Skip to main content

মননশীল শারদ সংখ্যা 'বহ্নিশিখা'


উত্তর পূর্বাঞ্চলে বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস যতটা পুরোনো ততটাই বৈচিত্র্যময়। শুধু ইতিহাস নয়, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর এই ক্ষেত্রে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য যে ত্রিপুরা রাজ্য এতে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ধারে ও ভারে নিশ্চিতই বহু এগিয়ে রয়েছে এ রাজ্যের বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা ও প্রসার। স্বভাবতই সেকাল থেকে একাল অবধি কবি সাহিত্যিক গবেষকদের পাশাপাশি সাহিত্যক্ষেত্রটি ভরন্ত হয়ে আছে পত্র পত্রিকা, পুথি, গ্রন্থ আদি সম্ভারে।
সেই প্রবহমান ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আজও নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে অগণিত সাময়িকী তথা বইপত্তর। সীমান্তবর্তী শহর ধর্মনগর থেকে ও প্রকাশিত হয় একাধিক পত্রপত্রিকা। আছেন বহু কৃতী কবি সাহিত্যিক গবেষক। এই প্রবাহে অন্যতম এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন সাহিত্য পত্রিকা ‘বহ্নিশিখা’। নেই নেই করে ৩৩ বছরে পদার্পণ করেছে এই পত্রিকা। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকার শারদ উৎসব সংখ্যা। সম্পাদক নিভা চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টা মন্টু দাস।
শিল্পী অহীন্দ্র দাসের নজরকাড়া প্রচ্ছদ প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয় পাঠকের। পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামের তালিকাও যথেষ্ট চমকপ্রদ। এখানে মুখ্য উপদেষ্টার বাইরেও উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন হৃষিকেশ নাথ, ড. অমিত চট্টোপাধ্যায়, মিলন কান্তি দত্ত, সেলিম মোস্তাফা, অহীন্দ্র দাস। সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছেন গোপাল চন্দ্র দাস, দিব্যেন্দু নাথ, আলাল উদ্দিন, রতন কান্তি চন্দ, নিবারণ নাথ, ননীগোপাল দেবনাথ - বলাই বাহুল্য এঁদের প্রত্যেকেই একেক জন কৃতি কবি, সাহিত্যিক তথা গবেষক।
সম্পাদকীয়তে ক্রমান্বয়ে এসেছে দুর্গা পূজা, শরৎ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি উৎসব। প্রতিবেদনের শেষে আকারে ক্ষুদ্র ও অন্যান্য ত্রুটির জন্য পাঠকের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি আগাম কামনা করা হয়েছে। সুতরাং আকারগত স্বল্পতা এবং বানানগত ত্রুটি থাকলেও বলা যেতেই পারে যে এসব মুখ্য নয় নিশ্চিত। কারণ ভারে অপেক্ষাকৃত স্বল্পতা থাকলেও ধারে মোটেও কম যায়নি এ সংখ্যা ‘বহ্নিশিখা’। বরং বলা ভালো সাকুল্যে ২৮ পৃষ্ঠার এই পত্রিকার ২২ পৃষ্ঠার মধ্যেই ধরে রাখা হয়েছে এক বিশাল সম্ভার। ঘটনাপ্রবাহে প্রবন্ধ, কবিতা ও আলোচনার পুনর্মুদ্রণ সন্নিবিষ্ট হলেও সবই যেহেতু কবিতাকেন্দ্রিক তাই সংখ্যাটিকে অনায়াসে একটি কাব্যসংখ্যা হিসেবেও চিহ্নায়িত করা যায় বইকী।
প্রথমেই সংখ্যাটিকে এক আলাদা মর্যাদা প্রদান করেছে লেখক, কবি তথা গবেষক মন্টু দাস-এর বিস্তৃত নিবন্ধ ‘ত্রিপুরার বাংলা কবিতা’। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত ত্রিপুরার বাংলা কবিতার পুঙ্খানুপুঙ্খ হাল হকিকত চমৎকারভাবে কালক্রম মেনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই নিবন্ধে। নবীন প্রজন্মের গবেষণায় এক সংক্ষিপ্ত দিক নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এই প্রবন্ধ।
এর পরই শুরু হয়েছে একের পর এক কবিতার সম্ভার। চমকে দেওয়া সব কবিদের নাম। তেমনি অনাবিল মুগ্ধতায় ভরপুর বহু কবিতা। চোখ রাখা যাক কবিদের নামের তালিকায়। নকুল রায় (দুটি কবিতা), সেলিম মোস্তাফা, শতদল আচার্য, জহর দেবনাথ, সুমন পাটারী, সুচিত্রা দাস, মণিকা বড়ুয়া, ধনঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় (আলাদা করা দুটি কবিতা), দিব্যেন্দু নাথ, সুস্মিতা দেবনাথ, মিলন কান্তি দত্ত, নির্মল দেবনাথ, অরিন্দম পৃথিবী, মিঠু মল্লিক বৈদ্য, তড়িৎ রায়চৌধুরী, জ্যোতির্ময় রায়, বিধান চন্দ্র দে, নিরঞ্জন দাস, হৃষিকেশ নাথ, অভিজিৎ চক্রবর্তী, নারায়ণ মোদক, টিংকু রঞ্জন দাস, অরূপ কুমার ভুঁইঞা, অমিত চট্টোপাধ্যায়, রাখাল মজুমদার, সন্তোষ রায়, শান্তনু মজুমদার, পায়েল নাথ, এইচ এস সরোয়ারদী, গোপাল চন্দ্র দাস, সুবল চক্রবর্তী, হারাধন বৈরাগী, কৃপা ঘোষ (মুন), নিভা চৌধুরী, অভীককুমার দে, পরিমল কর্মকার, আলাল উদ্দিন, নিবারণ নাথ, রতন আচার্য এবং সানী ভট্টাচার্য। অর্থাৎ কিনা মোট চল্লিশ জন কবির বিয়াল্লিশটি কবিতা। এর পর এই শারদীয় সংখ্যার উপর আর কোনও কথা হয় না। ত্রিপুরা রাজ্যের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকেও কবিতায় কলম ধরেছেন একাধিক কবিরা।
কিছু পঙক্তি অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়তো -
... শরণার্থীরা সব সময় উঠোন জুড়ে পড়ে থাকে।
মনে রাখে ফেলে আসা ঘরদোর
আধোয়া বাসি কাপড়চোপড়ের মতো
টাল মেরে পড়ে থাকে
অবচেতনের পুকুর-ঘাটে। (কবিতা - হৃদিগান, নকুল রায়)
... ভেবেছ একাই শরৎশশী তুমি
সবাই অন্ধকার অমাবস্যা
বিয়োগ করে দিচ্ছ রক্তবীজ
আমার নিঃশ্বাসে পুড়ছে তোমার... (কবিতা - একদিন বদলে যাবে সব, সুচিত্রা দাস)
... সেদিন বসন্ত পাঠের আড্ডা
কবিরা কফির সাথে
চাঁদ খাবে বলে
চলে গেছে
ভূতের বাগানে। (কবিতা - সেদিন বসন্ত পাঠ, মিলন কান্তি দত্ত)
... কবিতার ছত্রে ছত্রে আমি নগ্ন হব - তুমিও
নষ্ট জানালায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে ভ্রষ্ট চাঁদ।
সূর্যের প্রসব দেখব বলে অনন্তকাল বসে আছি
- আমি এক নষ্ট মানুষ - (কবিতা - নষ্ট মানুষ, হৃষিকেশ নাথ)
এবং এরকম আরোও অনেক...। শেষ পৃষ্ঠায় রয়েছে কবি মন্টু দাসের কাব্যগ্রন্থ ‘গান্ধারী বাঁধন খোল’-এর উপর একটি প্রকাশিত আলোচনার পুনর্মুদ্রণ।
সব মিলিয়ে ছিমছাম কাব্য-বিষয়ক এক মননশীল এবং সম্পূর্ণ শারদ সংখ্যা।
                                                                             বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০৫৩৯৬৬৩৯

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...