Skip to main content

উৎকর্ষ ও নান্দনিকতার সমাহার ‘শামিয়ানা’ - পঞ্চম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা


খোলা আকাশের নীচে যেন তৈরি হচ্ছে একের পর এক শামিয়ানা তার অবারিত অন্দরপথে এসে নিরন্তর জমা হচ্ছে চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রের আলোকচ্ছটা - তত্ত্ব-মেধা-ধীশক্তির নান্দনিক সমাহার এমনই আবহে সম্প্রতি হাতে এল পশ্চিমবঙ্গ সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন তথা আইএসএসএনপ্রাপ্ত পত্রিকাশামিয়ানার পঞ্চম বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা ২০২৩শামিয়ানা’ - সৃজনী ভাবনার গবেষণাগার সম্পাদক শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী।  
পত্রিকা হলেও এ আসলে ২৫৫ পৃষ্ঠার এক বিশাল গ্রন্থ চারপৃষ্ঠাব্যাপী সম্পাদকীয়প্রাককথন’-এ ভিতরগত সম্ভারের এক রূপরেখা টানা হয়েছে সেই হিসেবে এবারের সংখ্যার পরিচিতিটা এমন - ‘পত্রিকার বিষয় ত্রিষ্টুপ। কিন্তু এই পত্রিকা ছন্দবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা নয়। বরং ত্রিষ্টুপ ছন্দে লেখা সেইসব অনবদ্য, অবিনশ্বর সাহিত্যসৃষ্টির অক্ষয়তাকে স্পর্শ করার প্রচেষ্টা এই সংখ্যা। ...পত্রিকার তিনটি মূল ভাগ। প্রথম ভাগে বিশেষ ক্রোড়পত্র - ‘রসতত্ত্ব ফিরে দেখা’প্রথমে অভিলাষা এটাই ছিল যে ‘বীভৎস রস’ নিয়েই গোটা একটা সংখ্যা করব। ...আপাতত অঙ্কুরটুকু থাক এইখানে।’ দ্বিতীয় ভাগে বাংলাভাষার প্রিয় তিন অনবদ্য ও কালজয়ী কবি আলোক সরকার, ভাস্কর চক্রবর্তী ও সুমিতেশ সরকার-এর স্মৃতিতর্পণে শামিল হয়েছেন তাঁদের সহধর্মিণী ও সুমিতেশ সরকারের কন্যা। পত্রিকার তৃতীয় ভাগে রয়েছে একাধিক প্রামাণ্য ও গবেষণাভিত্তিক রচনা এবং গুচ্ছ কবিতা।
রসতত্ত্ব বিষয়ক প্রথম বিভাগের ছয়টি নিবন্ধে রয়েছে শৈলেন সাহার ‘বাংলা নাটকে প্রভাবনীয় রসতত্ত্ব’, সঞ্জয় ঘোষের ‘ব্ল্যাক পেন্টিংস, মাছির ভূত এবং’, বিশ্বজিৎ পাণ্ডার ‘গল্পে বীভৎসতা’, পার্থজিৎ চন্দ-র ‘নাট্যশাস্ত্রে ‘ভাব’ ও কয়েকটি কবিতার মধ্যে ঘোরাফেরা’, অরিন্দম রায়ের ‘বীভৎস মজা’ এবং সায়নদীপ ঘোষের ‘রসত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব’। প্রতিটি নিবন্ধই উপস্থাপনায়, তত্ত্বে মূল্যবান ও রসসিক্ত। পঁচিশটি বাংলা গল্পে বীভৎস রসের প্রয়োগ নিয়ে বিশ্বজিৎ পাণ্ডা ব্যতিক্রমী।
দ্বিতীয় ভাগের উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। কালজয়ী তিন কবির সার্বিক মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছেন তাঁদের সহধর্মিণী ক্রমে বাসবী চক্রবর্তী, মিনু সরকার ও সর্বাণী সরকার এবং কবি সুমিতেশ সরকারের কন্যা সায়োনারা সরকার। এই পর্বটিকে সাক্ষাৎকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও সাক্ষাৎকার গ্রহীতার নামোল্লেখ নেই এবং এই পর্বে এলোমেলো হয়ে গেছে সূচিপত্রে উল্লিখিত পৃষ্ঠাসংখ্যা।
সম্পাদকীয়তে যদিও বলা হয়েছে ‘তৃতীয় বিভাগটি সাধারণ বিভাগ’ কিন্তু মূলত তৃতীয় বিভাগটিই যেন হয়ে উঠেছে অসাধারণ এবং বৈচিত্র্যময়। এই বিভাগটিরও রয়েছে সুচিন্তিত এবং অনবদ্য বিভাগবিন্যাস। চোখ রাখা যাক একে একে। প্রথমেই দিকশূন্যপুর ভাগে রয়েছে ‘পুরো দুই ফর্মা জুড়ে কবি অনুরাধা মহাপাত্রের একগুছ কবিতা’, ‘তরজমা প্রসঙ্গ’ বিভাগে অসমিয়া ভাষার একাধিক কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন জ্যোতির্ময় দাশ। স্বচ্ছ কাব্যিক অনুবাদ যদিও কবিনামে বানানবিভ্রাট রয়ে গেছে। আফ্রিকার কবি খ্রিস্টোফার ওকিবোর পাঁচটি অণুকবিতার ভাষান্তর করেছেন মৌমিতা পাল। কবিতা বিভাগে রয়েছে ৪৩ জন কবির ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের একটি করে সুচয়িত কবিতা। এরপর রয়েছে একটি দীর্ঘ কবিতা, অজয় নাগ-এর ‘ঘষা কাচের আয়নায়’ একই বিভাগনামে। ‘অরূপরতন’ বিভাগে সমুদ্রমন্থনের মতো উঠে এসেছে অমৃতস্বরূপ আনুমানিক আশির দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত ‘একাকী’ পত্রিকার একমাত্র তথা ব্যতিক্রমী সংখ্যার পুনর্মুদ্রণ। এতে রয়েছে একাধিক কবির গুচ্ছকবিতা ও একটি সাক্ষাৎকারভিত্তিক গদ্য। একে একে এসেছে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের ‘সম্পাদক সমীপেষু’, বসন্তকেবিন বিভাগে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কয়েকটি কবিতার অনুষঙ্গে ‘অভিমান’ - একটি পুনর্পাঠ’, টেমার লেন বিভাগে অভিজিৎ সেন-এর বিখ্যাত উপন্যাসের উপর মেরিনা মণ্ডলের বিস্তৃত পর্যালোচনা ‘শ্রীচৈতন্য - আজকের প্রেক্ষিতে, প্রসঙ্গ ‘রাজপাট ধর্মপাট’। শেষপাতে পায়েসের মতো রয়েছে ‘জগাদার গবেষণাপাতা’। এক বিচিত্রধর্মী সংযোজন। মনে করিয়ে দেয় কমলাকান্তকে।
কয়েকটি বানান ও বেশ কয়েকটি ছাপার ভুলের বাইরে এই বিশাল আয়োজন সম্পাদক শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর প্রয়াস ও শ্রমের এক সার্থক ফল। পত্রিকার পাতায় প্রাসঙ্গিক একাধিক ছবি সংখ্যাটিকে করে তুলেছে অধিক আকর্ষণীয়। প্রকৃতার্থে পরিসর বিস্তৃত হলে প্রতিটি বিভাগ তথা রচনা নিয়েই এক একটি আলোচনা সম্ভব। বিষয় ‘ত্রিষ্টুপ’-এর লুকোনো অঙ্কুরের সূত্রকে আবিষ্কারের দায় পাঠকের উপরই ছেড়ে দিয়েছেন সম্পাদক। ছাপার স্পষ্টতা, অক্ষরবিন্যাস যথাযথ। প্রচ্ছদের সৌজন্যে খোদ সম্পাদক। পত্রিকার এই সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয়েছে শামিয়ানা পরিবারের অসুস্থ কবি, অনুবাদক গৌতম ঘোষদস্তিদারকে তাঁর আরোগ্য কামনায়। গভীর নিবেদন ও অন্তর্নিহিত গরজের প্রতিফলন এমন এক একটি সংখ্যা বাংলা সাহিত্যের জগতে যে এক অনন্য অবদান এতে কোনও সন্দেহ নেই।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

শামিয়ানা - ত্রিষ্টুপ সংখ্যা
আলোপৃথিবী ও কথকতা প্রকাশন, কলকাতা ৪
মূল্য - ৫০০ টাকা 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়