতার, জ্যোৎস্না রাতে চন্দ্রতালে, আঘাত ফিরিয়ে দাও, স্বরলিপি, ক্যাকটাস সময়, একলা সময় ইত্যাদি। একই আবহে হাওয়ায় হাওয়ায় প্রবহমান পাখির অনুষঙ্গও এসেছে বারকয়েক। উল্লেখ্য, কবিতা - ফলন, চড়ুই পাখি, শীত বসন্ত, ভাঙন, হাওয়া, সময় - ১, পাখিরা বিপন্ন হলে, চুপ থাকলেও, সে যায়, সুখ শয্যা ইত্যাদি। অনুষঙ্গে একাধিক বার এসেছে আগুনও। যে আগুন কখনও পুড়িয়ে দেয় মলিনতা, কখনও ভস্ম করে দেয় স্বাধীনতা।
পাড়ার নবীন কিশোর/ সময়ের চিত্রপট এঁকে/ সীমাহীন উল্লাসে সোনা রোদে হাঁটে/ মাটির দিকে তাকানোর জো নেই/
... পাড়ার নবীন কিশোর/ সে নিজে জানে না/ তার মা বাপ/ কত হৃদয় দিয়ে/ চারুকারু ধরে রেখেছেন/ মাটির বুকে। (কবিতা - চিত্রপট)
মা রোজই/ একখানা আয়না ভাঙতেন/ অতি সংগোপনে/ ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা পাপ/ তাই বাবা রোজই/ একখানা আয়না কিনে আনতেন/
... বড় হয়ে বুঝতে পারলাম/ আয়নায় কেবল নিজেরই মুখ/ অবিকল দেখা যায়। (কবিতা - আয়না)
আগুন দহন জানে/ সময়ের সাথে হাতে হাত রেখে/ জুম পোড়ে/ পোড়া গন্ধে/ শুভ্র নীল আকাশে/ জুমিয়ারা চাঁদ দেখে। (কবিতা - জুম)
শেষে সার কথার এক কবিতার অংশবিশেষ - ... এই বাড়িতে থাকেন এক ডাক্তার/ রোগীরা এলে/ তার চোখ ও পেট দেখেন/ পরামর্শ দেন/ দু’বেলা ভাত খেতে/ ও ভারতীয় গণতন্ত্র চর্চা করতে/ রোগীরা বাড়িতে যেতে যেতে ভাবেন/ ভাত ও গণচন্ত্র/ গণতন্ত্র ও ভাত/ চারিদিকে কেবল/ খাণ্ডব বনের আগুন/ গণচন্ত্র ও ভাতের পোড়া গন্ধ। (কবিতা - ভাত ও গণতন্ত্র)।
এভাবেই একের পর এক প্রতীকী কবিতার ভিড়ে ঋদ্ধ হয়েছে কাব্যগ্রন্থ। যা পড়তে হয়, না পড়লে অবরুদ্ধ থেকে যায় অন্দর-মহল।
পাকা বাঁধাইয়ে ও স্পষ্ট ছাপা তথা অক্ষর বিন্যাসে বিন্যস্ত এই গ্রন্থের চমৎকার প্রচ্ছদের সৌজন্যে মিলনকান্তি দত্ত। আগরতলার তিনকাল প্রকাশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি কবি নিবারণ নাথ উৎসর্গ করেছেন তাঁর বাবা প্রয়াত কৃষ্ণ নাথ ও মা প্রয়াত প্রমীলা দেবীকে। নগণ্য সংখ্যক বানান ভুল এবং ‘কবিকথা’র অভাবের বাইরে পাঠক মনে গভীর দাগ রেখে যাওয়া সব ঘোর লাগা কবিতার এক অনবদ্য সংকলন - ‘দাগ’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ২২৫/-
যোগাযোগ - ৯৮৬২৬৭৭৭৫২
যোগাযোগ - ৯৮৬২৬৭৭৭৫২
Comments
Post a Comment