Skip to main content

তিরতির মগ্নছায়ায় ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম্য শরীরের গন্ধ... কদমকাঠ ‘মৃৎপাত্রে যমজ ফুল’


গ্রন্থনাম থেকে শুরু করে বহু কবিতার শিরোনাম এবং কবিতার শরীরে সংস্থাপিত প্রতিটি পঙ্‌ক্তি জুড়ে শব্দের অসাধারণ প্রয়োগ যাঁর কবিতার সহজাত অনুষঙ্গ, বরাক তথা উত্তরপূর্বের সেই তরুণ কবি-প্রতিভা নীলাদ্রি ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘মৃৎপাত্রে যমজ ফুল’ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি আগরতলা, ত্রিপুরা থেকে। প্রকাশক রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ, দৈনিক বজ্রকণ্ঠ।
আধুনিক কবিতার সর্বাধুনিক রূপ উত্তরপূর্বের যে ক’জন কবির কবিতায় পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে নীলাদ্রি এক স্বতন্ত্র পরিচিতি নিয়ে বহুদিন ধরে কবিতা লিখলেও সম্ভবত এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থে আত্মকথন জাতীয় কোনও ভূমিকা নেই। নেই সূচিপত্রও। এর অন্যতম কারণ হয়তো গ্রন্থের আকার। কপিয়ার কাগজে দুই ফর্মার গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে এক-পৃষ্ঠা-জোড়া মোট ২৮ টি কবিতা। কবি-প্রকাশক স্বভাবতই চেয়েছেন যত বেশি সংখ্যক কবিতার সংযোজন। অপ্রাসঙ্গিক নয় এই চিন্তাধারা কারণ নীলাদ্রির কবিতাই যেখানে কথা বলে সেখানে বাহুল্য বর্জনই শ্রেয়।
সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের কবিতাগুলিতে কবি কাঁচা রোদের লাবণ্যে তুলে ধরেছেন বোধ ও অনুভবের পরাকাষ্ঠা। নীলাদ্রির কবিতা পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে অন্য এক সূত্রে। সহজ কথায় বক্তব্যকে উপস্থাপনের পথে হাঁটেন না কবি। কবিতার নির্যাস অন্তরস্থ করতে হলে নিমগ্ন হতে হবে পাঠককে। পাঠশেষে প্রতিটি কবিতা একাধিক অনুষঙ্গে স্থান করে নেয় পাঠক মননে। নীলাদ্রির কবিতার ভাবার্থ উদ্ধারের একমাত্র পথ হল নিবিষ্ট পঠনে কবিতার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নেওয়া। আবছা পাঠে কিছু শব্দের অনুরণন বই কিছুই আত্মস্থ হবার নয়। অথচ একাগ্রপাঠে কবিতায় নিজেকেই পুনরাবিষ্কার করতে সক্ষম পাঠক। শব্দ বা শব্দ-দ্বিত্বের চমকপ্রদ প্রয়োগ যেন কবির কলমে ঝরে পড়ে ঝরনাবারির মতো। কিছু কবিতায় চোখ রাখা যাক -
প্রথম কবিতা গ্রন্থনাম অনুযায়ী - ‘মৃৎপাত্রে যমজ ফুল’। মাত্রই আট পঙ্‌ক্তির এই কবিতায় আছে -
মৃৎপাত্রে যমজ ফুল / তুমুল সৌরভের তীব্রতা / নিগূঢ় দিনরাত / অফুরান ভাষা। / শব্দের চিহ্নগুলো / এখানে জমাট বাঁধা / অন্তরাকাশে / অন্তঃসত্ত্বা।’
নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করতে গেলে স্পষ্ট অনুভূত হয় কবি এখানে তাঁর আত্মপরিচয়, কিংবা আসন্নপ্রসবা কোনও মায়ের ভেতর জন্মোন্মুখ সন্তানের নৈসর্গিক এবং অলৌকিক অবস্থান নিয়ে উপস্থাপন করেছেন তাঁর ভাবনার প্রকাশ।
এমনি গ্রন্থ জুড়ে প্রতিটি কবিতাই হয়ে উঠেছে নির্মোহ যাপন বিষয়ক কাব্যিক চমৎকারিত্বের এক একটি স্বর্ণোজ্জ্বল উপস্থাপন। এমনই সব অসাধারণ শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমেই কবি নিজেকে করেছেন উদ্ভাসিত, প্রকাশিত করেছেন তাঁর নিত্যদিনের বোধ, ভাবনা, ভালোবাসা। শনবিলের ছেলে নীলাদ্রি। স্বভাবতই তাঁর কবিতায় অবধারিতভাবেই আসবে শনবিল বিষয়ক অনুভূতি, যেমন আসবে বরাকের অনুষঙ্গ। কবি তাই লিখেন -
কতদিন পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আজ পেরিয়ে যাচ্ছে আমার অপ্রাপ্ত শব্দের সাঁতার, / তার হাত নেই / দেখতে সে প্রেমের মতো / তবু পেরিয়ে যাচ্ছে অনায়াসে পুরোনো দিনের নৌকার শনবিলী হাওয়ার গন্ধ / আশ্চর্যভাবে এক দেহছায়া আমার জন্মকাঠে দাঁড়িয়ে দেখছে এইসব...। (কবিতা সাঁতার-২)। লিখেন -
ওজনে কম হলেও, তার চোখের জল নীরবে নামে বরাক মায়ের কোলে... / সেই শব্দহীন ভাষা থেকে কুড়িয়ে তোলা নির্বাক নিরীহ মুখ আমাদের কঠিন / কাঠের জীবন নৌকোর শেষ নিঃশ্বাস আটকে রাখে অন্তত কিছু মুহূর্ত অনন্য / বরাকের আরশি ছায়ায়। (কবিতা - ঢেউ)।
এই আঙ্গিকের আধুনিক কবিতায় স্বভাবতই ছন্দ খুঁজতে যাওয়া এক বৃথা আয়াস। তবু অনুচ্চারিত ছন্দে, স্বল্প কথায়, সুচয়িত শব্দের প্রক্ষেপণে কবি ঢেলে দিতে জানেন কাব্যসুষমার কারিকুরি। আর অক্লেশে মিটিয়ে দেন জগৎ ও জীবনের প্রতি তাঁর জন্মঋণের দায় -
রোদের কোলে তখনো লগ্নঝিল অল্প কুয়াশা,
হয়তো মিলন রাসের অবশিষ্ট বিরহজল।
অঘ্রাণ হাওয়ার ভেতর যেমন পাখির চোখের জল,
বাঁশির নরম ঘায়েল ডাকে ভিজে যায়... ঠিক তেমন
তিরিতির মগ্নছায়ায় ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম্য শরীরের গন্ধ... কদমকাঠ
হৃদয় ঘুঘুর উল্লাস
ধানবুকের তণ্ডুল সুখ...
তোমার সব হারানো ঊর্ণ সংসার মায়ায়। (কবিতা - গ্রাম্য শরীর)
কবি যখন লিখেন - কার দিকে চেয়ে আমি দাঁড়াব / জন্ম না মৃত্যু ? কবির তখন জীবনের কথাই মনে পড়ে। জীবনবোধে আসক্ত কবি আবার কবিতায় কবি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন বিচিত্র সব আঙ্গিকে, শব্দোৎকর্ষে এভাবে -
আমি কবি নই
মৃত জানালার শার্সি।
মাটির বেহালা, কাঁচা গ্লাসের পান্থনিবাস...
পান্তাভাতের বিমূর্ত ছায়া...
ধানভানা হাতের নৈঋত আঘাত...
হাসনুহানা ঘাসের নখ...
জং ধরা ঘুমের ভেসে যাওয়া বাস্প...
গতজন্মের বায়নার শাড়ি্‌...
অনাথ ছেলেটার ডাস্টবিন আত্মজীবনী...। (কবিতা আমি কবি নই)
অথচ এভাবেই তিনি কবি। কিছু কবিতা যেমন শেষের দিকে অবয়বে স্ফীত হয়ে ওঠার বিপরীতে অধিকাংশ কবিতাই স্বল্পদৈর্ঘে স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে উঠেছে। যেমন - ক্ষতস্থান, আশ্বিনের রোদ, আকাশ, ঘুরপাক, ছাতিম কাঠের আঙুল, মুহূর্ত, জীবন, উপবাস, আহরণ, ছায়া, দহন, পরখ, মায়ের প্রথম বিশ্রাম ইত্যাদি। ছিমছাম নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ। কাগজের মান, মুদ্রণ যথাযথ হলেও অক্ষর ফন্ট পাঠকবান্ধব নয়। কিছু বানানে ছোটখাটো ভুল থেকে গেলেও বানানের শুদ্ধতা উল্লেখনীয়। শেষ পৃষ্ঠায় রয়েছে সচিত্র কবি পরিচিতি। সব মিলিয়ে এক পঠনসুখের কাব্যগ্রন্থ ‘মৃৎপাত্রে যমজ ফুল’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

 
মূল্য - ১২৫ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০৫৪৯৩৬৮৭ (প্রকাশক) 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়