Skip to main content

সংগ্রহযোগ্য বিশেষ সংখ্যা ‘বাক্প্রবাহ’


ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বাংলা ছোট পত্রিকা বেরোয় হাতে গোনা কয়েকটি। তার মধ্যে নিয়মিত বেরোয় কিছু সংখ্যকই। বরপেটা রোড থেকে অধ্যাপক ড. শংকর কর সম্পাদিত ত্রিভাষিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘বাক্‌প্রবাহ’-এর সবে পথ চলা হয়েছে শুরু। এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে মোট তিনটি সংখ্যা। পত্রিকা প্রকাশের বহুবিধ সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে এই সফল উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এক অনন্য কৃতিত্বের দাবি রাখে। ‘বাক্‌প্রবাহ’ পত্রিকা সততই বিষয়ভিত্তিক, গবেষণামূলক এবং সুচয়িত লেখকসমৃদ্ধ।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যা। জুন ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা। এবারের বিষয় - ‘ভূপেন হাজরিকা ও মানবতাবাদ’। সুচিন্তিত এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়। মানবতার যে বার্তা ছড়িয়ে গেছেন এই মহান শিল্পী তার রেশ ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। একের পর এক মানবতা, মানবিকতা ও একতার জয়গান গেয়ে বহুমুখী প্রতিভাধর এই শিল্পী ভুবন জুড়ে রেখে গেছেন চিরকালীন ছাপ - আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভল্গার রূপ দেখেছি, অটোয়ার থেকে অষ্ট্রিয়া হয়ে প্যারিসের ধুলো মেখেছি। আমি ইলোরার থেকে রং নিয়ে দূরে শিকাগো শহরে দিয়েছি, গালিবের শায়ের তাসখন্দের মিনারে বসে শুনেছি। মার্ক টোয়েনের সমাধিতে বসে গোর্কির কথা বলেছি... - অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছিল তাঁর যাযাবরী জীবনের শৈল্পিক পরিক্রমা। এই হেন বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আমরা গর্বিত এবং স্বভাবতই পত্রিকা সম্পাদকের এক যথোচিত পদক্ষেপ এ কথা অনস্বীকার্য।
১১৯ পৃষ্ঠার লেখালেখিতে বাংলা, অসমিয়া ও ইংরেজি এই তিনটি ভাষায় রয়েছে বহু মূল্যবান নিবন্ধ যার পাঠ পাঠককে ভরিয়ে দেয় এক নতুনতরো পরিচিতির পঠনসুখে। অনেক অজানা তথ্য, চমকে দেওয়া তথ্য, এমনকি আজকের দিনেও বহুল ভাবে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য তথা অনেক জানা তথ্যের সুনিপুণ প্রয়োগ লক্ষ করা যায় নিবন্ধসমূহের পাঠে। পরিসরের অভাবে প্রতিটি নিবন্ধের আলাদা আলোচনা সম্ভব না হলেও একথা বলা যায় যে বিষয় অনুযায়ী শ্রদ্ধেয় এই শিল্পীর মানবতাবাদ নিয়েই কলম ধরেছেন অধিকাংশ লেখকরা। বাংলা বিভাগে রয়েছে মোট নয়টি নিবন্ধ। ‘ভূপেন হাজরিকা ও মানবতাবাদ’ অর্থাৎ তাঁর শৈল্পিক সত্তার পাশাপাশি তাঁর মানবতাবাদ বিষয়ক চিন্তাচর্চা ও কর্মকাণ্ডকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে এইসব নিবন্ধের মাধ্যমে। শিল্পীর ‘মানুষ মানুষের জন্য...’ গানটিই বারবার উঠে এসেছে প্রায় সবক’টি নিবন্ধে। যাঁরা লিখেছেন তাঁরা হলেন - দীপক কুমার রায়, শেখর চক্রবর্তী, খগেন চন্দ্র দাস, অজিত কুমার সিংহ মাম্পি গুপ্ত, মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম, মধুমিতা দত্ত, আশুতোষ দাস ও নিত্যানন্দ দাস। একের পর এক বৈচিত্র্যপূর্ণ লিখনশৈলীযুক্ত এইসব নিবন্ধের আলাদা করে আলোচনার লোভ সংবরণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। সেই স্বাদ নাহয় তোলা থাক নিমগ্ন পাঠকের জন্যই।
অসমিয়া বিভাগে কলম ধরেছেন হৃষিকেশ গোস্বামী, ইন্দিরা বড়ো, রবীন্দ্র ভট্টাচার্য, রেণু হাজরিকা, হেমন্ত ডেকা, হিতেশ দাস, মেছের আলী আহমেদ, পদ্মা সরকার, মিনতি ভট্ট, মনীষা শর্মা ও প্রণীতা দাস। ইংরেজি বিভাগে যাঁরা লিখেছেন - জাকির হুসেইন ও রুমি শর্মা। তিনটি বিভাগেই যাঁরা লিখেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই এ অঞ্চলের বিশিষ্ট লেখক এবং বিষয়ের উপর আলোকপাত করার দায়বদ্ধতাসম্পন্ন। একটি পত্রিকার শুধু বিষয় নির্বাচনই নয়, লেখক নির্বাচনেও থাকে এক বিশেষ কর্মদক্ষতা। সম্পাদক এখানে একশো ভাগ মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। প্রতিটি নিবন্ধের শেষে রয়েছে লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও ঠিকানা।
যে বিষয়টি এই সংখ্যাটির ক্ষেত্রে (এবং পূর্বতন সংখ্যাগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) এক আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে তা হল এই পত্রিকার সম্পাদকীয়। সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে প্রতিটি সংখ্যারই মতো এই সংখ্যাটিতেও রয়েছে সম্পাদক কর্তৃক লিখিত এক সমৃদ্ধ সম্পাদকীয়। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ শীর্ষক এই সম্পাদকীয়টি নিজেই একটি পরিপূর্ণ নিবন্ধ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে পত্রিকার পাতায়। লিখছেন - ‘’ভারতরত্ন ড. ভূপেন হাজরিকা’র নামের সাথেই যেন জড়িয়ে রয়েছে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি, এক অপরূপ স্পন্দন - মানসিক শক্তি স্ফুরণের এক অভাবনীয় প্রেরণা। ভূপেন হাজরিকা মানেই হচ্ছে একটি ইমেজ, একটি আবেগ, একটি উদ্দীপনা - যে উদ্দীপনা জীবন সংগ্রামে ঝিমিয়ে পড়া, পিছিয়ে পড়া, হার না মানা মানুষের পুনরুত্থান সঞ্চারে নতুন ভাবে জেগে ওঠার রসদ... মানুষের প্রতি অত্যাচার, অবিচার, নিপীড়ন, শোষণ - এসব ছিল তাঁর কাছে অসহনীয়...।’ বস্তুত এই মহামানবের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিক, প্রতিটি সত্তা যেন ধরে রাখা হয়েছে সম্পাদকীয়তে।
পত্রিকার কাগজ, ছাপার মান, শন্দবিন্যাস, পেপারব্যাক প্রচ্ছদ সবকিছুই উন্নত মানের। সুধাকণ্ঠ, ভারতরত্ন ড. ভূপেন হাজরিকার উদ্দেশেই উৎসর্গ করা হয়েছে সংখ্যাটি। আধুনিক শুদ্ধ বানান যথাযথ অনুসরণ করা হলেও ফাঁক গলে থেকে যায় কিছু - এ অনিবার্য। ছিমছাম হলেও প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের শিল্পীর নাম অনুল্লেখিত। এসব কাটিয়ে সার্বিকভাবে এক সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা - ‘বাকপ্রবাহ’ তৃতীয় সংখ্যা।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - প্রিয়াংকা কর, বরপেটা রোড
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৬৭৮২১১১৪৪

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি