Skip to main content

কলমবাজের সংসার

 কলমবাজের সংসার

 

বয়স বেশি হলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের ডেরা। আবার বয়স কম হলে মস্তিষ্কের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বেশি থাকে আমার আট বছরের সন্তানের স্কুলে যেদিন ইংরেজির বাক্যবিন্যাসের ব্যাপারে নোট দেখলাম তার পরদিন স্কুলে গিয়ে শিক্ষক মশাইকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম - এসব কী হচ্ছে ? জবাবে শিক্ষক মশাই যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হলোছোট বাচ্চাদের মগজ হাতির মতো যত দেবেন ততই নেবে শুনে আমার চোখ কপালে যদিও কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম - যা রটে তার কিছুটা হলেও সত্যি বটে নাহলে কৈশোরে একশোটা দেশের নাম রাজধানী সহ মনে রাখতাম কী করে ? আবিষ্কার ও আবিষ্কর্তার একগাদা নামই বা কী করে বসত করত ঠোঁটের আগায় ? আজ ক'টাই বা আর মনে রাখতে পেরেছি ?

তবে ওইসব মনে রাখতে গিয়ে কিছু বুদ্ধিরও প্রয়োগ করতে হতো উদাহরণ স্বরূপ ফাউন্টেন পেন অর্থাৎ কলম হলেই জলের কথা মনে এসে যেত ব্যস, জল থেকে ওয়াটার আর ওয়াটার থেকে ওয়াটারম্যান (ভাগ্যিস ওয়াটারমেলন নয়)। একটা ছবিও ভেসে উঠতো মানসচক্ষে এক ভদ্রলোক বাড়ি বাড়ি জল বয়ে নিয়ে যেতে যেতেই একদিন কলম আবিষ্কার করে পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে লিখতে শুরু করে দিয়েছেন এরকম কিছু অলীক স্বপ্ন আরকি (অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন ওয়াটারম্যান সাহেব)

এরপর কলম বললেই যে ছবিটি আজ সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো ড্রপার দিয়ে কিংবা দোয়াত উলটে সুলেখা কালির দোয়াত থেকে কলমে কালি ভরার কসরত কতদিন যে ওল্টাতে গিয়ে খালি হয়ে গেছে আধখানা দোয়াত। সে কী বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। সবেধন নীলমণি একটি মাত্র কলম কখনো তার বিগড়ে যায় নিব তো কখনো নিবের তলার জিহ্বা কসরতে কসরতে জেরবার হয়ে শেষটায় সারাদিন কাটিয়ে স্কুলফেরত যখন এসে পৌঁছতাম ঘরে ততক্ষণে সাদা সার্টটির পকেট নীলমণি আর সুলেখার অবাধ প্রেমের দাপাদাপিতে 'নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর'

তো সেই নীল কালিতে মাখামাখির দিনও একদিন সোনার (?) খাঁচায় আর রইল না সুদূর চিন থেকে উইংসাং এসে যেন একেবারে রাজা বানিয়ে দিল কলমরাজা লেখালেখির বহরটাই বেড়ে গেল তখন পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর জীবনী শিখছি দু'টিতে গুলিয়ে ফেলতাম প্রায়শই বিড়ম্বনা আর কাকে বলে ? এখন হাড়ে হাড়ে 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে' - ওগো ধুর্ত চিন বাজারটাকে গ্রাস করে কুক্ষিগত করেছ বিশ্বটাকে

সে যাই হোক সেই খুদে কলমবাজের দিনও একসময় ফুরিয়ে এল নানা জাতের কলমে ভরে উঠলো কলমদানি এক কলমে চার রঙের চারটি রিফিল যেন আস্ত একটি ইচ্ছেকলম পকেটে নিয়ে সে কী বাহাদুরি তবে বাহাদুরির খেলায় মাঝে মাঝে বড্ড ঝটকা দিত কিছু সহপাঠী বন্ধুরা অমন ছাপার মতো হস্তাক্ষর নিয়ে যেন রীতিমতো ব্যঙ্গ বিদ্রুপে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিত আমার যত বাহাদুরি, জারিজুরি বাক্সবন্দি কলম থেকেও যেন ইচ্ছে হতো না কিছু লিখি কারণ অনেক সময় নিজের লিখাটিও যে বুঝতাম না নিজেই সেই দুঃখ আর বলি কাকে ? নানান ফন্দি ফিকির করেও ওই লাইনে আর খাটলো না আমার কলমের কারিগুরি শেষে রণে ভঙ্গ

এরপর নদী দিয়ে বয়ে গেল অনেক জল কলমের বিবর্তন ঘটলো চোখের সামনে লক্ষ টাকার কলমের কথাও কানে এলো এহ বাহ্য কলম তো নয় যেন তরবারি (তখন জানতাম না যে তরবারির চেয়েও কলম শক্তিশালী, পরে জেনেছি) যদিও আজ অবধি আমার সর্বোচ্চ রেকর্ড সাকুল্যে কুড়ি টাকা সচরাচর দশ কিংবা পাঁচ - এমনকি দুই টাকা অবধি বিশেষ ফারাক বুঝিনি কিছুতেই এই পাঁচ, দশটাকা দিয়েই তরতরিয়ে পেরিয়ে গেছি একগাদা পরীক্ষা বৈতরণি তবে সবচাইতে বেশি দুঃখের কথা যেটি তা হলো আমার হাতে আজ অবধি কোনও কলমেরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি কোথায় যে অকালে সবাই হারিয়ে গেল পকেট থেকে তার আর কোনও হদিশই পেলাম না কতদিন কত সজ্জনকে অফিস আদালতে কলম ধার দিয়ে বেমালুম ভুলে ফিরে এসেছি ঘরে তার ইয়ত্তা নেই নিয়েছিও অনেকের কাছ থেকে সেইবেলা কিন্তু ফিরিয়ে দিতে ভুল করিনি আমার মতো এই অসহায় অবস্থা অনেকেরই হয়েছে তাই শেষের দিকে দেখতাম কলম চাইলে তার মুখটা নিজের কাছে রেখে শুধু দেহটা ধরিয়ে দিতেন কী বুদ্ধি মাইরি দেখাদেখি আমিও কিছুদিন করেছি এমনটা এই পকেটমারির ঠেলায় কৈশোরে মায়ের হাতে মারও খেয়েছি বেশ কদিন যথা সময়ে বাবা এসে নিজের পকেট খালি করে নতুন কলম এনে দিয়ে উতরে দিয়েছেন বার বার

এভাবেই কলমের সাথে চোর পুলিশ খেলার ফাঁকে কবে যে কলম নিয়ে এটা ওটা লিখার নেশায় পেয়ে বসেছে তা আর খেয়ালই করিনি কিছু নমস্য সম্পাদকের করুণায় লিখাগুলো যখন নবরূপে, নবসাজে ছাপার অক্ষরে প্রসবিত হতে শুরু হলো তখন টের পেলাম এভাবে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া বড়ই শ্রমসাধ্য হয়ে উঠেছে অতএব, বিকল্পের সন্ধান শুরু হলো আর বিকল্প পথের সন্ধান পেয়ে তাতে সড়গড় হতে হতে চোখের সামনে একটা বিপ্লব যেন দেখতে পেলাম স্পষ্ট কলমের মৃত্যুঘণ্টা যেন শুনতে পেলাম কানে নিজেও ততদিনে সরিয়ে রেখেছি সেই হাতেখড়ির দিন থেকে শুরু করে দীর্ঘদিনের আমার পকেটসঙ্গী বন্ধুটিকে

যুগধর্ম আজ পালটে যায় সঘন কম্প্যুটারে পুরোদস্তুর স্বাছ্যন্দ আসতে না আসতেই মুঠোফোনে সুড়ুৎ করে যেন নিজের জায়গা করে নিল কলমবাজের গোটা বিশ্বটিই বিশ্বের অগুনতি ভাষার অভিধান থেকে শুরু করে ব্যাকরণসম্মত প্রতিটি ভাষারএকসে বড়কর একসুন্দর অক্ষর শৈলীর লিখন ধাঁচ আধখানা অক্ষর লিখতে না লিখতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরো শব্দটি সুতরাং আর যায় কোথায় ? বিস্মৃতির অন্তরালে আজ কলমের চেহারা ফাঁকা কলমদানি পড়ে থাকে টেবিলের এক কোণে কিংবা বিদায় নেয় টেবিল থেকে জরুরী সময়ে কিছু সাইন করতে গেলে ঘরময় খুঁজেও হদিশ মেলে না কলমের

কিন্তু সেই যে কথাটি - স্মৃতি সততই সুখের তাই চাইলেও কি আর পুরোপুরি ভুলতে পেরেছি তাকে ? তাই তো আজও সরস্বতী পুজোয় তাঁর মূর্তির পায়ের কাছে দুধভর্তি দোয়াত আর খাগের কলম দিতে ভুলি না বলি - মা গো, আমাকে বিদ্যা দাওযেন ওই কলমটিই যত বিদ্যার চাবিকাঠি। এখনও অনেকেই গালগল্প, কবিতা লিখে শিরোনামে লিখি, কলমে - - - অমুক - - - - তাই তো গোটা প্রক্রিয়ায় কলম অনুপস্থিত থাকলেও ভালো কিছু লিখতে পারলে পাঠকেরা বলেন - দুর্দান্ত কলমবাজ, কিংবা - ভদ্রলোকের (বা ভদ্রমহিলার) কলমের ধার আছে কিংবা আজও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় বুদ্ধিজীবীর কলমে। কলমের নিরুদ্দেশের সাথে সাথে ‘লেখালেখি’ শব্দটিও যেন হয়ে পড়ছে অপ্রাসঙ্গিক। বস্তুত এখন তো আর কিছুই লিখিনা আমরা, শুধুই টাইপ করি

মূল লিখাটি লিখে তারপর খামে পুরে বাইরে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে ঠিকানা লিখার দিনটি প্রায় অন্ত আজ পোস্টকার্ড কিংবা ইনল্যাণ্ড লেটার জুড়ে কলমের লিখায় সুখ দুঃখের বর্ণনা লিখার পালাটি ঘুচেছে কবেই আজ আঙুলের ছোঁয়ায় নিমেষে বার্তার আদান প্রদান সামাজিক মাধ্যমে নিত্যদিনের লেখালেখি - থুড়ি - টাইপাটাইপি চোখ প্রায় ঝালাপালা গালগল্প কবিতার অনন্ত ভাণ্ডার। কলম হাতে আজ বিধ্বস্ত সেই কলমবাজের সংসার

তবুও আজ, আমরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েও সব কলমহীন কলমবাজ

- - - - - - - - - - - - - - - - - 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়