Skip to main content

অন্নপূর্ণার দাওয়ায় এখন খসে পড়া পাতার মজলিশ… ‘তৃষ্ণার্ত উপত্যকা থেকে বলছি’


গ্রন্থের প্রথম কবিতাআরশি-কথানিয়েই আলোচনা এগোতে পারে বহুদূর কবি এই কবিতার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট করে দিয়েছেন আত্মপরিচয় সহ তাঁর নিজস্ব কবিতাবিশ্ব তথা আলোচ্য গ্রন্থের নির্যাস, আয়নায় মেলে ধরেছেন আস্ত কবিকে -
আমায় প্রশ্ন করো -
কেন পাহাড় আমার এতো ভালো লাগে……
কেন ক্যাপসিকামের চেয়েও আমার
বকফুল বড়া বেশি প্রিয়
কেন পঁচিশটা বসন্তের সঞ্চয় আমি
একটি মাত্র পঁচিশে বৈশাখে খরচ করে ফেলি
নিজেকে দেউলে করে বারবার কেন
পৃথিবীকে চিনে নিতে অস্থির হই
তরুণ কবি তীর্থঙ্কর চক্রবর্তীর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার্ত উপত্যকা থেকে বলছি’কীসের তৃষ্ণা ? সৃষ্টির তৃষ্ণাকবিতার পরতে পরতে যা সাজিয়ে রেখেছেন কবি। খুঁজে নিতে হবে পাঠকের। কোন এই উপত্যকা ? অবশ্যই কবির নিজস্ব যাপনের অবস্থান। কবির হৃদয়-উপত্যকা। একের পর এক কবিতায় তাই উঠে আসে উনিশের কথা, বাস্তুহারা, দেশহারাদের কথা। উঠে আসে বরাক-কুশিয়ারার কথা, বরাকের বন্যার কথা। উঠে আসে আরোও বহু কথাই। তাই তো কবি তৃষ্ণার্ত। কবিতায় তাই সাজিয়ে রেখেছেন অনিঃশেষ ভালোবাসা, সীমান্ত-ব্যথা, স্বাধীনতার প্রহসন, শেকড়ের কথা, মায়ের কথা আছে কালিকাপ্রসাদ থেকে শনবিলের কথা  
তবে কবিতা পড়ার আগেই ভূমিকার মতো পড়ে নিতে হবে পরিশিষ্ট - যেখানে কবি, সাহিত্যিক রূপরাজ ভট্টাচার্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন কবিতার, পঙক্তির পর পঙক্তির পরিশিষ্টের মাধ্যমে খেই ধরিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থপাঠের ভূমিকায়কবির কথাশিরোনামে কবি লিখছেন - ব্যাকরণ দিয়ে ভাষাকে বাঁধা যায়, ভালোবাসাকে নয় কবিতা আমার সেই ভালোবাসা, যেখানে কোনো জুলুম নেই, সমঝোতা নেই, আর নেই কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট বা প্রাতিষ্ঠানিকতা …… যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই তো তৃষ্ণার্ত ভাবকে ভাষা দেওয়ার অদম্য তাগিদ বা তৃষ্ণা আমৃত্যু হৃদয় উপত্যকাকে তোলপাড় করে…’ সেই তাগিদেই গ্রন্থনামের শিরোনামে লিখা কবিতায় কবি লিখেন - ‘ইতিহাসের পর ইতিহাস লিখে চলেছে বরাক-কুশিয়ারাব্যাকরণ কিংবা নির্দিষ্ট ফরম্যাট নেই বললেও কিছু ছন্দ-কবিতা আলোড়ন তুলবে পাঠক-হৃদয়ে - তার ভাবে, ভাষায়, ছন্দে উল্লেখ্য - মিথ্যাচার, হাইফেন, আইবুড়িটা বাঁচতে জানে, ভাড়াটের প্রশ্ন, চির-অম্লান রবি, দুগগা তুমিও ঘর খোলো ইত্যাদি এই শেষোক্ত কবিতায় একাধারে কবি ছন্দে ছন্দে ঢেলে দিয়েছেন নারী লাঞ্ছনার ব্যথিত চিত্র ও ক্ষোভ ভালোবাসার কবিতায় রয়েছে কিছু অনন্য পঙক্তি -
তুমি অরণ্য রং মেখে
যদি বনান্তে বাঁধো ঘর,
আমি ইশারায় সারা হবো
খুঁড়ে সীমান্তে সরোবর
থাক! স্বপ্নমধুর ভাঁজেই -
এই কৃষ্ণচূড়ার আগুন
থাক্বুক পকেটে বসন্ত
আর চোখের পাতার ফাগুন… (কবিতা - বসন্ত)
সমাজের অনিয়ম, অনাচার, বিপর্যস্ত মানসিকতা কবিকে ভাবায় কবির সৃষ্টিতে জায়গা করে নেয় অতন্দ্র কিছু পঙক্তি স্বাধীনতার প্রহসন উঠে আসে একাধিক কবিতায় বস্তুত স্বাধীনতা - ১ ও ২ শিরোনামেই রয়েছে দুটি কবিতা স্বাধীনতা কবির কাছে কী রূপে ধরা দেয় ? -
স্বদেশ, আভূমি আত্মবিশ্বাসের নাম;
স্বাধীনতা; একটি আকণ্ঠ অন্তর্ঘাত (স্বাধীনতা - ),
বাসি কাপড়ের মতো/ আঁধারের নিকষ আস্তরণ ছেড়ে,/ সৈরিন্ধ্রী পাখিরা যখন/ লাগামবিহীন ঘোড়ার মতো/ আকাশ মাতিয়ে/ সূর্যের বুকে কাবাডি খেলে-/ আজন্মের জড়তার/তর্পণ শেষে আমি,/ জলভরা গণ্ডুষে/ স্বাধীনতার পুনর্জন্ম দেখি …… স্বাধীনতা, তুমি যোজনগন্ধা কস্তুরী কেন নও ? (স্বাধীনতা -)
৭২ পৃষ্ঠার গ্রন্থের ৫৩ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৩৪টি কবিতা স্বভাবতই এর মধ্যে কিছু দীর্ঘ কবিতা তবে ৭-৮ পঙক্তির কবিতাও রয়েছে আঁকা রয়েছে স্বর ও প্রতিস্বরে আঁকা নানাবিধ অনুষঙ্গ দুএকটি ছাপার ভুলের বাইরে নির্ভুল বানান, স্পষ্ট অক্ষর বিন্যাস গ্রন্থের অন্যতম সম্পদ ঢাকার অনার্য পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হার্ড বোর্ড বাঁধাই গ্রন্থের প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে রাহাত অনার্য প্রথম ব্লার্বে প্রকাশকের কথা এবং দ্বিতীয় ব্লার্বে যথারীতি রয়েছে কবির পরিচয়
তীর্থঙ্করের কবিতা সংখ্যা দিয়ে নয়, সৌকর্য দিয়ে পরিমাপ করতে হয় এই ধারায় নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী তাঁর এই কবিতাস্রোত এ স্রোত বয়ে যাবে অবিরত এমন আশা পাঠক মনে জাগ্রত হবে নিশ্চিত - এই গ্রন্থের পাঠশেষে এবং কবির তরফেও এমন কবিতামুখর ইঙ্গিত খুঁজে নেওয়া যায় তাঁর শেষ কবিতার শেষ পঙক্তিতে -
কবিতা, ভাগ্যিস তুমি ছিলে তাই তো
আমি শব্দের গায়ে গন্ধ খুঁজে পাই;
গন্ধও হয় শব্দমুখর সুখ (কবিতা - প্রেম ও প্রতিস্বর)

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

 

মূল্য - ২৫০ টাকা (বাংলাদেশ)
যোগাযোগ - অনুল্লেখিত

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়