দিনাবসানে দিকচক্রবালে যে রক্তিম আভা
প্রতিভাত হয়, দিনমানে সম্ভবত সেই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা সুষমামণ্ডিত দৃশ্য। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে একাধারে ঘোর কালো
রাত্রির আড়ালে তলিয়ে যাওয়ার যে বেদনা তাকেও ছাড়িয়ে যায় অস্তমিত সূর্যের অপরূপ রূপমাধুরী। সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতার
ক্ষেত্রে বোধ করি সব থেকে বেশি উৎকর্ষ ফুটে ওঠে বেলাশেষের কবিতাতেই। ব্যতিক্রম নন কবিগুরু থেকে শুরু করে
অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকগণ। দীর্ঘায়িত অতীত আর অনাগত ভবিষ্যতের
অজানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কপোলকল্পনায় গড়ে ওঠে যে ভাবনা, বয়ানে বুনোটে তা পরিস্ফুট
হয় এক ব্যতিক্রমী চমৎকারিত্বে।
বর্ষীয়ান কবি শিখা দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ ‘অবেলার রোদ্দুর’ এমনই এক সাম্প্রতিক উদাহরণ। কবি যেন নিজেকে মেলে ধরেছেন আদ্যোপান্ত। সুখ দুঃখ, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, অনুভব অনুভূতি, আশা আকাঙ্ক্ষা সব উজাড় করে দিয়েছেন। কোথাও যেন এক সুন্দরের আবাহন, অনন্ত প্রতীক্ষা, স্মৃতি রোমন্থন, অতীত-চিন্তা পাশাপাশি বর্ণমালার দুঃখ, প্রেম, প্রকৃতি, নারী জীবন, সমকাল - সবটুকু ধরা দিয়েছে স্তবক জুড়ে কবিতার শরীরে। প্রাসঙ্গিক ভূমিকায় তাই কবি, সম্পাদক নারায়ণ মোদকও লিখছেন - ‘কবি হাঁটছেন সমুদ্রের কাছে যেতে…।’ এই ভবিষ্যতের যাত্রাবৃত্তান্ত আর অতীতকে ফিরে দেখার সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছে এই গ্রন্থ। প্রথম কবিতা ‘অবেলার রোদ্দুর’-এ কবি লিখছেন -
অবেলার রোদ্দুরে কে যেন ডেকে ফিরেছিল
আমি তখন ছায়া ছায়া ঘোর লাগা আবেশে
স্বপ্নের জাল বুনে চলেছি।
হয়তো তোমাকেই খুঁজেছি
পাতাঝরা মরশুমে ধুলার এ ধরণীতে
নাম ধরে কতবার ডেকেছি…
…জীবনের মানে খুঁজে
ফেরা
আমি এক ব্যর্থ মানুষ…।
আসলেই একটি জীবন একটি দিনের মতোই। উলটে বললে একটি আস্ত দিনই যেন একটি আস্ত জীবনের হুবহু এক রেপ্লিকা। একটি বিকেল যেমন বেলাশেষের মনখারাপি বার্তা নিয়ে আসে ঠিক তেমনই জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও আসমানি বিষণ্ণতায় আচ্ছাদিত হয় চিত্ত। আবার নতুন করে জীবনকে ফিরে পাবার আকুল বাসনায় ব্যাকুল হয় মন। এরই আধারে দোলাচল চিত্ত জুড়ে যে আন্দোলন, ধেয়ে আসে দিনশেষের যে বার্তা - সেটুকু নিয়েই এই গ্রন্থ। স্বভাবতই একাধিক কবিতা জুড়ে আছে এক নির্মোহ ফিরে দেখা আর প্রত্যাশার আর্তি। কবিতার শিরোনামেও তাই ফিরে ফিরে আসে রোদ্দুর - ‘অবেলার রোদ্দুর, বিষণ্ণ রোদ্দুর’, ‘বেলাশেষের রোদ্দুর’ ইত্যাদি।
ফিরে দেখার আবহে কবিতায় কবিতায় কবি যেন ঢেলে দিয়েছেন তাঁর যাবতীয় হৃদিকথা। একাধিক পঙ্ক্তি মূর্ত হয়ে উঠেছে এক গভীর আহ্বানে, শব্দ চয়নে -
…পড়ল ঝরে কৃষ্ণচূড়া
অমলতাসের ফুল
পড়ল কোথায় কড়াৎকড় বাজ
হলদে পাখির পালক পড়ল খসে
থাক না পড়ে নিত্যদিনের কাজ। (কবিতা - সময় চক্র)
চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে / চমকে উঠি হঠাৎ কোনো দিনে / ইষ্টি-কুটুম পাখির ডাক শুনে - / চমকে উঠি কলিং বেলের সাথে / আসছে বুঝি অনেক দিন পর / অনেক কাছের মানুষজন কেউ / কেউ আসে না। / টেবিলে জমা ধুলার আস্তরণ / ‘গীতবিতান’ ধুলোয় মাখা আজ / হাত পড়ে না আর কখনো কেন ? / ইচ্ছেগুলো মরেই গেছে কবে - … (কবিতা - চাঁদোয়া)
পাশাপাশি দুটি কবিতা আছে গ্রন্থে। শিরোনাম ‘বৃক্ষপত্র ও মানব
জীবন’ এবং ‘দহনানল’। বিস্ময়করভাবে প্রথমোক্ত কবিতার শেষ
ভাগ ও দ্বিতীয়োক্ত কবিতার প্রথম ভাগ নিয়ে যেন ফুটে উঠেছে গ্রন্থের মূল নির্যাস -
দিনের শেষে দিন চলে যায় রাতের পর দিন -
এরই মাঝে হারায় জীবন, দুঃখ ব্যথায় লীন।
নূপুর বাজে কেবল যেন জীবন পথের তালে
জীবনবেলা শেষ হয়ে যায় দিন শেষের দিনে। (প্রথম কবিতা)
আগুনের লেলিহান শিখায়
জ্বলেপুড়ে খাক হব বলে
বসে আছি নীরব প্রতীক্ষায়
এসো একবার, শুধু একবার জেগে উঠি
মত্ততায় জ্বলে উঠি ক্ষণ পরে নিভে যাব
বলে।
হাউইয়ের মতো জ্বলে উঠি একবার
আলোকিত করে সেই জগৎ সংসার চরাচর
তারপর - নিঃশেষে হয়ে যাব শেষ। (দ্বিতীয় কবিতা)
এমনই সব সুচয়িত কবিতা, গ্রন্থটিকে করে তুলেছে এক পঠনসুখের আকর। ভালো লাগা কিছু কবিতার শিরোনাম - ‘আয়োজন’, ‘শীত’, ‘চৈত্র দিনে’, ‘একটা দিনে’, ‘তোমার স্মৃতি’, ‘কখনো সহসা’ ইত্যাদি।
স্কলার পাবলিকেশন, করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির রঙিন ছবিযুক্ত প্রচ্ছদের সৌজন্যে মধুশ্রী। ছাপা স্পষ্ট যদিও বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। অক্ষর, শব্দ, পঙ্ক্তি বিন্যাস, হার্ড বোর্ড বাঁধাইও যথাযথ। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘আদরের তনয়াদ্বয়কে’। সব মিলিয়ে একাধারে বিষয় বৈচিত্রে ও কাব্যশৈলীর যুগলবন্দিতে এক উল্লেখযোগ্য নিবেদন - ‘অবেলার রোদ্দুর’। পাঠক মনে জন্ম দেয় এক প্রত্যাশা - পরবর্তী প্রয়াসের।
বর্ষীয়ান কবি শিখা দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ ‘অবেলার রোদ্দুর’ এমনই এক সাম্প্রতিক উদাহরণ। কবি যেন নিজেকে মেলে ধরেছেন আদ্যোপান্ত। সুখ দুঃখ, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, অনুভব অনুভূতি, আশা আকাঙ্ক্ষা সব উজাড় করে দিয়েছেন। কোথাও যেন এক সুন্দরের আবাহন, অনন্ত প্রতীক্ষা, স্মৃতি রোমন্থন, অতীত-চিন্তা পাশাপাশি বর্ণমালার দুঃখ, প্রেম, প্রকৃতি, নারী জীবন, সমকাল - সবটুকু ধরা দিয়েছে স্তবক জুড়ে কবিতার শরীরে। প্রাসঙ্গিক ভূমিকায় তাই কবি, সম্পাদক নারায়ণ মোদকও লিখছেন - ‘কবি হাঁটছেন সমুদ্রের কাছে যেতে…।’ এই ভবিষ্যতের যাত্রাবৃত্তান্ত আর অতীতকে ফিরে দেখার সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছে এই গ্রন্থ। প্রথম কবিতা ‘অবেলার রোদ্দুর’-এ কবি লিখছেন -
আমি তখন ছায়া ছায়া ঘোর লাগা আবেশে
স্বপ্নের জাল বুনে চলেছি।
হয়তো তোমাকেই খুঁজেছি
পাতাঝরা মরশুমে ধুলার এ ধরণীতে
নাম ধরে কতবার ডেকেছি…
আমি এক ব্যর্থ মানুষ…।
আসলেই একটি জীবন একটি দিনের মতোই। উলটে বললে একটি আস্ত দিনই যেন একটি আস্ত জীবনের হুবহু এক রেপ্লিকা। একটি বিকেল যেমন বেলাশেষের মনখারাপি বার্তা নিয়ে আসে ঠিক তেমনই জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও আসমানি বিষণ্ণতায় আচ্ছাদিত হয় চিত্ত। আবার নতুন করে জীবনকে ফিরে পাবার আকুল বাসনায় ব্যাকুল হয় মন। এরই আধারে দোলাচল চিত্ত জুড়ে যে আন্দোলন, ধেয়ে আসে দিনশেষের যে বার্তা - সেটুকু নিয়েই এই গ্রন্থ। স্বভাবতই একাধিক কবিতা জুড়ে আছে এক নির্মোহ ফিরে দেখা আর প্রত্যাশার আর্তি। কবিতার শিরোনামেও তাই ফিরে ফিরে আসে রোদ্দুর - ‘অবেলার রোদ্দুর, বিষণ্ণ রোদ্দুর’, ‘বেলাশেষের রোদ্দুর’ ইত্যাদি।
ফিরে দেখার আবহে কবিতায় কবিতায় কবি যেন ঢেলে দিয়েছেন তাঁর যাবতীয় হৃদিকথা। একাধিক পঙ্ক্তি মূর্ত হয়ে উঠেছে এক গভীর আহ্বানে, শব্দ চয়নে -
পড়ল কোথায় কড়াৎকড় বাজ
হলদে পাখির পালক পড়ল খসে
থাক না পড়ে নিত্যদিনের কাজ। (কবিতা - সময় চক্র)
চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে / চমকে উঠি হঠাৎ কোনো দিনে / ইষ্টি-কুটুম পাখির ডাক শুনে - / চমকে উঠি কলিং বেলের সাথে / আসছে বুঝি অনেক দিন পর / অনেক কাছের মানুষজন কেউ / কেউ আসে না। / টেবিলে জমা ধুলার আস্তরণ / ‘গীতবিতান’ ধুলোয় মাখা আজ / হাত পড়ে না আর কখনো কেন ? / ইচ্ছেগুলো মরেই গেছে কবে - … (কবিতা - চাঁদোয়া)
নূপুর বাজে কেবল যেন জীবন পথের তালে
জীবনবেলা শেষ হয়ে যায় দিন শেষের দিনে। (প্রথম কবিতা)
আগুনের লেলিহান শিখায়
জ্বলেপুড়ে খাক হব বলে
বসে আছি নীরব প্রতীক্ষায়
এসো একবার, শুধু একবার জেগে উঠি
হাউইয়ের মতো জ্বলে উঠি একবার
আলোকিত করে সেই জগৎ সংসার চরাচর
তারপর - নিঃশেষে হয়ে যাব শেষ। (দ্বিতীয় কবিতা)
এমনই সব সুচয়িত কবিতা, গ্রন্থটিকে করে তুলেছে এক পঠনসুখের আকর। ভালো লাগা কিছু কবিতার শিরোনাম - ‘আয়োজন’, ‘শীত’, ‘চৈত্র দিনে’, ‘একটা দিনে’, ‘তোমার স্মৃতি’, ‘কখনো সহসা’ ইত্যাদি।
স্কলার পাবলিকেশন, করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির রঙিন ছবিযুক্ত প্রচ্ছদের সৌজন্যে মধুশ্রী। ছাপা স্পষ্ট যদিও বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। অক্ষর, শব্দ, পঙ্ক্তি বিন্যাস, হার্ড বোর্ড বাঁধাইও যথাযথ। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘আদরের তনয়াদ্বয়কে’। সব মিলিয়ে একাধারে বিষয় বৈচিত্রে ও কাব্যশৈলীর যুগলবন্দিতে এক উল্লেখযোগ্য নিবেদন - ‘অবেলার রোদ্দুর’। পাঠক মনে জন্ম দেয় এক প্রত্যাশা - পরবর্তী প্রয়াসের।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৭৫৩৯৩৬১০৭
এতো সুন্দর আলোচনা। আলোচক প্রতিটি কবিতা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন।
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete