Skip to main content

তোমারই আঁচলে প্রথম জলের দাগ...... প্রেমের কবিতার সংকলন - ‘মনীষা ও তারপর’


মনীষা অর্থে প্রজ্ঞা, প্রতিভা তবে এখানে মনীষা হল কবির মানসী কবি শতদল আচার্যের সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থমনীষা ও তারপর প্রকাশিত হয়েছে কবির ‘প্রিয় সেপ্টেম্বর’-এ। আধুনিক কবিতার ধারায় পুষ্ট এমন এক পরিপাটি, নিটোল প্রেমের কবিতার সমাহার শেষ কবে পড়া হয়েছে তা অজানা প্রেমের কবিতা বরাবরই এক ধোঁয়াশা কবি শতদলও এর ব্যতিক্রম নন কোথাও লাগামহীন আবার কোথাও রহস্যের আবেশ আসলেই প্রেমের কবিতা এমন হয় পাঠককেই বুঝে নিতে হয় সারাংশ সিদ্ধান্তে আসতে হয় নিজের মতো করে
৬৮ পৃষ্ঠার এই সংকলনের ৫৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৫৬টি পরমাণু থেকে পৃষ্ঠা পেরোনো কবিতা। কবিতার ফর্মাটও পালটেছে সঘন। প্রতিটি কবিতাই কোনও এক অদৃশ্য ‘তুমি’কে উদ্দেশ্য করে লিখা - ধরে নেওয়া যেতেই পারে কবির মানসী মনীষাকে। গোটা গ্রন্থ জুড়েই শুধু ‘মনীষা’ ও ‘তারপর’-এর ভাবনা। বস্তুত ৫৬টি কবিতার মধ্যে ৩৬টি কবিতার শিরোনামই শুধু ‘মনীষা’। মনীষা ১, ২, ৩...... এভাবেই এসেছে কবিতার শিরোনাম। আদতেই এক অভিনব চিন্তাধারার ফসল। সবই যেখানে মনীষাকে লিখা সেখানে কবিতার আলাদা শিরোনামের প্রয়োজনই বা কতটুকু। ফলে সংখ্যাগুলোকে পৃষ্ঠাসংখ্যা ভেবে প্রাথমিক ভাবে সূচিপত্রে খানিকটা ধন্দ জাগতে পারে পাঠক মনে। অভিনবত্ব যেমন রয়েছে তেমনি সূচিপত্রে পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ না থাকায় কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীনও হতে পারেন নিমগ্ন পাঠক।
প্রেমের কবিতা পাঠে নিছক প্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। কে, কোন, কবে, কোথায়-এর দ্বন্দ্বে পড়ে কাব্যরস থেকে বঞ্চিত হওয়ার কোনও মানে থাকতে পারে না। এই পর্বে কেমন হল প্রেমের কবিতা তা খানিকটা বিশ্লেষণ করা যাক। একের পর এক কবিতাগুলো পড়লে কারোও মনে পড়তেই পারে কালিদাসের মেঘদূতম। যেন একের পর এক প্রেমপত্র, প্রেমপর্ব। প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে আকুল প্রেমের নিবেদন না, এখানে কোনও দূত নেই। সব কবিতা প্রেমাস্পদকে উদ্দেশ্য করে সরাসরিই লিখা। অনন্য কিছু পঙক্তি, কিছু নমুনা পেশ করা যাক -
তোমার জন্য ডুব সাঁতারে
সকালবেলা কতো খেলা
ঘর বুনেছি, স্বপ্নে স্বপ্নে,
সিটি মার্ট থেকে কফি হাউসে সন্দ্যাবেলা। (কবিতা - আমারই গল্প বলা)
কিংবা -
আমার জীবনে ...
নামল বৃষ্টি, তুমি শুষে নিলে
তোমার আঁচলে প্রথম জলেরই ছাপ।
মনীষা জানি একদিন মিশে যাব
আরচিৎকার করে বলবো, তোমার নাম। (কবিতা - মেঘে মেঘে মন)।
নিখাদ প্রেমের কবিতার পাঠে পাঠে তবু যদি পাঠকের মনে জাগে প্রশ্ন তার উত্তর খুঁজতে গেলে আবৃত হতে হবে যে ধোঁয়াশার তাই বা কেমন ? ভালোবাসারই পথ ধরে কবিতায় খুঁজে নেওয়া যাক তবে সেই ধোঁয়াশা -
দিনের আলোয় ঘুমায় যে শহর,/ আমি সেই শহরের ছেলে।/ কেবল লিখি মনকথা,/ তুমি জানো কি জানি না/ আমি চুপিসারে লিখে যাই/ দিনরাতের অজস্র ব্যথা......(মনীষা - ১১)। কিংবা - ভালোবাসার একটা নিজস্ব সময়/ ভালোবাসার একটা নিজস্ব গল্প/ সব ছিলো তোমার আমার/ এ সময় ছিল ভালোবাসার...... (মনীষা - ৩৪), একলা হলেই তোমার কথা/ শব্দ, গন্ধ সবই ভেসে আসে/... আমার মন সব জানে, সব রাখে মনে। ... (কবিতা - মন জানে সব)। তারই ধারায় কবি লিখেন - কিছু প্রেমপত্র লিখা থেকে যায় মনে,/ এক একটা শব্দ, কতটুকু ভালোবাসা/ জড়ানো রাত জেগে সময় কাটানো/... (মনীষা -৩)।
পরবর্তী পর্বে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের ধোঁয়াশা আরোও গাঢ় হয়ে যায় যখন ‘সানগ্রাফিকসে তোমার রাখা উপহার-/ আর সাথে আদরের চা খেয়ে/ কতদিন পথ হেঁটে হেঁটে,/ দেবদূত পয়েন্ট ছুঁয়ে বাড়ি ফেরা (কবিতা - লিখে মন তোমাকেই) কবি একদিকে লিখেন - এ যেন আজ মনে হয়/ এক নিষিদ্ধ প্রেম/ সব প্রেমই নিষিদ্ধ হয়। (মনীষা - ২) আবার অন্যদিকে লিখেন - এ কাহিনি শুরু আর শেষ/ রাত গভীর হলে, স্মৃতির পাহাড় নামে/ গোপনে গোপন খেলায়/ গোপনে সব শেষ। (কবিতা - গোপন খেলা)। সবই কি তবে শেষ ? উত্তর খোঁজা যাক - আমার মনে কোনোদিন প্রেম ছিলোও না/ ছিলো কেবল সময় যাপন কাল। (কবিতা - আমার মনে কোনোদিন প্রেম ছিলোও না)।
ইতিপূর্বে কবির প্রেম বিষয়ক কবিতার অন্দরমহল ঘেঁটে ঘেঁটে পাঠকের কল্পনায় প্রেমের যে একটি সংজ্ঞা জন্ম নিয়েছিল, ইতি পর্বে এসে যেন শুধু ধোঁয়াশা নয়, অন্ধকারের গর্ভে নিমজ্জিত হয়ে গেল সব। কিন্তু আদপেই তা নয়। এখানেই একজন কবির অন্তরের গভীরতা। এখানেই কবির মুনশিয়ানা। কারণ এর পরেও রয়েছে বহু কবিতা যা পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে কাব্যগ্রন্থের শেষ পঙক্তি পর্যন্ত - যার মধ্যে রয়েছে কবিতা - ‘স্মৃতিময়’, যে কবিতাই হয়তো নির্ণায়ক ভূমিকায় এনে দাঁড় করাবে পাঠককে।
শিলচরের ‘পান্থজন’ থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ছাপাই ও বাঁধাই তথা বর্ণ সংস্থাপন উন্নত মানের। সৌজন্যে ‘শিলচর সানগ্রাফিকস’। কুহেলী দেবরায়ের প্রচ্ছদ মানানসই। শুদ্ধ বানান ও যতিচিহ্নের সংযত ব্যবহার গ্রন্থের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। গ্রন্থের প্রতিটি পঙক্তিই এক একটি কবিতা কিংবা গ্রন্থের শিরোনাম হওয়ার যোগ্য। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর বন্ধুদের। সূচিপত্রের জটিলতার বাইরে গ্রন্থের প্রথম ও শেষে একগাদা সাদা পৃষ্ঠা বিসদৃশ লাগতে পারে তবে সব মিলিয়ে কাব্যিক গুণসম্পন্ন সাহসী প্রেমের কবিতার এই বিরল সংকলন পাঠক মনে ছাপ ফেলবে নিশ্চিত।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫৩৭২৪২৩

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...