Skip to main content

কবিতায় কোভিডকালের নির্মোহ দ্যোতনা - ‘লকডাউন সময়ের দহনকথা’


প্রভূত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও যেসব কবিরা সচরাচর প্রচারের আড়ালে রয়ে যান কোনও এক অবোধ্য কারণে তাঁদের মধ্যে রত্নদীপ দেব একজন অথচ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অন্যূন চারটি কাব্যগ্রন্থ রত্নদীপের কবিতায় যেন প্রথাগরভাবে ছলকে ওঠে শব্দসুষমার লহর, ঝলসে ওঠে অসহায়, অস্থির সময়ের, অন্যায্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শব্দের স্ফুলিঙ্গ
আলোচ্য গ্রন্থলকডাউন সময়ের দহনকথাও যেন একই ধারায় সরেজমিনে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শীর নির্মোহ জবানবন্দি বিচিত্র সব দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের এক একটি জবানবন্দিতে যেন শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা বিভীষিকাময় ঘটনাটিকে কবি চিরস্থায়ী করে লিপিবদ্ধ করেছেন ইতিহাসের পাতায় কোভিড অতিমারির প্রেক্ষাপটে লকডাউন সময়ের যাপনকালকে সযত্নে রক্ষিত করেছেন কবিতার অমোঘ পঙ্ক্তিতে
সূচনা-ভাষশীর্ষক আত্মকথনে কবি লিখছেন - ‘… অসুখের আক্রমণে কর্মহীন মানুষ, ঘরবন্দি আস্ত একটি দেশ একদিকে অদৃশ্য মারণ ভাইরাস সংক্রমণের ভয়, অন্যদিকে অসহায় বন্দিদশা শোচনীয় অবস্থা দিনমজুরদের প্রত্যেকের মুখে সেঁটে গেছে নাস্ক মাস্কের আড়ালে অভুক্ত আতঙ্ক সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি মুঠোফোনের নোট প্যাড-এ উঠে এল একের পর এক কবিতা আঁচ করেছি, কিছুদিন পূর্বে লেখা কবিতা থেকেও আলাদা হয়ে যাচ্ছে এ পর্বের কবিতা, পালটে যাচ্ছে কবিতার ভাষা-বয়ানএকজন স্থিতধী কবির ভাষা-বয়ান তো সমকালীন ঘটনাবলির আঁচে বদলে যেতে বাধ্য এখানেই তাঁর কবিত্বশক্তির সার্থকতা
বয়নে-বয়ানে বহুস্বরিক উচ্চারণশিরোনামে গ্রন্থান্তর্গত কবিতাসমূহের নিটোল বিশ্লেষণ করেছেন কবি, গল্পকার রূপরাজ ভট্টাচার্য কবিতার শরীর থেকে তুলে এনেছেন দহনকালিক সমাজের নানা অন্ধকার ও অসহনীয় দিকসমূহকে সুনিপুণ পর্যবেক্ষণে কবিতার ধারাকে বিভক্ত করেছেন চারটি বিন্যাসে এখানে সে আলোচনার বিস্তারে না গিয়ে সরাসরি প্রবেশ করা যাক কবিতার অন্দরে কবির ধারণা অনুযায়ী একটি বিচিত্র কাব্য-ধারা এখানে অনুভব করা যায় মাত্র কয়েক পঙ্ক্তির এক একটি কবিতাকেও যেন সুলিখিত গদ্যের মতো ভূমিকা, সারাংশ ও উপসংহার এই তিনটি সুচিন্তিত বিন্যাসে কবি বিন্যস্ত করেছেন উদাহরণ স্বরূপ তাঁর প্রথম কবিতাটিকেই আলোচনায় তুলে ধরা যায় -
গুমোট গরমে মাঝরাস্তায়
নিথর একলা আকাশ - (এটুকু কবিতার ভূমিকা)
 
ঠায় দাঁড়িয়ে দেয়াল ঘেঁষা দুটো বাড়ি,
বাড়ি দুটোর অন্দরে
অলি-গলি, ঘুপচিতে
কত সম্পর্ক, সেতুবন্ধন
এসবই এখন কোয়েরেন্টাইনে,
শহরের প্রতিটি ঘর যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন বাড়িই শুধু - (এটি সারাংশ) এবং
 
সীমাহীন শূন্যতা পাত পাড়ে
শহরের বড় রেস্তোরাঁয় কিংবা
ফাঁকা চা স্টলে … (এটি হল উপসংহার)
প্রায় প্রতিটি কবিতাই এই ধাঁচে লেখা এবং এই দুঃসহ সময়ের দুরন্ত চিত্রায়ণ যেন কবিতাশেষের উপসংহারে দ্যোতনার মাধুর্যে হয়ে উঠেছে জ্বলন্ত ও জীবন্ত প্রকৃত অর্থে প্রতিটি কবিতার উপসংহারগুলিকে নিয়েই রচিত হতে পারে একটি দহনকালের জীবন্ত গাথা কিছু শব্দচমক, কিছু শব্দগুচ্ছ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে -
ফাঁকা চা-স্টল, অভিমানী রেলপথ, দুয়ার আঁটা শহর, পাগলির অভুক্ত আতঙ্ক, শতাব্দীর অন্ধকার, তালাবন্ধ ক্লাসরুম, কোয়ারেন্টাইন…… ইত্যাদি অসংখ্য শব্দাবলির উপসংহার এছাড়াও শব্দের কুহকে জড়িয়ে আছে বহু পঙ্ক্তি, যেমন -
কারা যেন অতর্কিতে অসুখের গায়ে এঁকে দিল ক্ষতচিহ্ন,
উস্কে দিল ছাইয়ের আগুন …,
 
ভালোবাসাহীন অদৃশ্য নৌকোর কাছে
তলিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা
সন্ধ্যারাতে কবিতায় ছলছল করে
গভীর গোপন স্রোত…,
 
চাল সেদ্ধ হয়ে এসেছে,
ফোড়নের গন্ধে ভুবনের চূড়া থেকে
নেমে আসছেন শিবঠাকুর
ভিড় বাড়ছে ত্রাণ শিবিরে…,
 
মাস্কে ঢাকা নাক-মুখ
মুখোশের আড়ালে যে ভাষা
তার বানান এতটাও দুরূহ নয়
ইত্যাদি অসংখ্য ইঙ্গিতবাহী পঙ্ক্তি ও কবিতায় ভরে উঠেছে ৬০ পৃষ্ঠার এই চার বাই আট সাইজের কাব্যগ্রন্থ সেই দুঃসহ সময়ের এক পরিপাটি বয়ান কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকের পথ চলার কথা যেন অনুচ্চারিত রয়ে গেল তবুদহনকথাহলেও কবি ভুলে যাননি -
মহামারিতেও এককাট্টা হয়েছিল/ দেশ-দুনিয়া,/ ঘরবন্দি আস্ত একটা দেশও ছিল/ মানুষের পাশেই,/ তবু, কারা যেন……/ ‘অর্থহীন বিপদসীমার লাল সংকেত…’   
অভূতপূর্ব প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে কবি নিজেই অলংকরণে নিখিল শব্দকর সৃজন গ্রাফিক্স অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস, শিলচর থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে পঞ্চাশটি শিরোনামহীন কবিতা হাতে গোনা কিছু বানান ভুল রয়ে গেলেও ছাপা স্পষ্ট, অক্ষরবিন্যাস ও বাঁধাই যথাযথ কিছু কবিতা বিশেষের মধ্যেই যেন অতি-বিশেষ হয়ে উঠেছে শেষ কবিতায় এসেছে উৎসর্গের কথা কবি এই গ্রন্থটি এভাবেই করেছেন উৎসর্গ -
প্রসারিত হতে থাকা ছায়ায় এখনও খুঁজি দুদণ্ড আশ্রয়বাবা - রথীন্দ্র দেবকে
সব মিলিয়ে দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা, রূপক মিশ্রিত অসংখ্য নির্মোহ শব্দের অনিঃশেষ দহনকথার কাব্যগ্রন্থ - ‘লকডাউন সময়ের দহনকথা

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৮০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি