না
সাহিত্য বিষয়ক এক ছোট পত্রিকার
সম্পাদক সম্প্রতি সম্পাদকীয়তে লিখেছেন - “আমরা লিখতে পারি সকলেই ; কিন্তু লিখতে জানি না অনেকে।”
নমস্য সাহিত্যিক কাম সম্পাদক। তাঁর
উপর মন্তব্য করা কি আমার মতো নালায়েকের সাজে ? তবুও মনের না-না কথা
না বলেই বা থাকি কী করে ? কথাটা ভাবলেই যে শরীর মনে কেমন একটা
না-বোধক ছাপ পড়ে যায়। আর সে অর্থে ভুল তো তিনি লিখেননি। আমরা
অনেকেই তো লিখতে জনি না। তবে আমার আপত্তিটা কিন্তু ওই প্রথম লাইনকে নিয়েই। লিখতে
তো জানিই না কিন্তু আমরা লিখতে পারি সকলে ? এখন যে ‘বাংলাটা ঠিক
আসে না’র যুগ। জানিস, আমার ছেলে বাংলা বলতে
পারে - তবে লিখতে বা পড়তে পারে না। তাই
বলছিলাম ওই - কথাটা যেন মেনে নিতেই পারছি না। আর পারবোই বা কেন ? সে অর্থে লিখতে পারাটাই
যে হয়ে উঠলো না আজ অবধি। চেষ্টা তো চালিয়েই যাচ্ছি সে কত কাল
থেকে। কিন্তু
পারলাম কই ? নিজের মনের মতো করে অন্তত একটি কবিতাও তো লিখে উঠতে পারলাম না আজও। কে
যেন বলেছিলেন - আমার কবিতা লিখা, সে তো সাপের ছুঁচো ধরা। আর
এখন তো যা দিনকাল পড়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আর লিখতে পারার দরকার পড়বে বলেও মনে হয় না। কারণ
অনলাইন শিক্ষাদীক্ষায় লিখা নয়, টাইপিংটাই
শিখতে হবে পটু হাতে। কাগজ, কলম আউট, কী-পেড ইন। বোধ করি এবার থেকে বাচ্চাদের হাতেখড়ি
হবে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের কী-পেডে লিখার মাধ্যমে।
সে যাই হোক, যে কথাটি বলছিলাম
- লিখতে পারার মানসে ছোটবেলা থেকেই এন্তার কাগজ আর কালির অপচয় করে গেলাম। কিন্তু
ধান ভানতে শুধু শিবের গীতই গাইলাম। কবিগুরু তো তখনই শতবর্ষ পরের কবিতা
লিখে গেছেন। আজি
হতে শতবর্ষ পরে - -
- । বুঝি
তাঁর প্রখর দূরদৃষ্টিতে আমার মতো লিখতে না পারা লেখকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছিল। তাই
বোধ হয় বিদ্রুপ করে এটাও জানিয়ে গেছেন - যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিভে যায় বারে বারে।
আমিও আলো আর জ্বালাতে পারলাম
না। শুধু
লেখার কথাই বা বলি কেন
? কিছুই তো হলো না। পূজনীয় পিতৃদেবের ভাষায় মানুষই হলাম
না। অর্থাৎ ‘না’-তেই ভরে গেল জীবনটা। জাহাজডুবি কিংবা সলিল সমাধির প্রাক্কালে
মানুষ যেমন কুটোগাছা পেলে সেটাকেই আঁকড়ে ধরে জীবন রক্ষা করতে চায় আমিও তেমনি একেবারে
তলিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই
‘না’কে ধরেই একবার চেষ্টা করে নাহয় দেখি। বরং
বলা যায় জীবনরক্ষক নায়ে উঠে দেখি। (না = নাও, নৌকো)।
আপাত দৃষ্টিতে ‘না’ যদিও বা নিতান্তই এক নঞর্থক শব্দ তবু এর মাহাত্ম্য একেবারে কম নয়। অভিধান
মতে না = নার = নর বা জল। অর্থাৎ জীবসৃষ্টির আকরটিও না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের
বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানটিও হলো ‘না’। সৃষ্টির
উৎসভূমি - নারী। এখানেও প্রথমেই না। (না - নর - নারী)। জল ও মানুষই - না। সৃষ্টির
আরোও একটি মৌলও না-যুক্ত। নাদ। অণু পরমাণুর পরস্পর ঘর্ষণে সৃষ্টি
হয় নানা ধরণের ধ্বনি
- নাদ। বিজ্ঞজনের মতে নাদ ও ব্রহ্ম অভেদ।
সৃষ্টির পর আসে পালনের
কথা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণু - নারায়ণ। অর্থাৎ নার অয়ন যাঁর। আবার
সৃষ্টি ও পালনের অন্তিম পরিণতি হচ্ছে ধ্বংস অর্থাৎ নাশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে সৃষ্টি
- পালন - ধ্বংস, পৃথিবীর এই কালচক্রের প্রতিটি স্তরেই ‘না’ না লাগিয়ে উপায় নেই।
মনুষ্য সমাজে তো ‘না’-এর দোর্দণ্ড প্রতাপ আকছার। মানুষ তো না-ই, মানুষের সমষ্টিতেও না - নাগরিক। আর
মানুষের পরিচয় ? নামে। মানুষের প্রাণবায়ু ? নাড়ীতে। মানুষের আরাধ্য ? নাথ। মানুষের
সর্দার ? নায়ক। নাচে, নাটকে মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়। না
অর্থাৎ নরের নাক নিয়ে কম নাকানিচোবানি ? কেউ নাক ঝাড়ে যত্রতত্র তো কারোও নাক ডাকে
বিচিত্র। কেউ
নাক সিঁটকায় তো কেউ নাকে খত দেয়। নারীকুল আবার নাকি সুরে মন মজায়, নাকচোনা -
নাকছাবি পরতে নাক বিঁধায়।
দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনে
না-এর
কত বাহার। শিশু
কাঁদলে বড়রা বলবেন -
না, না। কেঁদো না। একটু বড় হলেই শুরু হয় এটা করো না, ওটা করো না। স্কুলে
যেতে রোজ হ্যাঁ-না। স্কুলের
শেষেও না-এর নাকানিচোবানি শেষ হয় না। কলেজে পড়তে সিট পাবে না। কলেজ
পেলেও চাকরি পাবে না। চাকরি না পেলে বউ পাবে না। বউ পেলো তো বনিবনা হয় না। নাগর
হলো তো নাগরিকত্ব পাবে না। না-এর বিড়ম্বনা জীবনেও শেষ হয় না।
ভাষার অভিব্যক্তিতেও কি না-এর দৌড় কিছু কম
? বৈপরিত্যে - যাবোনা, যেও
না। আপত্তি
অর্থে - মেয়ের সবকিছুতেই না। অনুরোধেও না - একবার এসো না আমার
বাড়ি। সন্দেহেও
না - আজ
আসবে না ? আধিক্যে - সেখানে কত না সুখ। অথবা, কিংবা অর্থে
- না পেলো ঘর, না পেলো ঘরণী। প্রশ্নোত্তরে - কেন আসেনি,
না জ্বর হয়েছে। এমনি যত নানা রঙের না।
গানের সুর সাধনায়ও কি কম ‘না’ ? বাথরুমে তানানা ত আসরে তারানা। তুম না তুম না নানা তুম তানানা। আমার
মতো বেসুরোও সারা দিন গুনগন করি - না না না। মনে পড়ে, না-এর কত গান। না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে
যাবো না, সুন্দরী গো দোহাই দোহাই না বলো না, না না না পাখিটার
বুকে যেন তির মেরো না। এবং আরোও কত - লিখে লিখেও শেষ হবে
না। কবিগুরু
তো না এবং নাই দিয়ে নাই নাই করে অন্তত দেড় কুড়ি গান লিখে গেছেন। না-এর নাগপাশে আমার মতো
নাস্তানাবুদ না-কবি সারাটি জীবন চেষ্টা করেও আর নামজাদা হতে পারলাম
না। শুধু
নাজেহালই হলাম।
আমার এক ভাগ্নে - নাম তার নান্টু। এক
নম্বরের নালায়েক। তার
মা অর্থাৎ আমার নাছোড়বান্দা দিদি নাকি অঙ্কের নাম নিতে না নিতেই তার নাকি কান্না শুরু
হয়ে যায়। পা
থেকে মাথা পর্যন্ত একটা না-বোধক নাম সংকীর্তন।
আমার বাল্যবন্ধু নাড়ুগোপালের
কথা না লিখলে এই রচনা সম্পূর্ণ হবে না। নাড়ুর একবার নাট্যকার হবার খুব সাধ
হয়েছিল। সেই
লক্ষ্যে নান্দনিক নামে একটা নাট্য সংস্থাও খুলেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কলেজ
জীবনের সাথী - পরে নাচের দিদিমণি নায়িকা নাথের নানা রকম ছলাকলায় শেষ পর্যন্ত না ঘর কা না
ঘাট কা হয়েই জীবন চলছে। কিছুই করে উঠতে পারলো না। সবারই তো একই অবস্থা। ছোট থেকেই এটা করো না, ওটা করো না শুনতে শুনতে শেষ বয়সে যে এভাবে করোনা দৈত্যের সামনে পড়ে নাকানিচোবানি খেতে হবে সে কী আর ভেবেছিল কেউ একটিবারের জন্যও ?
শেষটায় কিছুই করা হয়ে ওঠে
না বলে ভালো লাগে না। তবু চেষ্টার কসুর করছি না। জানি, এবারও হবে না। তাই
আগেভাগেই আত্মসমর্পণ। পাঠক, কিছু মনে করবেন না। লিখতে জানি তো না-ই, পারিও না।
- - - - - - - -
- - -
Comments
Post a Comment