হালখাতা উৎসবের দিন গত হয়েছে কবেই। বইয়ের ব্যাবসা যাদের, তাদের বাইরে
অন্য দোকানদারের সঙ্গে বইয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে প্রথমোক্তদের সম্পর্কও শুধু বই
বিকিকিনির মধ্যেই সীমিত। ব্যতিক্রমীদের বাদ দিলে পাতা উলটে দেখার প্রয়োজনীয়তা কিংবা
ইচ্ছে কোনটাই নেই। বই
না হলেও গোটা বছরের জন্য এদের বরাদ্দ আছে এক হালখাতা। আজকাল তার যে কোনও দিন শুরু হয় পথ
চলা, আবার
শেষ পাতায় এসে পৌঁছোয় যে কোনও দিন। পয়লা বৈশাখের সেখানে কোনও তাৎপর্য
নেই আজকাল। ঘরের অন্দরমহলের কথা ধরলে অ্যাভারেজ ব্যবসায়ী
গৃহকর্তার যেখানে এই হাল,
গৃহকর্ত্রীদের তখন সারা দিনের সঙ্গী টিভি ও মোবাইল। সেখানে হাজারো বিনোদের ঢালাও বন্দোবস্ত। এই হাল সবার।
বইয়ের ব্যবসায়ীদের তবে কার সঙ্গে ব্যাবসা ? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। তার উত্তর মিলবে এপাড়া ওপাড়ার বইয়ের দোকানে গেলে। বই বলতে সেখানে মূলত পাঠ্যপুস্তক। ঠেলার নাম বাবাজি। তবে সেখানেও অনলাইন ক্লাস, অনলাইন গ্রুপ ডিসকাশন জাতীয় বইবিহীন শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে এবং রমরমিয়ে চলছেও। তবু আজও, তেতো হলেও ছাত্রছাত্রীদের গিলতেই হয় কিছু বই। অ আ ক খ থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর স্তরের শ্রেনিবদ্ধ বই, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথসের বই, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যালের বই, নির্বাচিত ভাষা সাহিত্যের বই এবং আরোও হাজার বিষয়ের ঢাউস সব বইয়ের তাই বিকিকিনি হয়। এর বাইরে কিছু সাময়িকী, মাসিক পত্রপত্রিকা। এই হল বইবাজার।
অথচ সেই কবেকার কথা। তখন বইয়ের দোকানগুলোকে
বলা হতো লাইব্রেরি। এখন
বুক স্টল। এখানেই
একটা অনর্নিহিত ফারাক বোঝা যায়। পাঠক এই দুটি শব্দের অর্থ খুঁজে দেখুন। প্রথমটিতে ‘পাঠাগার’ অর্থটিও পাবেন। দ্বিতীয়টি নিছক বই কেনাবেচার স্থান। তাই কেউ আর এখন দোকানের নামে ‘লাইব্রেরি’
লেখে না। কে পাঠ করবে ? কেন করবে
? সময় কোথায় ? ঘরে বাইরে কাজ আর কাজ, ছোটাছুটি, বাকিটুকু বিশ্রাম আর অনলাইন বিনোদন। অথচ একটা সময় ছিল যখন দেখা যেত ঠাম্মা,
দিদা, দাদুদেরও রাত জেগে বাংলা বই পড়া। আমাদের স্মৃতিতে সেই চিত্র আজও ভাস্বর।
বঙ্কিম থেকে শরৎ, রবীন্দ্র থেকে জীবনানন্দ। আহা সে কী আনন্দ। বই-ঠেকগুলোতে সগর্বে
বিরাজিত বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ
থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা, মৈত্রেয়ী, দুই
সমরেশ পর্যন্ত। তুলনামূলক বিচারে যাচ্ছি না। এখন অনলাইনেও বই পড়া যায়। তবে সে পথ ক’জন মাড়ান সে নিয়ে সন্দেহ
আছে। চটুল, অর্থহীন, মন মগজ বিগড়ে দেওয়া প্রলোভনমার্কা বিনোদনের মায়াজাল কাটিয়ে বই পড়ার মজা কেউ
আর এখন উপলব্ধি করতে পারেন না।
এই অনলাইন বিনোদনের মাধ্যমে আমাদের চিন্তাশক্তির কতটুকু উন্নতি হচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না তবে এখানে তুলনামূলক বিচারে দেখা যাচ্ছে বই পড়া এগিয়ে রয়েছে অনেকটাই। অনলাইন বিনোদনে একদিকে যেমন চোখের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে তখন মস্তিষ্কের উপরও পড়ছে নিগেটিভ চাপ। অথচ বিজ্ঞান বলছে বই পড়ায় চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি হয় এবং কোনও নিগেটিভিটি এখানে গড়ে ওঠে না। এমনকি উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে বই পড়তে পরামর্শ দেওয়া হয় রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য। ফারাকটা এখানেই।
উপরে নামগুলো লিখতে গিয়ে সমরেশেই যে আটকে গেলাম তা কেন ? দেখা যাচ্ছে মোটামুটি এর পর থেকেই বই পড়ার ট্রেন্ড কমতে কমতে আজ এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আজকের দিনে বাংলা সাহিত্যের নামি লেখক কবিদের নামই অনেকে জানেন না। জুতসই একটা পুরস্কার (আকাদেমি বা জ্ঞানপীঠ জাতীয়) না পাওয়া অবধি উচ্চ মানের কবি সাহিত্যিকদের নাম এক অতি সীমিত পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে। অবস্থা এতটাই করুণ যে পুরস্কার অপ্রাপ্ত উঁচু মানের কবি সাহিত্যিকদেরও এখন ফেসবুক জাতীয় সামাজিক মাধ্যমে এসে নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন করতে হচ্ছে। এটা চিন্তার বিষয়। জনসংখ্যা বাড়ছে, কবি লেখকদের সংখ্যাও বাড়ছে কিন্তু পাঠক কমছে। এক সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। এই চিত্র ভাবাচ্ছে সবাইকে। সাধারণ পাঠক, গ্রন্থ প্রণেতা, সরকার এবং গ্রন্থ বিক্রেতাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ এসেছে।
বিশ্ব সংস্থাগুলিও এমন চিন্তায় চিন্তিত। ফলত এই ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে কিছু চিন্তাধারা, কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগত তরফে। তারই একটি হচ্ছে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব বই দিবসের ঘোষণা ও উদ্যাপন। ২৩ এপ্রিল দিনটি আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতো হলেও, রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্যালেন্ডারে এই তারিখটি নথিবদ্ধ রয়েছে ‘বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে। প্রতিবছর ‘বিশ্ব গ্রন্থ দিবস ও স্বত্ব দিবস’ হিসাবেই পালিত হয় ২৩ এপ্রিল। কবে থেকে এবং কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিশেষ দিনটিকে ? একটু পর্যবেক্ষণ করা যাক।
পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৪০০ বছর।
১৬১৬ সাল। এই তারিখেই প্রয়াত হয়েছিলেন কিংবদন্তি স্প্যানিশ কবি মিগুয়েল দে
সার্ভান্তেজ। আধুনিক স্প্যানিশ সাহিত্যের হাতেখড়ি হয় সার্ভান্তেজের হাত ধরেই।
এমনকি আজও সবচেয়ে জনপ্রিয় স্প্যানিশ লেখকদের তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছেন
সার্ভান্তেজ। কিংবদন্তি এই কবির মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে, আজ থেকে প্রায়
১০০ বছর আগে, ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল দিনটিকে ‘গ্রন্থ দিবস’ হিসাবে উদযাপন করেন তাঁরই ভাবশিষ্য তথা
আরেক জনপ্রিয় স্প্যানিশ কথাকার ভিসেন্ট ক্লাভেল আন্দ্রেজ। তখন অবশ্য গ্রন্থ দিবসের
এই উদ্যাপন শুধুমাত্র সীমিত ছিল স্পেনের বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যপ্রেমী মহলেই।
আন্তর্জাতিক স্তরে তো দূরের কথা, তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয়
স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি এই বিশেষ দিনটিকে। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও সাত দশক।
১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা সংগঠন ‘ইউনেস্কো’-র বৈঠকে ঠিক হয় বছরের একটি বিশেষ দিন পালিত হবে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ দিবস
উপলক্ষে। সার্ভান্তেজের স্মরণে ২৩ এপ্রিল দিনটিকে বই দিবস হিসাবে বেছে নেওয়া হোক,
বৈঠকে আবেদন জানিয়েছিল স্পেন। শেষ পর্যন্ত এই তারিখটিকেই গ্রন্থ
দিবসের স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। কারণ শুধু সার্ভান্তেজ নয়, ২৩
এপ্রিল কিংবদন্তি ইংরেজ নাট্যকার ও কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ারেরও মৃত্যুদিন। পাশাপাশি
এপ্রিলের ২৩ তারিখেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইনকা ডে লা ভেগা, মরিস
ড্রাওন, ম্যানুয়েল মেইয়া সহ একাধিক খ্যাতনামা সাহিত্যিক।
আজকাল মানুষের ভিড়ে, জীবনচর্চা ও
জীবনযাপনের কঠিনতম সময়ে মানবিক চিন্তাচর্চা, মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে। সবাই
যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ছুটে চলেছে এক ভোগসর্বস্ব জীবনচর্চার পথে। হারিয়ে যাওয়ার
পথে মানবিকতা। পরার্থপরতার সুখ আজ ভোকাট্টা হওয়ার পথে। অথচ একদিন ছিল যখন মানুষ
নিজের জন্য যতটা বাঁচত, ততটাই বাঁচত পরের জন্য। পরের ভালোতে নিজেও আনন্দিত হতো। সেইসব
‘ভালো’কে বিশেষ মর্যাদা দিতে এক একটি দিনকে বিশেষ হিসেবে নিয়ে সারা বিশ্বে পালিত
হচ্ছে এরকম নানা ‘দিবস’। তাই তো মা দিবস, বাবা দিবস, কন্যা দিবস, জল দিবস - মায়
পৃথিবী দিবস। একটি দিন তাই ধার্য হল বইয়ের জন্যও - বইকে জনমুখী, পাঠকমুখী করে
তোলার লক্ষ্যে।
বইবিমুখতার থেকে পরিত্রাণ পেতে
সরকারি ও ব্যক্তিগত স্তরে আজকাল আকছার আয়োজিত হচ্ছে বইমেলা। শহর থেকে গ্রামে
গ্রন্থ বিক্রেতারা ছুটছেন বই নিয়ে, বসছেন বিপণি সাজিয়ে। বড় বড় শহরে আয়োজিত এইসব
বইমেলায় ভিড়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর পিছনেও এক ট্র্যাজিক চিত্র। দেখা যায় বইয়ের চেয়ে
খাবার জিনিসের স্টলে বেশি ভিড়। হাতে গোনা কিছু নামি প্রকাশক-বিক্রেতার বাইরে
স্টলগুলি পড়ে থাকে ক্রেতাবিহীন। অথচ বইয়ের ভেতরে না ঢুকলে কী করে বোঝা যাবে কোন
বইয়ের অন্দরে লুকিয়ে রয়েছে কী বিস্ময়, পাঠকবান্ধব চরিত্র আর বিষয় ? শুধুই কি
পুরোনো লেখক কবি আর বেস্ট সেলার নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকবে সময় ?
বইমেলায় ভিড় তো বাড়ছে। কিন্তু গোড়ায় গলদ। প্রথম দিকে বইক্রেতার সংখ্যা নগণ্য থাকায় বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তা ও সরকারের পক্ষ থেকে বইমেলাতে অন্যান্য সামগ্রী, বিশেষ করে খাবার সামগ্রীর স্টল খোলার অনুমতি প্রদান করেন। এবার মেলায় ভিড় তো বাড়ল কিন্তু ভিড় সত্ত্বেও উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে। আজ -
বইমেলা লোকারণ্য, মহা ধুমধাম
লোকজন দেখে শুধু বইয়ের দাম
বই ভাবে আমি সেরা, প্রকাশক - আমি
বিক্রেতা ভাবে - আমি, হাসে বইপ্রেমী।
অগত্যা উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে চিন্তা করা হল ভিন্নতর পথ। সেই সূত্রে বইমেলায় প্রকাশকদের তরফ থেকে ছাড়ের ব্যবস্থার বাইরেও বই কেনাকাটার কুপনের উপর সরকারি স্তরে শুরু হয়েছে সেরা ক্রেতাদের বিশেষ পুরস্কার সহ সম্মানিত করার ব্যবস্থা।
এই যেখানে চিত্র সেখানে আশার আলো কি একেবারেই নেই ? আছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে অনুপাত মিলিয়ে বইক্রেতা, বইপ্রেমীদের সংখ্যাও বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রতিটি বইমেলাতেই আগের বছর অপেক্ষা বেশি বিক্রি হচ্ছে বই। কেনাকাটা বাড়ছে, আর্থিক লেনদেনও বাড়ছে। আগে প্রতিটি বাড়িতে বই-ঠেক দেখা যেত বৈঠকখানায়। মাঝে অন্তর্ধান হয়েছিল সেই চিত্রের। আজকাল অধিকাংশ বাড়ির ড্রয়িংরুমের শোকেসে অন্যান্য সামগ্রীর পাশে আবার ফিরে এসেছে বই। এবং অবাক হতে হয় যে এইসব বইয়ের মধ্যে হাল আমলের বই যেমন রয়েছে তেমনি আগেকার দিনে পঠিত বইও রয়েছে কিছু সংখ্যায়। আছে ইংরেজি, হিন্দি ভাষার সেইসব ঢাউস পাঠ্যপুস্তক এবং গীতা, রামায়ন, মহাভারত, রামকৃষ্ণ কথামৃতও। আছে, তবু সেসব কতটা পঠিত তা জানার কোনো উপায় নেই এবং সন্দেহ থেকে যায় স্বভাবতই। একদিকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার প্রসার এবং অন্যদিকে আন্তর্জালসমৃদ্ধ ইলেকট্রনিক মাধ্যমের উপস্থিতি বই পড়ার সিস্টেমটাকেই বলা যায় পঙ্গু করে দিয়েছে। তবু উৎসবে, পার্বণে বলা যায় জোর করেই, ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই বই উপহার দেওয়ার চল শুরু হয়েছে ফের।
এইসব ক্রান্তিকারীদের আমাদের স্যালুট করতে হয়। তাঁরা প্রণম্য। জোর করে হলেও বই নেড়েচেড়ে দেখার, নতুন বইয়ের মনমাতানো গন্ধ ফের একবার শুঁকে দেখার এবং বই পড়ার সেই ক্রেজ আবার ফিরিয়ে আনার জন্য। বই পড়লে একাধারে যেমন জ্ঞান, চিন্তাশক্তি, রোগমুক্তির সম্ভাবনা বাড়বে তেমনি বাড়বে স্ট্যাটাস। বই পড়ারও যে ক্ষমতা থাকা চাই। শিক্ষা থাকা চাই। আজকের দেখনদারির দিনে সেও কম প্রাপ্তি নয় কি ?
বইয়ের ব্যবসায়ীদের তবে কার সঙ্গে ব্যাবসা ? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। তার উত্তর মিলবে এপাড়া ওপাড়ার বইয়ের দোকানে গেলে। বই বলতে সেখানে মূলত পাঠ্যপুস্তক। ঠেলার নাম বাবাজি। তবে সেখানেও অনলাইন ক্লাস, অনলাইন গ্রুপ ডিসকাশন জাতীয় বইবিহীন শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে এবং রমরমিয়ে চলছেও। তবু আজও, তেতো হলেও ছাত্রছাত্রীদের গিলতেই হয় কিছু বই। অ আ ক খ থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর স্তরের শ্রেনিবদ্ধ বই, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, ম্যাথসের বই, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যালের বই, নির্বাচিত ভাষা সাহিত্যের বই এবং আরোও হাজার বিষয়ের ঢাউস সব বইয়ের তাই বিকিকিনি হয়। এর বাইরে কিছু সাময়িকী, মাসিক পত্রপত্রিকা। এই হল বইবাজার।
এই অনলাইন বিনোদনের মাধ্যমে আমাদের চিন্তাশক্তির কতটুকু উন্নতি হচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না তবে এখানে তুলনামূলক বিচারে দেখা যাচ্ছে বই পড়া এগিয়ে রয়েছে অনেকটাই। অনলাইন বিনোদনে একদিকে যেমন চোখের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে তখন মস্তিষ্কের উপরও পড়ছে নিগেটিভ চাপ। অথচ বিজ্ঞান বলছে বই পড়ায় চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি হয় এবং কোনও নিগেটিভিটি এখানে গড়ে ওঠে না। এমনকি উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে বই পড়তে পরামর্শ দেওয়া হয় রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য। ফারাকটা এখানেই।
উপরে নামগুলো লিখতে গিয়ে সমরেশেই যে আটকে গেলাম তা কেন ? দেখা যাচ্ছে মোটামুটি এর পর থেকেই বই পড়ার ট্রেন্ড কমতে কমতে আজ এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আজকের দিনে বাংলা সাহিত্যের নামি লেখক কবিদের নামই অনেকে জানেন না। জুতসই একটা পুরস্কার (আকাদেমি বা জ্ঞানপীঠ জাতীয়) না পাওয়া অবধি উচ্চ মানের কবি সাহিত্যিকদের নাম এক অতি সীমিত পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে। অবস্থা এতটাই করুণ যে পুরস্কার অপ্রাপ্ত উঁচু মানের কবি সাহিত্যিকদেরও এখন ফেসবুক জাতীয় সামাজিক মাধ্যমে এসে নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন করতে হচ্ছে। এটা চিন্তার বিষয়। জনসংখ্যা বাড়ছে, কবি লেখকদের সংখ্যাও বাড়ছে কিন্তু পাঠক কমছে। এক সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। এই চিত্র ভাবাচ্ছে সবাইকে। সাধারণ পাঠক, গ্রন্থ প্রণেতা, সরকার এবং গ্রন্থ বিক্রেতাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ এসেছে।
বিশ্ব সংস্থাগুলিও এমন চিন্তায় চিন্তিত। ফলত এই ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে কিছু চিন্তাধারা, কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগত তরফে। তারই একটি হচ্ছে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব বই দিবসের ঘোষণা ও উদ্যাপন। ২৩ এপ্রিল দিনটি আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতো হলেও, রাষ্ট্রপুঞ্জের ক্যালেন্ডারে এই তারিখটি নথিবদ্ধ রয়েছে ‘বিশ্ব বই দিবস’ হিসেবে। প্রতিবছর ‘বিশ্ব গ্রন্থ দিবস ও স্বত্ব দিবস’ হিসাবেই পালিত হয় ২৩ এপ্রিল। কবে থেকে এবং কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিশেষ দিনটিকে ? একটু পর্যবেক্ষণ করা যাক।
বইমেলায় ভিড় তো বাড়ছে। কিন্তু গোড়ায় গলদ। প্রথম দিকে বইক্রেতার সংখ্যা নগণ্য থাকায় বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তা ও সরকারের পক্ষ থেকে বইমেলাতে অন্যান্য সামগ্রী, বিশেষ করে খাবার সামগ্রীর স্টল খোলার অনুমতি প্রদান করেন। এবার মেলায় ভিড় তো বাড়ল কিন্তু ভিড় সত্ত্বেও উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে। আজ -
বইমেলা লোকারণ্য, মহা ধুমধাম
লোকজন দেখে শুধু বইয়ের দাম
বই ভাবে আমি সেরা, প্রকাশক - আমি
বিক্রেতা ভাবে - আমি, হাসে বইপ্রেমী।
অগত্যা উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে চিন্তা করা হল ভিন্নতর পথ। সেই সূত্রে বইমেলায় প্রকাশকদের তরফ থেকে ছাড়ের ব্যবস্থার বাইরেও বই কেনাকাটার কুপনের উপর সরকারি স্তরে শুরু হয়েছে সেরা ক্রেতাদের বিশেষ পুরস্কার সহ সম্মানিত করার ব্যবস্থা।
এই যেখানে চিত্র সেখানে আশার আলো কি একেবারেই নেই ? আছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে অনুপাত মিলিয়ে বইক্রেতা, বইপ্রেমীদের সংখ্যাও বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রতিটি বইমেলাতেই আগের বছর অপেক্ষা বেশি বিক্রি হচ্ছে বই। কেনাকাটা বাড়ছে, আর্থিক লেনদেনও বাড়ছে। আগে প্রতিটি বাড়িতে বই-ঠেক দেখা যেত বৈঠকখানায়। মাঝে অন্তর্ধান হয়েছিল সেই চিত্রের। আজকাল অধিকাংশ বাড়ির ড্রয়িংরুমের শোকেসে অন্যান্য সামগ্রীর পাশে আবার ফিরে এসেছে বই। এবং অবাক হতে হয় যে এইসব বইয়ের মধ্যে হাল আমলের বই যেমন রয়েছে তেমনি আগেকার দিনে পঠিত বইও রয়েছে কিছু সংখ্যায়। আছে ইংরেজি, হিন্দি ভাষার সেইসব ঢাউস পাঠ্যপুস্তক এবং গীতা, রামায়ন, মহাভারত, রামকৃষ্ণ কথামৃতও। আছে, তবু সেসব কতটা পঠিত তা জানার কোনো উপায় নেই এবং সন্দেহ থেকে যায় স্বভাবতই। একদিকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার প্রসার এবং অন্যদিকে আন্তর্জালসমৃদ্ধ ইলেকট্রনিক মাধ্যমের উপস্থিতি বই পড়ার সিস্টেমটাকেই বলা যায় পঙ্গু করে দিয়েছে। তবু উৎসবে, পার্বণে বলা যায় জোর করেই, ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই বই উপহার দেওয়ার চল শুরু হয়েছে ফের।
এইসব ক্রান্তিকারীদের আমাদের স্যালুট করতে হয়। তাঁরা প্রণম্য। জোর করে হলেও বই নেড়েচেড়ে দেখার, নতুন বইয়ের মনমাতানো গন্ধ ফের একবার শুঁকে দেখার এবং বই পড়ার সেই ক্রেজ আবার ফিরিয়ে আনার জন্য। বই পড়লে একাধারে যেমন জ্ঞান, চিন্তাশক্তি, রোগমুক্তির সম্ভাবনা বাড়বে তেমনি বাড়বে স্ট্যাটাস। বই পড়ারও যে ক্ষমতা থাকা চাই। শিক্ষা থাকা চাই। আজকের দেখনদারির দিনে সেও কম প্রাপ্তি নয় কি ?
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
(তথ্যসূত্র - অন্তর্জাল)
Comments
Post a Comment