Skip to main content

বরাক ২০২০ - ৩য়

এবারের স্বল্পকালীন বরাক ভ্রমণের প্রথম দিনে হাইলাকান্দি জেলার দ্বিতীয় শহর লালাবাজারে মুখোমুখি দুই 'প্রিয়'র।

দীর্ঘ কয়েক দশক পর সান্ধ্য বাজারে দেখা পেলাম শনবিলের সেই বিশেষ প্রজাতির মাছের। 'ভুজিয়া মাছ' ছাড়া দ্বিতীয় কোনও নাম আমার জানা নেই।
জীবনের সব চাইতে কম খরচে কেনা সুস্বাদু মাছ - ভুজিয়া। 25 পয়সার মাছ দিয়ে পাঁচ জনের সংসারে দুবেলার খোরাক। (জানি অনেকেই গুলবাজ ভাববেন। কিন্তু এটাই সত্যি)। শনবিলের ফেরিওয়ালাদের টুকরিভর্তি ভুজিয়া মাছের দিকে 'কিশোর আমি'র অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির পুনরাবৃত্তিতে ভুজিয়া হলো ক্যামেরাবন্দি। ছবিতে ভুজিয়ার সঙ্গে বহু পরিচিত ট্যাংরা মাছও আছে।
শেষ সন্ধ্যায় পূর্ব নির্ধারিত কথামতো চাচক্রে মিলিত হলাম এ অঞ্চলের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষণা ধর্মী ছোট পত্রিকা 'প্রবাহ'- এর সম্পাদক আশিসরঞ্জন নাথ মহাশয়ের সঙ্গে। সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় শুধুমাত্র সাহিত্যপ্রীতি ও সাহিত্যের দায়বদ্ধতায় 'প্রবাহ'কে অবলম্বন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক সর্বজন পরিচিত ব্যক্তি হিসেবে। কথায় কথায় জানালেন তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মসূচি। গভীর চিন্তাপ্রসূত এই সব ভবিষ্যৎ কর্মোদ্যোগ নিঃসন্দেহে এ উপত্যকা তথা গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাহিত্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

কাল কিশোর বেলার কথা লিখেছিলাম। তারও আগে অর্থাৎ বালক বয়স থেকেই বাজারে যাওয়ার ভীষণ শখ। চোখের সামনে দেখতাম বাবা এবং দাদা বাজারে যেতেন এবং সেখান থেকে নানা রকম খাওয়ার জিনিস আনতেন। সুতরাং ধরেই নিয়েছিলাম যে বাজার নামক জায়গাটি হচ্ছে ভোজন সামগ্রীর খনি। তাই রোজ বায়না ধরতাম যাওয়ার জন্য। শেষমেশ বাবা একদিন বললেন যে যেহেতু আমি তখনও অনেকটাই ছোট তাই আপাততঃ আমাকে বাজারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে যেদিন মশারির উপরিভাগটা হাত দিয়ে ছুঁতে পারব সেদিনই আমাকে বাজারে নিয়ে যাওয়া হবে।
শুরু হলো প্রতীক্ষার পালা। রোজ কসরতে কসরতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর অদম্য প্রচেষ্টা। আর কথায় আছে না - চেষ্টায় কী না হয়। একদিন সত্যি সত্যিই ছুঁয়ে দিতে পারলাম মশারির উপরিভাগটা। সে কী আনন্দ। বলে বুঝানোর নয়।
সারা দিন অনন্ত প্রতীক্ষা শেষে বাবা অফিস সেরে বাজার করে রাতে ঘরে ফিরতেই সোজা দেখিয়ে দিলাম কৃতিত্ব। এবার আর আমার বাজারে যাওয়া আটকায় কে ? কিন্তু আমার যাবতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা উৎসাহে জল ঢেলে বাবা ঘোষণা করলেন - বিছানার উপর দাঁড়িয়ে নয়, নীচে মেঝেতে দাঁড়িয়ে ছুঁতে হবে মশারির উপরটা। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল জীবনে আর বাজারে যাওয়া হলো না আমার। এই আশাটি আর মনের মধ্যে রেখে কোনো লাভই নেই।
এরপর সেই দিনটি থেকে আজ অবধি জীবন ধারা বয়ে চলেছে স্বাভাবিক ধারায়। কিন্তু বাজারে - বিশেষ করে হাটের দিনে হাটে যাওয়ার একটা আলাদা মজা পাই আমি।
কিশোর বয়সে মেঝেতে দাঁড়িয়ে মশারির উপরটা ছুঁতে পারার বয়সে যখন বাজারে যাওয়ার ছাড়পত্র মিলেছে তখন দেখলাম সাপ্তাহিক হাটে গিয়ে সস্তায় জিনিসপত্র আনছেন সবাই। বিশেষ করে কোনও অনুষ্ঠানাদিতে এমনটাই ছিল রেওয়াজ। আমার অগ্রজার বিয়ে, ভাগ্নের অন্নপ্রাশন আদিতে কত সস্তায় কতকিছু এল সেখান থেকে। বাড়ি থেকে মাইল দশেক দূর আয়নাখালে হাট বসতো প্রতি রবিবার। মনে আছে 20 টাকা দিয়ে সেখান থেকে একটা পাঁঠা আনা হয়েছিল। সেই তখন থেকেই মনটা আমার ঘুরে বেড়ায় হাটে বাজারে। এই সেদিনও কর্মসূত্রে বিভিন্ন প্রোজেক্ট সাইটে আসতে যেতে হাট পেলেই নেমে পড়তাম গাড়ি থামিয়ে। এক একটা হাট যেন এক মিনি দেশ যেখানে জনসমুদ্রে মিশে হারিয়ে যেতে খুব খুব ভালোবাসি আজও।
এবারের সংক্ষিপ্ত বরাক সফরে আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো আজ তো রবিবার। লালাবাজার থেকে মিনিট কুড়ির রাস্তা। ব্যস আর যায় কোথায় ? সকাল সকালই বেরিয়ে সোজা অটো করে গিয়ে হাজির আয়নাখাল বাজার। জনজোয়ারে ভাসছে যেন গোটা অঞ্চল। মূল বাজারে পৌঁছানোর আগে থেকেই ছোটখাটো বিকিকিনির পসরা। কেউ হাতে টেনে, কেউ বা বগলদাবা করে হাঁস, কবুতর, পাঁঠা, মেষ, মুরগি নিয়ে ছুটছে। আমিও ছুটছি শুধু ছুটছি যেন কীসের টানে আমি নিজেও জানি না। হাইলাকান্দির প্রসিদ্ধ কচুও দেখতে পেলাম। সেই 20 টাকা দামের পাঁঠার সমান একটি পাঁঠার দাম জিজ্ঞেস করতে বললো 2000 টাকা। অর্থাৎ কিনা 40 বছরে 100 গুণ বেড়েছে দাম। দেখতে পেলাম অনেক কিছু। অনেক পরিবর্তন। ক্রেতা বিক্রেতার ধর্মীয় বিন্যাস পাল্টে গেছে আমূল। স্বভাবতই ভাষাগত বিন্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। সিলেটি এ অঞ্চলের লিংগুয়া ফ্র্যাঙ্কা হলেও ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে এর কথ্যরূপের তারতম্য রয়েছে।
বাজারের একেবারে ভিতরে ঢুকে গেলাম আগেরই মতো। জমজমাট পরিবেশ। করোনা বলে কিছু ছিল বা আছে বলে মনে হলো না। গোটা বাজারে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে আমি ও আমারই মতো আরেক হতভাগার মুখেই শোভা পাচ্ছিল মাস্ক্। কেমন যেন ভিনগ্রহীর মতো লাগছিল নিজেকে।
ঘুরতে ঘুরতে মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল একটা সময়। জানতাম না অবচেতন মনটা যে আমার স্মৃতির তাড়নায় খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া জীবন শিক্ষক - আমার বাবা ও দাদাকে। সব কিছু হারিয়ে শুধু বাজারে আসার গরিমাটুকু নিয়েই ফিরে এলাম লালাবাজার।

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়